কোয়ারেন্টাইনে তরুণী ধর্ষণ ও আমাদের দায়
আমির হুসাইন খান।। গত ১৪ই মে খুলনা পিটিআই সেন্টারে ভারতফেরত এক তরুণী ১৪ দিনের প্রাতষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন পুলিশের এসআই কতৃক ধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনার অভিযুক্ত হলেন, মোখলেছুর রহমান, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কোর্ট সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হিসেবে যিনি কর্মরত ছিলেন। তিনি খুলনার প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন সেন্টারে ১ মে থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ধর্ষণের অভিযোগে মামলার পর এএসআই মোকলেছুরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভাগীয় ও ফৌজদারি উভয় দিক দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এই ঘটনায় অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসে, প্রথমত একজন পুলিশ সদস্য যে কিনা সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা দেবেন, সে কেমন করে ধর্ষণের মতো এতো ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস পেলেন। দ্বিতীয়ত প্রশাসনিক অবকাঠামো কেমন করে এতো দুর্বল হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশে সর্বত্র নারী পুলিশ বিদ্যমান সেখানে কেমন করে নারী পুলিশ সদস্যের অনুপস্থিতি থাকে। তৃতীয়ত নারীর প্রতি সহিংসতার এমন ভয়ংকর ঘটনাকে কীভাবে দেশের গণমাধ্যমগুলো এতো কম গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। এ ছাড়াও আমরা দেখেছি ৭১ টেলিভিশনের এক টকশোতে খুলনা পিটিআইয়ের তত্ত্বাবধায়ক এবং কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দা ফেরদৌসী যিনি সরাসরি ভিকটিমের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন ধর্ষণের সময় কেউ কোনো চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পায়নি ।
উল্লেখ্য যে ওই নারী ওই রাতে মোট দুইবার ধর্ষণের শিকার হয় এবং নিজে এই ঘটনায় মামলা দায়ের করে। এ ছাড়াও ওই নারী যাতে মামলা না করে তার জন্য তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি ও দেয়া হয়। ধর্ষিতা দুই সন্তানের জননী যে কিনা এই ধর্ষণের পরে সবার হয়রানির কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের কেউ বিবৃতি দিচ্ছে না, এমন কি স্থানীয় প্রশাসনও ব্যাপারটাকে বেশ হালকাভাবেই নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই এক শ্রেণির বিকৃত রুচির মানুষ এ ব্যাপারে বিভিন্ন যৌন শুরশুরিমূলক ভিডিও বানিয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করছে। অনেকেই আবার এই ঘটনাকে আর দশটা ঘটনার মতো একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু উদ্বেগটা এখানেই, এটা কি আসলেই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি আমাদের এই ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থায় নারীর প্রতি চরম সহিংসতার আরেকটি উদহারণ!
আমরা সকলেই জানি আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার শতকরা নব্বই শতাংশ নারী কেবলমাত্র হয়রানি কিংবা মানসম্মানের ভয়ে তাদের অভিযোগ নিয়ে থানায় যায় না। এটা খুব সহজ যে পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার উদ্দেশে নিয়োজিত থাকে, সেই পুলিশ সদস্যই যদি যাকে নিরাপত্তা দেবে তাকে ধর্ষণ করে তবে এটা বোঝা খুব সহজ যে সে কতখানি বেপরোয়া এবং ভয়ভীতিহীন। এ ছাড়াও ওই পুলিশ সদস্য একই রাতে ওই তরুণীকে দুই দফায় ধর্ষণ করে কারো সাহায্য ছাড়াই, এটাও তো বিশ্বাসযোগ্য না। এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত হওয়া উচিৎ এবং সকল দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিৎ যাতে পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো পুলিশ সদস্য এমন ঘৃণ্য অপরাধ করার সাহস না পায়।
পাশাপাশি প্রশাসনেরও বোঝা উচিৎ, প্রশাসনের ভাবমূর্তির চাইতেও বেশি জরুরি নারীর নিরাপত্তা। তাই একজন নারীর প্রতি সহিংসতা হলে সেটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা করা প্রয়োজন। অন্যদিকে ধর্ষণ কিংবা যেকোনো সহিংসতার শিকার এমন ভিকটিমের নাম পরিচয় গোপন রাখার ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে, প্রয়োজনে কেউ যদি ভিকটিমের নাম পরিচয় প্রকাশ করে তবে তার জন্য শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিকটিমদের নিয়ে যাতে মিথ্যা অপপ্রচার না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি মিডিয়া কর্মীদের এই ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই সব ঘটনা যদি মিডিয়াতে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়, তবে মানুষের মাঝে যেমন সচেতনতা আসবে তেমনি প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কোনো ব্যক্তি এমন অপকর্মের সাহস পাবে না।
আমাদের দেশে বিভিন্ন এনজিও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে, তাই এ সকল ক্ষেত্রে যদি তারা ভিকটিমের ন্যায় বিচার পাওয়া এবং সহিংসতা পরবর্তী প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয় তবে হয়তো অনেক নারীই সহিংসতার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে। সর্বোপরি নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আমাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে এবং নারীর সামাজিক সুরক্ষা যাতে নিশ্চিত হয় সেই লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]