আমাদের গল্পের শেষটুকু কেমন হবে?
কিযী তাহ্নিন।। আমার না রহিম করিমের জন্য খুব মন খারাপ হয়। ওই যে রহিম করিম? ছোটবেলা থেকে চিনে আসা, জেনে আসা রহিম করিম। মনে পড়েছে? আমার বই, সমাজপাঠ বই, বিজ্ঞানেই বই সবখানে রহিম করিম ছিলো। তাদের গল্প ছিলো। তারা আমার যুক্তিবিদ্যার বইতেও ছিলো। উচ্চমাধ্যমিকে লজিক শেখার তুমুল আয়োজন, দুনিয়া যুক্তিতর্কে জিতিয়ে দেবো ভাবনা, কোথায় এসে আটকে যেত যেন।
রহিম হয় মরণশীল
করিম হয় মরণশীল
সব মানুষ হয় মরণশীল।
আমার মা আমাকে প্রথম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন তখন। বলো তো কোথায় ভুল? কোথায় আটকে যাচ্ছো, কেন থমকে যাচ্ছো? আমি জানলাম বুঝলাম, আমাকে শেখানো হচ্ছে, আমরা শিখছি যে রহিম করিম মানুষ শুধু আর কেউ নয়। আমি বুঝলাম কোথায় ভুল। আমার রহিম করিমের জন্য মন খারাপ হলো। কত দায়িত্ব তাদের, চাপিয়ে দেয়া, কেড়ে নেয়া, নিজের খুঁজে পাওয়া। তারাই মানুষ, তারাই মরণশীল। আমি বুঝলাম, আমি কোথাও নেই, আমরা নেই কোথাও।
আমার তো গল্প বলা কাজ। তাই আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, দুলে দুলে, রহিম করিমের কয়েকটা গল্প শোনাই বরং আজ। এ গল্প আমাদের সবার জানা। কিন্তু পুরোনো গল্পের সমাপ্তি লেখা হচ্ছেনা যে, নতুন গল্প পাই কোথায়? নতুন করে পুরোনো কিছু গল্প বলি। রহিম করিমের গল্প আর আমাদের গল্প। ওদের গল্পও। আর এ গল্পের শেষ কেমন হবে, সে দায়িত্ব সবার জন্য ছেড়ে যাচ্ছি।
গল্প-১ ঈদ আসলে সেই যে এক চর্বিতচর্বন কৌতুক, কার্টুনে একসময় ভেসে যেত সংবাদপত্র আর এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মনে পড়ে? মোটাসোটা দুলদুলে আমরা হেঁটে যাচ্ছি, পিছে ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত রহিম করিমেরা শপিং ব্যাগ ভর্তি হাতে আমাদের পেছন পেছন আসছে। সেই ব্যাগ ভর্তি শুধু আমাদের কেনাকাটা। সব বোনাসের টাকা শেষ রহিম করিমের, আমাদের শপিংয়ের পেছনে। কী কষ্ট তাদের। কে আঁকতো সে ছবি? কে বলতো সে গল্প? আমরা? না তো, আমাদের গল্প, কিন্তু আমরা বলিনি তো। এই যে যুগ যুগ ধরে রহিম করিমের এ শোষিত জীবনের এবং আমাদের এমন শুষে নেয়া লোভী দাপুটে জীবনের ব্যঙ্গচিত্র সবার বিনোদনের অংশ হতো। কিন্তু আমাদের কি একবার ও বলতে ইচ্ছে করেনি যে গল্পটা অন্যরকমও হয়? আমরা নতুন করে গল্প লিখিনি কেন? আঁকিনি কেন নতুন চিত্র – যেখানে ঈদের সবার শেষের আনন্দের ভাগটুকু নিয়েছে আমাদের মা, তাঁর মা, তাঁর মা।
পাড়ার মোড়ে মোড়ে রহিম করিম যখন ঈদের চাঁদ দেখেছে, তখন রান্নাঘরের উনুন তাপে, গোলাপ জলের সুবাস মেখে দিয়ে, কিশমিশ আর দুধ জ্বাল দিয়ে হাড়ি ভরেছে কারা? উত্তর তো আমরা জানি তবু এই গল্পের শেষ তো অন্যরকম করে আমরা লিখিনি। গল্পটা বদলাতেও তো চাইনি।
গল্প-২ আমার সেলিনা আপার কথা খুব মনে পড়ছে। ওই যে সেলিনা আপা, আমরা সবাই চিনি, আমাদের সবার জীবনে অমন সেলিনা আপা আছে। কোনো রহিমের স্ত্রী, কিংবা করিমের মা – সেলিনা আপা। আমাদের জাতের একজন। উনার নেশার গল্প মনে পড়লো। ক্ষমতার নেশা। ওই যে সেই কোন এক ঈদের রাতে হাড়িভরে ক্ষমতার সুঘ্রাণ মাখিয়ে পায়েস পোলাও রেঁধেছে। তার বদলে জিতেছে সেই খেতাব – আমার বৌ সব জানে/আমার মা সব জানে। সেই খেতাবে মোহ আছে, ক্ষমতার দম্ভ আছে। হাড়িতে, ধূলোতে, কোনাতে, বাড়িতে সেই ক্ষমতার দখল নিতে নিতে ক্লান্ত যখন সেলিনা আপা, ফিরবার তো আর উপায় নেই। সেলিনা আপা বয়সের ভারে, ক্ষমতার ভারে দিন শেষে মচকাচ্ছে, ভাঙছেও, তবু ছাড়ছেনা। ক্ষমতা আর তলশূন্য বায়বীয় খেতাবের লোভ। সেলিনা আপার ছেলে মেয়ের বড্ড ক্ষোভ। মা তো আর পারছেনা। তবু করছে, মানছেনা। আর সে মানতে না পাড়ার অশান্তি শোবার ঘর থেকে খাওয়ার টেবিল ভনভন করছে, বিরক্তিকর মাছির মতন।
তবু কেন নতুন খেতাব তৈরি হলোনা যে – আমার বর সব জানে/ আমার বাবা সব জানে, রহিম করিম সব জানে? ক্ষমতা আর খেতাবের যে টোপ তৈরি হয়েছে, তাতে আটকে পরে সেলিনা আপার ছটফটে জীবনে অভ্যস্ততা, কাউকে ক্ষমতা ছেড়ে না দিতে পারার খেলা, সে গল্প পাল্টাবে কবে? সে গল্পের শেষ কেমন হবে? কে লিখবে? রহিম করিমেরা কবে সব জানবে?
গল্প-৩ আমার বন্ধু তন্বী বেচারা আছে মহা বিপদে। আমাকে বলে, ‘‘শোন আমার তো ‘আর কেনো’ বলতে বলতে জীবন কেটে গেলো?’’
আমি বলি, ‘‘আর কেনো?’’
তন্বী বোঝায়, ‘‘এই আর হলো ইংরেজি R”
আমি ভুরু নাচাই, ‘‘মানে কী?”
উত্তর দেয়, মানে হলো, ‘‘R কেনো” এই প্রশ্ন করতে করতে, এবং R কেটে দিতে দিতে জীবন পার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
ভেঙেই বলি, হয়েছে কি, তন্বী এ সমাজের নিয়মে একটু ঝামেলা তৈরি করে একা বাস করে। ঝরঝরে একা। তো এখন সে ডাক্তারের কাছে যাক, কিংবা এয়ারপোর্ট, দাপ্তরিক কাজে, কিংবা কেনাকাটা করতে, দিব্যি সবাই নামের আগে Mrs. বসিয়ে দেয়।
তন্বী বলে, দেখ একবার জিজ্ঞেসও তো করে না। সেই Mrs. এর R কেটে কেটে Ms. করতে করতে জীবন কেটে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা ফর্মে কি বিচ্ছিরি কাটাকুটি।
হুম, রহিম করিমের নামে এমন কোনো ঝামেলা নেই কিন্তু। R ঠিক জায়গায় আছে, তখন এখন সবসময় – Mr.। যাক, তারা মানুষ, মরণশীল, এক নামের মানুষ। কিন্তু এই যে বদলে যাওয়া এতো নাম, R কাটাকুটির গল্প আমাদের, তা বদলে দেবার গল্প কে লিখবে?
গল্প-৪ শাহানার গল্প বলি। নতুন অফিসে কাজ শুরু করেছে। অফিস থেকে মিটিংয়ে যাচ্ছিল সেদিন, পাশের ঘরে তিনজন সহকর্মী বসে আড্ডা দিচ্ছেন বেশ। শাহানাকে দেখিয়ে ফিসফিস, ‘‘এই দেখো শাড়ী পরে সেজেগুজে বসের সাথে মিটিংয়ে যায়। এমন করেই তো …” শাহানা সেই ফিসফিস শুনে ফেলেছিল।
শাহানা আমাকে বলেছিলো, “ভাবছি, আমার বস একজন মেয়ে। যারা আড্ডা দিচ্ছিলেন প্রত্যেকে মেয়ে। তারা এমন করে বললো?”
আমার তো খুব দুঃখ দুঃখ বোধ হলো, নাহ, শাহানার জন্য না। তার ওই তিন সহকর্মীর জন্য। বেচারারা, কেমন ভূত হয়ে সমাজে ঝুলছেন। রহিম করিমের ভূত।
আমি বললাম, “উনাদের বুঝি মিটিংয়ে গেলেই শুধু সাজতে হয়?”
শাহানা উত্তর দেয়, “উনারা ভাবেন, আমি বোধহয় সাজগোজ করি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু আমি তো নিজেকে ভালোবাসি অনেক, তাই মিটিং, মিটিংহীন দিনে যখন আমি আমার মতন রয়ে যাই হাসিমুখে পরিপাটি, তারা পিটপিট করে তাকিয়ে থাকেন শুধু।”
আমি বলি, “শোন মেয়ে, রহিম করিমের গল্পে তোমার নিজেকে ভালোবাসার ব্যাপারে বোধহয় মানা করা আছে। ভালোবাসলেই কিন্তু পাখা গজাবে সাবধান। রহিম করিমের গল্পে এসব চলবেনা।”
আমার কিন্তু আবারও রহিম করিমের জন্য বড্ড মায়া হলো। তারাও যে সেজেগুজে শার্ট স্যুট টাই প্যান্ট পারফিউমে ফুরফুর করেন, কেউ তাদের একবার ও বলেনা, “কী হে, কাকে খুশি করতে এতো সাজলে?” আহারে।
রহিম করিমের এ করুণ গল্পের শেষ বদলাবে কে?
গল্প-৫ আচ্ছা, সেই ওই জোকটা মনে পড়লো। আমি প্রায়ই বলি। অনেকদিন পর কারো সাথে দেখা হলে অন্য দেশে বলে, “কেমন আছো?” আর আমাদের দেশে বলি, “এমন মোটা হলে কবে? ইসস।”
রহিম করিমকেও এ প্রশ্ন করা হয়। এতটুকুই। ব্যাস বাকিটুকু আমাদের ভাগে পরে। আমাদের স্থূল শরীরের ভাঁজ নিয়ে অযাচিত অশ্লীল মন্তব্য। এই গল্পের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার আছে। কেউ বলবে, “কোন রেশনের ভাত খাও?”, “স্বামীর বাড়ির খাবারে তো খুব স্বাদ, এতো মোটা হয়েছো!”
আমার সেই দেশবাড়ির এক খালা, নিঃসন্তান, এক দাওয়াতে গেলেন। কোনো এক কারণে ওজন বেড়েছে খানিকটা তার। দাওয়াত থেকে ফিরলেন কাঁদতে কাঁদতে। রহিম করিমের ভূতেরা ঘুরে ঘুরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খালাকে বললো, “বাহ, কয় মাস? অবশেষে তোমার জীবনের গতি হলো।” খালা হেঁচকি তুলে কেঁদেকেটে ফিরে আসলেন।
সমাজের বেঁধে দেয়া নিয়ম, একটি বিয়ে, সন্তান, তারপর তারপর, চাপিয়ে দেয়া অন্যের গল্প আমাদের সবার কাঁধে। সিন্দাবাদের ভূত হয়ে ঝুলছে। সবার গল্প যে আলাদা এবং সত্য, সেই গল্প লিখবে কে?
গল্প-৬ পাঠ্যবইয়ের কথা মনে আছে? রহিম করিমেরা টেবিলে পড়ছে, আর তাদের বোন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। গল্পটা এমনই ছিল, এমনই আছে, খোলস বদলেছে খানিকটা সময়ের ধারায়। তবুও তো, এখনো একজন লেখিকা কেন লেখক নয়, তর্ক চলছে। অধ্যাপক আর অধ্যাপিকার মোটাদাগের পার্থক্য, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকার বিভাজন চলছেই। বারবার ভাগ হয়ে যাচ্ছে তাদের সম্মান আর ধরণের স্থান। মিডিয়াতে রান্নার অনুষ্ঠানে, এখনো রহিম করিমেরা সেফ, আর আমরা তো রাঁধুনি। আর ওই যে কৃষকের সাথে সমানতালে ফসল ফলাচ্ছে ক্ষেতে যিনি, ঘাম-তাপ-বর্ষা আর ত্যাগে যিনি সমান, এখনো তাকে কৃষকের বউই তো বলি। রহিম করিম কৃষক আর তাদের বৌ। কৃষাণী বলে যে শব্দ আছে, তা সাহিত্য বা কবিতাতে মাঝে মাঝে শোভা বাড়ায়। এইটুকুই, খুঁজতে গেলে সেই শব্দের অর্থ ওই – কৃষকের বৌ। আফসোস।
আমাদের কৃষক হয়ে ওঠার গল্পটুকু কে লিখব? মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প কবে শুরু হবে?
গল্প-৭ শেষ করি নতুন টাটকা গল্প দিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই ফেলা কোনো খবর প্রকাশ পেলে, তার শেষের যে মন্তব্যগুলো থাকে সেগুলো পড়েছেন? সেখানে আছে বিদ্বেষ ক্ষোভ রাগ। রহিম করিম কিংবা আমরা সবাই এ ক্ষোভের শিকার হই। কিন্তু মন দিয়ে খেয়াল করে দেখবেন, রহিম করিমদের বিরুদ্ধে দুই ধরণের গালি ছুড়ে দেয়া হয় – চরিত্রহীন কিংবা দুর্নীতিবাজ। দুটো গালিই ক্ষমতাজনিত। আর একটু বেশি মাত্রার ক্ষোভ হলে রহিম করিমের মায়েদের উদ্দেশ্যে চলে গালি। আর আমাদের জন্য? সেই গালি এবং কটুশব্দ সাজানোর জন্য পুরো একটি বই দরকার যে।
কলতলা থেকে সাহিত্যাঙ্গন শুরু হয় একই গালি দিয়ে- রক্ষিতা, তারপর চলতে থাকে। আমাদের ভেঙে মুচড়ে ফেলতে হলে যতদূর যাওয়া যায় তার চেয়েও বেশি। আর এখন তো নতুন হাল ফ্যাশনের এক গালি এসেছে বাজারে। যারা গেঁয়ো গালি দিয়ে মুখ নষ্ট করতে চাননা, তারা এ গালিটি দেন – ফেমিনিস্ট।
আমি আমার এক ছেলেবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের জন্য মাত্র দুই-তিনটি গালি, আমাদের জন্য এক বই সমান কেন? আমার বন্ধুর সরল সোজা উত্তর আমার খুব পছন্দ হয়েছিল, বলেছিল, “আমরা রহিম করিম এবং তাদের ভূতেরা তোমাদের জন্য প্রতিদিন গালি সৃষ্টি করি। তোমরা করোনা কেন আমাদের জন্য?”
আমরাও করি, আমরাও গালি দেই, আঘাত করি। প্রায় প্রতি ছুটির দিনেই আমার এক প্রতিবেশীর বাসা থেকে এক তিরতিরে শিশু কণ্ঠের গুমড়ানো আর্তনাদ ভেসে আসে। বেদম প্রহারের আওয়াজ পাই। প্রতিদিনের সাধারণ ঘটনা, এক নারী যিনি বাড়ির প্রধান, গৃহকর্মী শিশুটিকে মারছে। সাথে সুর মিলিয়ে যে গালি চলে তা নিয়েই আমরা বেঁচে আছি – ফকিরনী, চাষা, গরিবের বাচ্চা, পঙ্গু, ছোটলোক ইত্যাদি ইত্যদি।
রহিম করিমের গল্পে আমরা হারছি প্রতিদিন। আমরাও হারিয়ে দিচ্ছি, আঘাত করছি ওদের, যাদেরকে আমরা দুর্বল ভাবি।
কে লিখবে গল্পের শেষটুকু? ওরা, আমরা, নাকি, রহিম করিমেরা! কেমন হবে আমাদের গল্পের শেষটুকু?