November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বঙ্গদেশে নারী-পুরুষ বনাম প্রভু-দাসীর জীবন

নুরনবী ইসলাম।। কবিতা সাহিত্যে নারী এখানে স্বর্গের দেবী কিংবা মহাপুরুষের প্রেরণা। বাস্তবে নারী কেবলই অর্ধাঙ্গিনী, ভোগ্যপণ্য, দাসী অথবা শোষণযোগ্য বস্তু। বিবাহ এখানে দাসপ্রথার আরেক রূপ। বিয়ে করে পুরুষেরা (পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষ) একটি মাংসপিণ্ডে গড়া শরীর ক্রয় করে। এই ক্রয়-বিক্রয়ে থাকে দাবিদাওয়া, লাভ-ক্ষতির হিসাব নিকাশ। লাভ-ক্ষতির হিসাবটা শুরু হয় পাত্রী দেখার দিন থেকে কিন্তু চলতে থাকে সমস্ত জীবনব্যাপী।দাসী বুঝে নিয়ে তারা আবার এই দাসীর সাথে অন্যের দাসীর মাপজোক করে তুলাদণ্ডে। মাপজোক করে দেখে ধনে, বর্ণে, গুণে কে বেশি লাভবান হলো।

লাভ-ক্ষতির হিসাবটা বুঝে নেওয়ার পর শুরু হয় দাসীবৃত্তির দিনযাপন। উচ্চবৃত্তের ঘরে অবশ্য এই দাসীবৃত্তির ব্যাপারটা খুব বেশি গুরুত্ববহ নয়। কারণ দাসী এরা যেকোনো সময় ক্রয় করতে পারে। তাই এদের অর্ধাঙ্গিণীরা মূলত সন্তান জন্মদান, লালন-পালন ও প্রভুর (পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন) হুকুম পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। মধ্যবিত্তের ঘরে সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, প্রভুর হুকুম পালনের পাশাপাশি প্রভুগৃহের নানা ঝামেলা গ্রহণ করতে হয় দাসীর কাঁধে। সন্তান যদি হয় বখাটে দাসীর সহ্য করতে হয় ভিন্ন মাত্রার যন্ত্রণা। প্রভুর নিকট করতে হয় জবাবদিহি। নিম্নবৃত্তের দাসীর ক্ষেত্রে এই জবাবদিহির ব্যাপারটা তেমন নাই। খুব বেশি লেখাপড়া এদের কপালে জোটে না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একেবারেই জোটে না।

প্রভু ও দাসী দুজনকেই সমান পরিশ্রম করতে হয় নিম্নবৃত্তের সংসারে। তবুও দেখা যায় প্রভুর (পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্বামী) মর্যাদার কোন কমতি থাকে না দাসীর কাছে। যেমন ধরুন প্রভু রিকশা চালায় বা কোন মিস্ত্রীর কাজ করে আর প্রভুর দাসী অন্যের বাড়ির কাজ করে বা ইট ভাঙ্গার কাজ করে। এখন দিনশেষে যখন তারা বাড়ি ফেরে তখন দেখা যায় প্রভুর দাসী প্রথমেই ঢুকে রান্নাঘরে প্রভুর জন্য খাবার তৈরি করতে। অথচ দুজনেই কিন্তু দিনভর সমান পরিশ্রমই করেছে। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যাই হোক, নারী ঘরে কাজ করুক বা বাইরে, প্রভুর থেকে বেশি কাজ করুক বা কম, তার মর্যাদা প্রভুর থেকে কম। কিছু কিছু নারী যারা স্বপ্রনোদিত হয়ে এই দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় তারা আবার বাঁধাগ্রস্থ হয় সমাজ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পুরুষতন্ত্রের দ্বারা। পুরুষতান্ত্রিক প্রভুত্বে গড়া এই সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে বেরিয়ে নারীরা যেদিন নারী থেকে মানুষে পরিণত হবে সেদিনই তাদের মুক্তি মিলবে।

নারী শব্দটার সাথে সমাজ আমাদের এমন ভাবে পরিচয় করে দিয়েছে যে এই শব্দটা উচ্চারণ করলেই আমরা ভাবি দুর্বল, অবলা,পুরুষতন্ত্রের পাঁজরের হাড়ে তৈরি একটি অবয়ব। যাকে খরিদ করা যায়, রক্ষিতা রাখা যায়, নির্যাতন করা যায়, বল প্রয়োগ করা যায়। যাকে ছুঁয়ে দিলে অপবিত্র হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হলো পণ্য বা সম্পত্তি। তাকে ভোগ করা যায় অযত্নে অবহেলায় ফেলেও রাখা যায়।

পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে রয়েছে ভয়ংকর রকম নারীবিদ্বেষ। নারীকে নিয়ে এদের একটি বদ্ধমূল ধারণা নারী ছলনাময়ী, নারী পিশাচিনী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে প্রচণ্ড রকম ভয় পায় তাই তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েও এই পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল অক্ষুণ্ণ রাখে। তারা প্রচার প্রচারণা চালায় নারী অভিশপ্ত। একটি নারী চাইলে অসংখ্য পুরুষকে নরকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তাই নারীকে তারা ঘরে আবদ্ধ করে, ঢেকে রাখে বিশাল পোশাকের অন্তরালে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে কখনোই তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে দেয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে দেওয়া হলেও, বিয়ের পূর্বে নারীর এই সিদ্ধান্তগুলো যাচাই-বাচাই ও অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করে তার বাবা আর বিয়ের পর সিদ্ধান্তগুলো যাচাই-বাচাই ও অনুমোদনের দায়িত্ব পালন করে তার স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই প্রভুরা আবার বলে আমরা নারীকে স্বাধীনতা দিচ্ছি। খেয়াল করে দেখুন এইখানেও তাদের প্রভুত্ব বজায় আছে। তারা বলছে আমরা স্বাধীনতা দিচ্ছি।

তারা স্বাধীনতা দেওয়ার কে? প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে মুক্ত, স্বাধীন। কেউ কারো অধীনস্ত নয়। তাই স্বাধীনতা কারো দান করার বিষয় নয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে এমনভাবে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে যে নারীরা এখানে দাসত্ব করে নিজেদের অসম্মানিত বোধ করে না। বরং তাদের মধ্যে থেকে যে সকল নারী এই দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় তাদেরকেই এরা ঘৃণা করে। অর্থাৎ নারী নিজেই এই দাসত্বের জন্য অনেকখানি দায়ী।

এবার প্রভুদের নিয়ে কিছু বলি। এই প্রভুরাও কিন্তু দাস। তারাও দাসত্ব করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। তারাও ভাঙ্গতে পারে না এই পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খল। যারা ভাঙ্গতে চায় সমাজের চোখে তারা হয়ে ওঠে ঘৃণ্য, কাপুরুষ। এই ধরণের পুরুষদের বন্ধুমহল, কর্মস্থল, আত্মীয় স্বজন ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে আত্মমর্যাদাহীনভাবে চলতে হয়।মোটকথা পুরুষেরাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাস। পুরুষেরাও চাইলে তার নিজের মতো করে চলতে পারে না, বলতে পারে না নিজের আবেগ অনুভূতির কথা। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের আবেগ থাকতে নেই। তাই আমাদেরও হাঁটতে হবে মুক্তির পথে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলে কুঠার আঘাত করে ভাঙ্গতে হবে এক্ষুনি। যত বেশি কালক্ষেপণ হবে তত বেশি সংখ্যক নারী নিগৃহীত হবে, নির্যাতিত হবে, ধর্ষিত হবে পুরুষতন্ত্রের হাতে।

আমাদের দেশে এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। কিন্তু কই তাতে কি ধর্ষণের পরিমাণ কমেছে? না, কমে নাই। ধর্ষককে একবার নয় পাঁচবার করে মৃত্যুদণ্ড দিলেও ধর্ষণ বন্ধ হবে না। ধর্ষণ বন্ধ করতে চাইলে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজটাকে ভাঙ্গতে হবে, গড়তে হবে সমতার সমাজ। জ্বালতে হবে শিক্ষার আলো, নিভাতে হবে কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নারীবিদ্বেষের অশুভ আগুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]