September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পান-বরজের কান্না  

আবরার শাহ্।। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় খাসিয়া নামের একান্ত প্রান্তিক আদিবাসীদের বসবাস। কয়েকটা পুঞ্জিতে বিভক্ত হয়ে একান্নবর্তী সংসার। দিনে আনে দিনে খায় প্রবাদটিও লজ্জা পায় ওদের জীবনযাপনের হতশ্রী দশায়। কেননা এশিয়ার সর্বোচ্চ জিডিপিধারীর দেশেও পান চাষই ওদের একমাত্র আয়ের অবলম্বন। দুই বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে সবেধন নীলমনি পান বেঁচে। তীব্র ঝাঁজালো এই খাসিয়া পানের ভালো কদর আছে সিলেট অঞ্চলে। বহুবর্ষজীবী পান-বরজগুলোই ওদের কাছে অন্নদাতা যেন। বিশেষ পদ্ধতিতে করা এই পান-জুমের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল একটা জনগোষ্ঠী — একথা ভাবতে অবাক লাগলেও এই সত্য। তারচেয়ে গভীর সত্য হলো পাহাড় ও সমতল কোথাও ভালো নেই খাসিয়া, গারো, কোচ, মারমা কিংবা লুসাইরা। যুক্তির নিরিখে এই বাক্যটা প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে, তবে বেশিদূর নয়, গত পনের দিনের ঘটনার উপর চোখ বোলালেই হবে।

করোনার অভিঘাতে অক্সিজেন সংকটে দেশ যখন মুমূর্ষু তখনই দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আবুল খায়ের গ্রুপ এগিয়ে এলো অক্সিজেন নিয়ে। তাদের প্ল্যান্টে উৎপাদিত যাবতীয় অক্সিজেন দেশের মানুষের জন্য সরবরাহের ঘোষণা দিলো। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হল সে খবর আর প্রশংসা ও স্তবগানে ফুল চন্দন পড়লো আবুল খায়েরের মুখে। অথচ ক’দিন পর ঠিকই মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখল মনুষ্যত্বসম্পন্ন দেশবাসী। এই আবুল খায়ের গ্রুপই চেলা-চামুণ্ডা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (!) সহযোগিতায় হামলা চালালো সীতাকুণ্ডের রোগ-বালাই, অশিক্ষা ও দারিদ্র্যে জর্জরিত ত্রিপুরা পাড়ায়। তাদের ভিটেমাটি দখল করে বাস্তুচ্যুত করে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করাই যার লক্ষ্য! অথচ ফুল চন্দনে ঢেকে থাকা আবুল খায়েরের মুখে নেটিজেন কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠরা চুনকালি মাখার বদলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলো!

সীতাকুণ্ড থেকে ট্রেনে চেপে মধুপুরের শালবনে যাওয়া যাক এবার। তার আগে শালবন না বলে বরঞ্চ বলি ‘একদা শালবনে’, ৬২’তে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করার পর থেকেই মূলত যা অরক্ষিত হয়ে গেছে এবং পৃথিবীর অন্যতম পাতাঝরা বন খুব দ্রুতই রূপান্তর লাভ করছে ইউক্যালিপটাস, পলাশ, শিমুল, আগর, কাজুবাদামসহ লালমাটির অনুপযুক্ত সব গাছগাছড়ায়। বন সাফ করে ইতোমধ্যে হয়েছে পিকনিক জোন, হ্যালিপ্যাড, স্যানিটোরিয়াম। সম্প্রতি বন বিভাগের রেস্ট হাউজ নির্মাণের জন্য মধুপুর গড়ের ভূমিসন্তান মান্দিদের আদি ধর্ম সাংসারেকের অনুসারীদের শতাব্দী প্রাচীন গোরস্থানে সীমান্ত দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হলো। অর্থাৎ বন রক্ষার নামে বন বিভাগ আপনার ঘর দখলের পরে দখলোৎসব শুরু করলো আপনার বাপ-দাদার গোরস্থানেও।

এবার বড়লেখার খাসিয়া পুঞ্জিতে ফেরা যাক।

স্থানীয় একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দুদিন আগে কেটে দিয়েছে খাসিয়াদের একমাত্র অবলম্বন পানবরজের পানগাছগুলো। নামগুলো ধরুন রহিম মিয়া, হারেচ, মজিবর। বড়লেখার সীমান্তবর্তী জনপদের হলেও রক্তের ধারা যাদের মেঘনার মতো আগ্রাসী, আধিপত্যকামী। স্টেরিওটাইপ বাঙালির রক্তে যেরকম চোরাগোপ্তা সাম্প্রদায়িকতা ও দখলকামী মনোভাব কাজ করে আর কি। কারণ ওই পুরনোই — চোখ লাল করে ভূমি দখল করতে পারলেই কেল্লাফতে। সহজেই দেশান্তরি হবে আদিবাসীরা আর দখলের জায়গা ভরে উঠবে ইউক্যালিপটাস নামের বিষ-বনায়নে কিংবা বন উজাড় করে নগদ নারায়ণের মতো অন্য কোন অর্থকরী ব্যবসায়। যেরকম হয়েছে-হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিংবা মধুপুরে কিংবা দিনাজপুরে কিংবা হবে সীতাকুণ্ড কিংবা গড়ে তোলা যাবে একরের পর একর রাবার বাগান।

তো কথা হলো আয়-রোজগারের একমাত্র উৎস হারানো খাসিয়ারা এখন কোথায় যাবে? মহাশক্তিধর জনগোষ্ঠীর বিপরীতে খুঁটির জোর না থাকা প্রান্তিক খাসিয়ারা কিভাবে ভরণপোষণ করবে আত্মীয়-স্বজন-পরিজনের? নাকি শুধু গান-কবিতা-নাটক কিংবা মনু নদীতেই বয়ে যাবে খাসিয়াদের মর্মন্তুদ আর্তনাদের দিনলিপি?

পানের রসে ঠোঁঠ-লাল করা রসিক বাঙালির হাত আর কত লাল হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রক্তে?

ফুটনোট: এসব নিয়ে লিখে কী হবে? লিখে কী আসলে? কিছু হয়? কিছুই হয় না। তাই আর লিখতেও ইচ্ছে করে না।কিন্তু তারপরও আমাদের লিখে যেতে হবে, প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে সর্বহারার পক্ষে। শিরদাঁড়া উঁচু রেখে বজ্রমুষ্ঠি হানতে হবে শোষকের পাষাণ-বুকে।তাতেও যদি গলে জগদ্দল-হৃদয়ের পাষাণ-পাঁজর।

আবরার শাহ্ : শিক্ষার্থী,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]