November 24, 2024
কলামফিচার ৩

মানসিক স্বাস্থ্য: সচেতনতার সঙ্গে চাই সুলভ চিকিৎসা সুবিধা

সৈয়দা ফেরদৌস আহমেদ।। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটাই যেন লজ্জার। আবার যারা নানা মানসিক সমস্যা বা অসুখে ভোগেন তাদের প্রতি বাঁকা দৃষ্টি দেয়া প্রচলিত এক নিয়ম। ২০১৯ সালে ৯৯৯ এর লিগ্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে (তৃতীয় পক্ষ) একটা প্রকল্প নিয়ে আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন বেশ কিছু কেস হ্যান্ডেল করতে হয় আমাদের, একদম অ্যামেচার কেয়ারগিভার হিসেবে। যদিও আমাদের মূল দায়িত্ব ছিল বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ ও ক্ষেত্রবিশেষে ভিক্টিমের হয়ে মামলা চালানো, কিন্তু আমরা দেখেছি শুধুমাত্র মানসিক অবসাদে আক্রান্ত কিংবা পুরো সুস্থ সবল একজন মানুষকেও জোর করে মানসিক রোগি বানিয়ে হাসপাতালে রাখতে।

যেহেতু আমরা কাজ করছিলাম লিগ্যাল সার্ভিস নিয়ে, তাই ক্লায়েন্ট ডিলিং আইনগতভাবে করতে পারলেও বাধা হয়ে আসে এই মানসিক সমস্যা নিয়ে আসা কেসগুলো। আমরা নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে কেয়ার গিভারের কাজ করতে গিয়ে যখন নিজেরাই ট্রমাটাইজড হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন বেশ কটা অনলাইন কনসালট্যান্সি ফার্মের সাথে যোগাযোগ করি, যেন তারা আমাদের টিমসহ যারা ভিক্টিম তাদেরকে বিনামূল্যে এই সেবাটা প্রদান করে অথবা একদম নামমাত্র মূল্যে সেবাটা দেয়। দু’একজনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তিও করি সেবার মান নিশ্চিত করতে এবং ভিক্টিমকে সুস্থ রাখতে। কিন্তু প্রজেক্ট ফেল করে কারণ তাদের উচ্চ চার্জ দেওয়ার ক্ষমতা না ছিল আমাদের, না ছিল তাদের যাদের জরুরি প্রয়োজনে এই সেবার আওতায় আনা দরকার বলে আমরা রেফার করতাম ।

বিশেষজ্ঞ সেবা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ এবং এর আর্থিক পরিমানও বেশি; কিন্তু আমাদের দেখা কেসগুলোতে বেশিরভাগই দেখা যেত তাদেরকে তাৎক্ষনিকভাবে কষ্ট থেকে ডাইভার্ট করতে পারলে এবং এরপর যথারীতি কাউন্সিলিং কার্যক্রম চালাতে পারলে তারা সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু যে ভিক্টিমের এই নূন্যতম চার্জ দেয়ার সক্ষমতা নাই, অন্যদিকে যারা তার কনসালটেন্সি করবে ঘণ্টা দেড় দুই লাগিয়ে বা পরবর্তীতে আরো সময় নিয়ে, তারাও তো তা একদম বিনামূল্যে করতে পারবে না। এখন দেখা যাক কেন ও কী কারণে এই সেবাটা অবহেলিত হয়ে আছে আমাদের কাছে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা বা এটাও শারীরিক অন্যান্য রোগের মতনই যে একটা রোগ এবং এর জন্য আমাদের যে সেবা নেয়া প্রয়োজন এটাই আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত হয় নাই, বরং এটাকে নিয়ে সকল রকম কুসংস্কার যুক্ত আলোচনা আছে যা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। প্রচলিত মতে কেউ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হলে তার একদম চরমে যখন তিনি পৌঁছায় তখন তাকে সেবা নিতে হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হয় আর পারিপার্শ্বিক লোকজন মানে নিজ পরিবার থেকেও ব্যক্তিটিকে ‘পাগল’ উপাধি দিতে দ্বিধা করে না, যা প্রায় প্রতিটি কেস স্টাডিতেই পাওয়া যায়।

কেবলমাত্র এই ট্যাবু, লোকলাজের ভয় এবং সেবার চার্জ বা ফি রোগির ক্ষমতার বাইরে থাকায় আমাদের দেশের শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ, যাদের এই সেবার আওতায় আসা উচিত, তারা এই সেবা থেকে বঞ্চিত বা দূরে আছেন। বরং মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ থেকেও রোগি তার সম্মান বা পরিবারের বাঁচাতে অথবা পারিপার্শ্বিক চাপে স্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য হয় এবং বেঁচে থাকার এক তীব্র লড়াই ভিতর থেকে চালিয়ে যায়। কিন্তু একটা সময় যখন এই অবসাদগ্রস্ত মনোভাব চরমে পৌঁছে যায় মূলত জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, অন্যের অত্যাচার-অবহেলায় কোনঠাসা হয়ে পিঠ ঠেকে যায়, তখনই তাদের মাঝে দেখা যায় আত্মহত্যার প্রবণতা বা আত্মহত্যার ভিতরই তারা শান্তি খুঁজে পেতে চায়।

আত্মহত্যা বা মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির যে কোন একটা কেস নিয়ে স্টাডি করলে দেখা যাবে এর পিছনে পারিবারিক অহিংস মনোভাব, টানাপোড়েন, নৈতিকতার অবক্ষয়, ব্যর্থতা, হতাশা এবং বিভিন্ন কটুবাক্য ব্যয়ে হতাশ হতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন, ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন- এগুলোই সবচেয়ে বেশি দায়ী। আর একটা তাজা প্রাণ চলে যাওয়ার পর আমরা এটা নিয়ে কথা বলা শুরু করি, যতটা না বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে তারচে বেশি কেয়ার গিভার বা উঠতি কেয়ার গিভারদের কাছ থেকে।

যদিও এই মুহুর্তে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে জোড় আলোচনাটাই মূখ্য বিষয় কারণ এই সেবাটা কেবল নির্দিষ্ট কোনো বয়সে সীমাবদ্ধ না বরং শিশু, কিশোর কিশোরী, প্রাপ্তবয়স্ক সবার প্রয়োজন, তাই এটার সচেতনতার স্বার্থে যত বেশি আলোচনা হবে ততই এটা ফলপ্রসূ হবে। তবে সমস্যা সৃষ্টি হয় যখন একজন কেয়ার গিভার হয়ে একজন বিশেষজ্ঞের মতন চিকিৎসা দেয়া শুরু করি আমরা। এই সমস্যাটা নিয়ে পরবর্তী ধাপে আলোচনা করব বলে এখানে কেবল তুলে আনছি আমাদের দেশে কত শতাংশ মানুষ এই সেবাটি নিতে পারছে বা পারছেনা। যদি না পারে তাহলে এরকম একটা সেনসেটিভ বিষয়ে কেন আমরা তার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পারছিনা।

২০১৮-১৯ এর মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায় বাংলাদেশের ১৮.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৩ শতাংশ শিশু কিশোর এই সমস্যার ভিতর রয়েছে। যার মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষ কোনো সেবা গ্রহণ করে না, আর বাকি যে ৮ শতাংশ মানুষ এই সেবা গ্রহণ করে তারা একদম শেষ মুহূর্তে পৌঁছে এই মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সাথে শারীরিকসহ আরো নানাবিধ অসুস্থতার সেবা একত্রে গ্রহণ করে বা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। যার ফলে পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ পড়ে এবং তারা এক সময় মাঝপথে এটা থেকে সরে যায়, যা পরবর্তীতে ভয়ানক রূপ নেয়, এমনকি  মৃত্যুমুখেও ঠেলে দেয় রোগিকে।

এখন কথা হলো, যেখানে  একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে থাকার পরও তার সেবা নিতে পারে না বা কাউকে বুঝাতে পারে না তার আসলে এই সেবাটির ভীষণ দরকার সেখানে শিশু বা কিশোর কিশোরীদের জন্য এই সেবা নিশ্চিত করা হবে বা তারা পাবে এটা আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটের বাইরে। আমাদের দেশের এত বেশি সংখ্যক শিশু কিশোর কেন মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত তার একটা জরিপ যা ইউএনডিপি চালায় ২০১৩ সালে তাদের পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর, সেখানে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর ভিতর ৯ জন শিশুই তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে নানারকম শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কীভাবে আমরা আশা করব যে, তারা কোন শিক্ষার্থী কোন নেতিবাচক মানসকিতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তা আইডেন্টিফাই করে তার পরিবারকে জানাবে বা স্কুল কলেজ থেকেই তাকে কাউন্সিলিং করাবে? অথচ একটা শিশু বা টিনএজ অতিক্রম করা একজন ছাত্র/ছাত্রীর এই সময়টাতে এরকম অনেক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় যা সে বাবা মা বা কাছের কাউকে না বরং তৃতীয় কোন পন্থায় কারো কাছে তার অবসাদ ব্যক্ত করতে চায়, এবং এর ভিতর শতকরা ৭৫ ভাগই তাদের মনোভাব ব্যক্ত করতে পারলে বা নিয়মিত কিছু সাধারণ কাউন্সিলিং পেলে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে যায়। অথচ আমরা সেটা দিতে অপারগ এবং দিন শেষে আরো একজন মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি আমাদের সংখ্যায় যুক্ত হতে হতে এটার সংখ্যা বেড়ে চলে।

অন্যদিকে প্রাপ্ত বয়স্ক যারা মানসিক অবসাদের শিকার, তারা সাধারণ কাউন্সিলিং যে নেবে বা নেয়া যায় তার সঠিক তথ্য উপাত্তও জানে না। একে তো সরকারি বা বেসরকারি দুইভাবেই এই সেবার সেক্টর একদমই কম, আবার আমাদের মোট জনসংখ্যার ১৭% মতান্তরে ১৮.৫% বা ২-২.৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যারা নানা ধরণের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তাদের ভিতর দেখা যায় প্রতি ১০০ জনের ভিতর ৭ জন বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যাকে আমরা “মন খারাপ” আচরণে আখ্যায়িত করে থাকি এবং এই বিষন্নতা দীর্ঘ মেয়াদি হলেই এক সময় তা সহনীয় পর্যায় ছাড়ায়। একটু সিনারিওটা খেয়াল করলেই দেখা যায় এতবড় জনসংখ্যার এতগুলো মানুষ তথা প্রতি দুই লাখের জন্য বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র একজন (০১) চিকিৎসক। যার ভিতর এই বিশাল সংখ্যক মানুষ জানেই না তারা এই সেবা নিতে আদতে কার কাছে যাবেন এবং খরচ কত পড়বে।

আমাদের দেশে এই রোগের রোগিদের কোন সঠিক তথ্য উপাত্ত কোথাও সেভাবে নাই,  আর যে কয়টা জরিপ আছে তারও নাই কোন হালনাগাদ। তবে আমরা যদি ইউরোপের পরিচালিত গবেষণার দিকে তাকাই (উইকিপিডিয়া সূত্র অবলম্বনে) তাহলে দেখা যায় তাদের প্রতি দশ (১০) জনে একজন (০১) বছরের কোনো না কোনো সময় কোনো একটি  মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণায় দেখা যায় তাদের প্রতি তিন (০৩) জনে একজন (০১) বছরের কোনো না কোনো সময় মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সেদিক দিয়ে আমাদের দেশের অবস্থানটা একটু চিন্তা করলেই বের হয়ে আসবে কী ভয়াবহ রূপ হতে পারে!

শেষ অব্দি বলতে চাই, প্রয়োজন জোর সচেতনতা, স্কুল কলেজ, চিকিৎসালয়, অফিস আদালত থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং এটা যে একটা রোগ এবং এর সঠিক চিকিৎসা নিলে সহসাই পরিত্রাণ পাওয়া যায় তা সকলকে জানাতে হবে। সেই সাথে এই সেবার মান ও চার্জ  নিয়ন্ত্রণে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।যদিও মানসিক স্বাস্থ্য  আইন-২০১৮ তে এ ব্যপারে বিস্তর বর্ণনা আছে কিন্তু আমরা এর সঠিক প্রয়োগ চাই। চাই এটা সবার সামর্থ্যের ভিতর থাকুক, চাই কেবল শহর নয় বরং গ্রাম অঞ্চলেরও প্রতিটা মানুষ এ সম্পর্কে জানুক এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখুক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]