‘সম্মান’ শব্দটিও যেন ধর্ম বর্ণ শ্রেণি বা লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার না হয়
উপমা মাহবুব ।। ‘বড়দের সম্মান করে কথা বলবে’ বা ‘বাবা মাকে সব সময় সম্মান করবে’ – আমাদের সংস্কৃতিতে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের এই নীতিবাক্যগুলো শেখানো হয়। ‘অমুককে পাড়ার সবাই খুব সম্মান করে’, ‘ছেলেটা বেয়াদব, মুরুব্বিদের সম্মান করে না’ – এ রকম মন্তব্যের সঙ্গেও আমরা কমবেশি পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো, ‘সম্মান’ শব্দটা শুনলে আমাদের, মানে বাঙালিদের কেন যেন – বাবা মা, মুরুব্বি, শিক্ষক, গুরুজন – এই শব্দগুলোই মনে আসে। কখনোই একজন কৃষককের কথা মনে হয় না যিনি ফসল ফলিয়ে আমাদের খাদ্যসংস্থান করছেন। একজন যৌনকর্মী বা একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও যে সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন, এই ধারণার সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই অপরিচিত। আমাদের মাথার ভেতর কে যেন সবসময় বলে, যৌনকর্মী মানেই খারাপ মেয়েমানুষ, আর প্রতিবন্ধীরা তো পাগল, তাদের আবার কিসের সম্মান!
ভাবতেই অবাক লাগে, শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রতিটি মানুষকেই সম্মান করতে হবে, ‘সম্মান’কে বর্ণ, লিঙ্গ, পেশা ইত্যাদি অনুযায়ী কমবেশি প্রদর্শন করা যাবে না – এরকম একটা গুরুত্বপূর্ন নৈতিক শিক্ষা কেমন করে আমাদের জীবনাচরণ থেকে বাদ পড়ে গেল? আসলে জাতি হিসেবে আমরা বর্ণবাদী। আমরা কাকে সম্মান করবো আর কাকে করবো না সেটাও এই বর্ণবাদের উপরই নির্ভর করে। মহেশ গল্প পড়ে গফুরের জন্য আমাদের মন কাঁদে, কিন্তু বাস্তব জীবনে শহুরে মানুষের কাছে গ্রামের প্রান্তিক কৃষকরা গাইয়া ভুত, ছোটলোকের জাত। আমার বান্ধবীদের কেউ বিরক্ত করলে তার হাত পা ভেঙ্গে দেব, এই কথা বলা ছেলেটিকেও আমি অপরিচিত আদিবাসী মেয়ের দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। তাকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করতে শুনেছি। বলবেই বা না কেন? বর্ণবাদ তো ছোটকাল থেকে আমাদের শিরায় শিরায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আদিবাসীরা সাপ-ব্যাঙ খায়, ওরা জংলী – শৈশবে আমাদের এমনটাই শেখানো হয়েছিল। অতএব, কালচারড বাঙালি পুরুষ আনকালচারড আদিবাসী নারীকে যৌনদাসী বানানোর স্বপ্ন দেখবে, এটাইতো স্বাভাবিক!
গল্পের ছলে আমরা – জানেন ভাবী, অমুক ভাইয়ের ছেলেটা না পাগল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়ে এ রকম মন্তব্য করতে ভালোবাসি। এই ‘পাগল’ শব্দটার মধ্যে কতটা অসম্মান লুকিয়ে আছে তা বোঝে এ রকম বাঙালির সংখ্যা খুব কম। এদেশে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কমবেশি সবাই সেলিব্রেটি নারীদের গনিমতের মাল মনে করে। তাদের কোনো ব্যক্তিগত জীবন থাকতে নেই। এটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হয় যে মানুষ সারাক্ষণ সেলিব্রেটি নারীর পোশাক, জীবনাচরণ নিয়ে আলোচনা করবে। তাদের নতুন স্ক্যান্ডাল আর ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার আশায় থাকবে। কারণ আমাদের ধারনা, সেলিব্রেটি নারী মানেই তারা যখন-তখন যার-তার সঙ্গে শুয়ে পড়ে। অথচ এই চিন্তার মধ্যে নিজের মনের কী পরিমাণ দৈনতা আর অপরের প্রতি প্রবল অসম্মান প্রকাশ পায়, তা নিয়ে কয়জন বাঙালি চিন্তা করেন?
এখানেই শেষ নয়। তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামী, যৌনকর্মী – ইত্যাদি কিছু শব্দ আছে যেগুলো শুনলে আমাদের ঘৃণা প্রকাশ করাই লাগে। তাদেরকে কেন যেন মানুষ বলেই মনে হয় না। ‘ডিহিউমেনাইজেশন’ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা কনসেপ্ট। একটি জাতিকে মানুষ বলে মনে না করার মানসিকতা থেকেই হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিলেন। সেই ইহুদীরা আজকে ফিলিস্তিনিদের মানুষ বলে মনে করছে না। তাই তারাও নির্বিচারে শিশু থেকে বৃদ্ধকে হত্যা করছে। তারা মনে করছে তারা ফিলিস্তিনীদের খুন করছে, মানুষ খুন করছে না। অতএব, এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধও কাজ করে না। মানুষ হিসেবে সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়, ওরা হীন, ঘৃণ্য, নোংরা – এ রকম ধারণা এভাবেই দানা বাধতে বাধতে একসময় এক জাতির মনে অন্য জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়। যার পরিণতিও হয় ভয়াবহ। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্ম অবমাননার নামে মন্দিরে হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সবখানেই অপরকে সম্মান প্রাপ্তির অযোগ্য বলে মনে করা, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করার মানসিকতাকে ব্যবহার করে রায়টকে উস্কে দেয়া হয়েছে। কোনো বিশেষ পেশা, জীবনাচরণ আপনার ভালো না লাগতেই পারে, আপনার ধর্ম অনুযায়ী নিষিদ্ধও হতে পারে, কিন্তু তারপরও একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান প্রদর্শন করেই আপনাকে কথা বলতে হবে। আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমরা কাউকে তার প্রাপ্য ‘সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার’ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি না। এটি বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের চরম লঙ্ঘন।
এগুলোতো হলো জাতীয় পর্যায়ের ঘটনা। আমাদের নিজেদের বাড়িতেই যথাযথ সম্মান না দেওয়ায় কত পরিজন গুমরে মরছে, তার খবর আমরা কজন রাখি। ভালোবেসে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো অপরাধ হলে, তাতে ছেলেমেয়ে দুজনই অপরাধী হওয়ার কথা। অথচ এ দেশে সমাজ-সংজ্ঞায়িত ‘চরিত্রবান’ ও ‘সতী’ নারীর সম্মান আছে। কিন্তু তথাকথিত ‘চরিত্র’ নষ্ট হলে মনে করা হয় সেই নারী নিজের এবং পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে এনেছেন। মানুষের নোংরা কথার চাপে মেয়েটির জীবন ঝালাপালা হয়। কখনও কখনও আত্মহত্যা করে সে মুক্তি খুঁজে নেয়। পুরুষটি কিন্তু ঠিকই বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়। পুরুষদের জন্য কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো ছোটখাট ভুল, পুরুষ হয়ে জন্মালে তারা একটু সুযোগ খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক, এর জন্য তাকে অসম্মানিত করার কিছু নেই! এটাও ঠিক যে দেশের আইন অনুযায়ী কোনো নারীকে ধর্ষণ করলে ধর্ষকের গ্রেপ্তার হওয়ার বা শাস্তি প্রাপ্তির ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীকে এবং তার পরিবারকে সমাজে কতটুকু অসম্মানিত হতে হয় আর ধর্ষণকারী পুরুষটি এবং তার পরিবারকে কতটুকু অসম্মানিত হতে হয়, তার তুলনা করলেই বোঝা যায় এদেশে ‘সম্মান’ মোটেও সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রদর্শন করা হয় না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলেও আপনাকে নিয়ে সমালোচনা, হাসাহাসি, ট্রল করা হতে পারে। আপনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বন্ধু পরিচয় দিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে যান, দেখবেন আপনার পরিবার ও আশেপাশের মানুষ কিভাবে রিঅ্যাক্ট করে। সম্প্রতি বাংলাদেশের দুজন অন্যতম গুণি শিল্পী মিথিলা ও তাহসান একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বাঙালি জাতিকে চমকে দিয়েছেন৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে একই অনুষ্ঠানে প্রাক্তন স্বামী ও স্ত্রী অতিথি হিসেবে হাজির হওয়ার ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম। তারা যে শুধু সেই কাজটি করেছেন তাই নয়, অনুষ্ঠানটিতে তারা বলেছেন, ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরও তারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং একে অপরকে সম্মান করেন। প্রাক্তন স্বামী ও স্ত্রী সবসময় একজন অপরজনকে ঘৃণা করবেন, মুখ দেখাদেখি করবেন না, এই চিন্তাধারা আমাদের মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। ফলে তাহসান-মিথিলাকেও এই ঘটনার জন্য সমালোচনা ও ট্রলের শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী হওয়ায় যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ ‘অসম্মানিত’ করার চেষ্টা মিথিলাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। এটাও ঠিক যে আস্তে আস্তে বাঙ্গালির মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে। একসঙ্গে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া এবং পরস্পরের প্রতি পাবলিকলি সম্মান প্রদর্শন করায় তাহসান ও মিথিলা প্রচুর প্রশংসিতও হয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী উপস্থাপিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। পাঠ্যবইতে ‘আদিবাসী’ বিষয়ক টেক্সটগুলোতে এখন আগের চেয়ে বর্ণবৈষম্য অনেক কমে গেছে। এই সাফল্য নিঃসন্দেহে সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাদের। দীর্ঘ সময় ধরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভেদে সকল মানুষের অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠায় তারা নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারপরও শুধু পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য, শিক্ষক বা এলাকার মুরুব্বিকে সম্মান করার কনসেপ্ট থেকে বেড়িয়ে এসে, ‘প্রতিটি মানুষকে সম্মান করতে হবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, অবস্থান, পেশা কোনকিছু ভেদেই কাউকে ছোট বা হেয় করা যাবে না’ – এই নীতিবাক্যকে গ্রহণ করা এবং তার বাস্তবায়ন ঘটানোর দিক দিয়ে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। পুরনো এই বৈষম্যমূলক ধ্যান ধারণাগুলো দ্রত ঝেড়ে ফেলতে না পারলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়বো।
অর্থনীতির চাকা যতই জোরে ঘুরুক না কেন, মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়ার ক্ষেত্রে বাছাবাছি করাটা মোটেও উন্নত জাতির লক্ষণ নয়। তাই আমাদের নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সকল মানুষকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। পরিবর্তন তো আসছেই, তবে তার গতিকে আরও অনেক বাড়াতে হবে। আরেকজনকে সম্মান দিলে সেই সম্মান আমার কাছেই ফিরে আসবে – এই একটি কথা মনে রাখার মধ্যে দিয়ে আজকে থেকেই তাই আসুন সকল মানুষকে সম্মান করার চর্চা শুরু করি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]