December 3, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

আর্তুর র‍্যাঁবোর নিগারেরা

সাদিয়া মেহজাবিন ।। সুনীলের হাত ধরে র‍্যাঁবোর সাথে পরিচয়। ছবির দেশে কবিতার দেশে ভ্রমণ উপন্যাসে এক অন্য র‍্যাঁবোকে হয়তো আমি দেখেছিলাম। বিচক্ষণতায় র‍্যাঁবোর সে পরিচয় কতদূর আঁচ করতে পেরেছি, আমি জানি না। তবে দোজখে এক মরশুম আমাকে অন্য এক ভাবনায় নিয়ে যায়। সাহিত্যপ্রিয় আমার বন্ধু আমাকে উপহার হিসেবে দেয় দোজখে এক মরশুম, হোসেন মোফাজ্জলের অনুবাদে নতুন ভাবনায় মগ্ন হতে সাহায্য করে। নিগারের ধারণা আমার আমিকে প্রশ্ন করে। দোজখে এক মরশুম বই থেকে নিগারের ধারণার কিছু রূপ তুলে ধরছি।

নিগাররা হচ্ছে তারা যারা কোনো টাকা বানাতে পারে না কারণ তারা কোনো কাজ করে না, করতে চায় না, করবেও না। পুঁজিবাদ যাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত সমাজের হানিকর নাম হচ্ছে অনুৎপাদনশীল এবং উৎপাদনবিরুদ্ধ লোকজন যার মধ্যে রয়েছে মিসকিন, নিগার, উদ্ভট, নাবালক। কিন্তু র‍্যাঁবো তার চেয়ে আরও বেশি দূরে এগিয়ে গিয়েছেন কারণ তিনি দেখেছেন সফল পুঁজিবাদের আদিরূপ নিগারের থেকে কম নিয়ন্ত্রিত না। বিচারপতি, জেনারেল, ব্যবসায়ী এরা সকলে হচ্ছে নকল নিগারের দল, শিল্পীর মত এরাও পুঁজিবাদের অদম্য কঠোরতায় নিয়ন্ত্রিত। তাদের অবস্থান এভাবেই এমন একটা সরল সত্যকে সংজ্ঞায়িত করে সেটা হলো কেউবা বেশি টাকা কামাচ্ছেন, কেউবা কম আবার কেউবা কিছুই কামাচ্ছেন না।

এই সমস্ত ভাবনা থেকে আমি কিছু নিজের ভাবনার সমীকরণ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কেননা নিগার নিয়ে যে সাধারণ ভাবনা আমাদের ছিল তা এই উত্তর আধুনিক যুগে এসে খাপ খাচ্ছে না কারণ পুঁজিবাদের যে কাঠামোতে আমরা সাপের জালের মত পেঁচিয়ে গিয়েছি তার থেকে বের হওয়া সহজ না, তবে অসম্ভব নয় তাও সত্য।

নিগারের ব্যসিক ভাবনায় ছিল নিগাররা উৎপাদনবিরুদ্ধ। তবে আমার প্রশ্ন তারা কি সৃষ্টিশীলও নয়? আমার মুক্ত ভাবনা বলে তারা নিশ্চিত সৃষ্টিশীল। কিন্তু র‍্যাঁবোর ভাবনা আমাকে নতুন করে ভাবায়। র‍্যাঁবোর নকল নিগারের ধারণা আমার বা আমাদের বর্তমান অবস্থার সাথে পরিপূর্ণ মিলে যায় কেননা আমাদের পুঁজিবাদের শীর্ষে যে নিগারেরা বসে আছে তারা ঘুষ, খুন এবং অন্যায় অবিচার করতে গিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে তারা নিতান্তই সৃষ্টিশীল নয় সাথে তাদের দ্বারা ভালো কিছু উৎপাদন হচ্ছে না বরং পুঁজিবাদের শক্ত যে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ছিল তা আরো মজবুত হচ্ছে।

আলাপে একদিন পুঁজিবাদের ধারণা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার শিক্ষক মহোদয়কে বলছিলাম স্যার পুঁজিবাদের ধারণাকে নতুন করে এনে শোষণমুক্ত কিছু করা যায় কিনা। নতুন যেকোনো কিছুই ভালো। স্যারের উত্তর আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। পুঁজিবাদ তো নতুন কিছু নয়। বরং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই আধুনিক। যাই হোক র‍্যাঁবোর পুঁজিবাদের নকল নিগারের ধারণা আমাকে প্রশ্নের জালে বন্দী করে। ধরুন, এই যে ইউএনও’র দেওয়া আদেশ, ধর্ষণের সুষ্ঠ বিচার, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে ন্যায্য কথা না বলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মিত ছুটি সবই যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই নকল নিগারের যেন রূপ। বলে রাখা ভালো র‍্যাঁবো কিন্তু সেই কবি বা গুরু যিনি একদা ফ্যাসাদ উদ্রেককারী কবিতা দিয়ে নতুন আর্ট ফর্মের সুচনা করেন। তিনি তার লেখার কোনো মূল্যায়ন না পেয়ে সব ছেড়ে, লেখা সাহিত্যে আগুন দিয়ে চলে যান ব্যবসা করতে। ফড়িয়া হয়ে ঘোরেন অনেক সময়। পরে আত্মহনন করেন এবং  ইতি ঘটান সফল নিগারের।

র‍্যাঁবোর মতো আমাদের সমাজেও লুকিয়ে আছে সফল নিগার। যারা নকল নিগারের  চেয়েও বেশি সৃষ্টিশীল কিন্তু পুঁজিবাদের লোহার চেয়েও শক্ত কাঠামোর যাতাকলে পিষে আত্নহনন করেন। আমরা চাইলেও তাদের খুঁজে পাই না। ইতিহাসের পাতা থেকে তারা বাদ পড়েছেন অনেক আগেই।

র‍্যাঁবোর ভাবনায় ডুবতে গিয়ে আমার হাংরি আন্দোলনের বই নির্বাচিত হাংরি কবিতার সম্পাদকের কিছু ভাবনার সমীকরণ মাথায় আসে। যেমন ধরুন তিনি বললেন, আমাদের বেশিরভাগ শব্দই পুরুষতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী, বর্ণবাদী। কালো হাত, কালো টাকা, কালো পতাকা ইত্যাদি শব্দগুলো বেশি বর্ণবাদী কেননা কালো রংকেই খারাপ বা বেআইনী হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তাছাড়া এই শব্দগুলো পুঁজিবাদেরও জন্ম দেয়। রঙ ফর্সাকারী সাবু শপ তার শ্রেষ্ঠ উদাহারণ। আমি জানি না আমার ভাবনা প্রাসঙ্গিক কি না তবে এটা সত্য র‍্যাঁবোর নিগারেরা যেমন আছেন, তাদের চাইলেও মুছে ফেলা যায় না তেমন নকল নিগারেও ভরপুর এই সমাজ। যারা আমাদের ভালো থাকার অন্তরায়। র‍্যাঁবোর হাত ধরেই বলি, মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব টিকে থাকে টাকা বানাতে পারা কিংবা না পারায়। মানে পুঁজিবাদ গোগ্রাসে গিলে ফেলছে মূলত মধ্যবিত্তদের। কারণ তাদের আমাদের কোনো আলাপের দরকার নেই। টিকে থাকার লড়াই যেখানে তুঙ্গে। র‍্যাঁবোর মতে, মনের রোগ হচ্ছে একধরণের পূতপবিত্র ব্যপার। অর্থাৎ বিরোধিতা বাদ দিয়ে বিদ্রোহকে ন্যায্য মনে করা।

বরং আপনারাই নিজেদের সমীকরণ মিলিয়ে বের করুন র‍্যাঁবোর নিগারদের। যেখানে শান্তি সৃষ্টি ভালোবাসার মূল্যায়ন তুঙ্গে। র‍্যাঁবো, সুনীল, বন্ধু, শিক্ষক প্রত্যেককেই শ্রদ্ধা।