অন্যায়ের প্রতিবাদই মূখ্য, পরীমণি ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিল্টি
প্রিয়া দেব।। কিছুদিন ধরে জোর আলোচনা চলছে, চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণিকে নিয়ে। তিনি অভিযোগ করেছেন, তাকে হত্যা এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সে ঘটনা বলেছেন। এরপর তাকে যে নয় মিলিয়ন মানুষ ফলো করেন তারা তার কমেন্ট বক্সে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, শতকরা ৮০ ভাগ কমেন্টে পরীমণিকে কেন ধর্ষণ করা উচিত, পরীমণির লাইফস্টাইল কেমন, পরীমণি কেমন কাপড় করেন, সে হিসেবের উপর ভিত্তি করে তার ধর্ষণের শিকার হওয়াই উচিত এমন ধারণা রেখেছে লোকজন। আমাদের দেশের নারীদের জন্য সেটা খুব স্বাভাবিক, জাতি হিসেবে আমরা কোনো নারী ধর্ষণ হলে প্রথমেই সে নারীর চরিত্র নিয়ে পড়ি।
সে যাহোক, পরীমণির এ ঘটনার পর বহু মানুষ মানবিকতার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করেছেন, তারা পরীমণি যাতে সঠিক বিচার পান, তার পাশাপাশি একটা বড় আলোচনা করেছেন এই ৮০ ভাগ নোংরা কমেন্টগুলো নিয়ে। তারপর চারদিকে পরীকে নিয়ে আলোচনা জোরেশোরে চলছে, পরীমণি অলস বাঙালিকে বহুদিন পর একটি সময় কাটানোর উপায় দেখিয়ে দিয়েছেন। তাকে নিয়ে ট্রলের বন্যা বইছে, তার ক্রন্দনরত ছবি নতুন নতুন মিমের জন্ম দিচ্ছে, মিম লাভাররা সেসব শেয়ার দিয়ে আনন্দ নিচ্ছেন। তার উপর তার নানারকম পুরনো অপ্রীতিকর কর্মকাণ্ডের ভিডিও শেয়ার হচ্ছে। পরীমণি এদেশের একজন জনপ্রিয় নায়িকা, জনপ্রিয় না হলে বিরানব্বই লাখ মানুষ তাকে অনুসরণ করতো না, তার তারকাখ্যাতি আছে। তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, এরকম জীবন যাপন বহু উঠতি নায়িকাই করেন। পরীমণি এই বিলাসবহুল জীবনের পরও গরীব মানুষদের সাহায্য করেন। তার মতো বহু নায়িকা বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও এরকম চ্যারিটি করতে আমি কাউকে দেখিনি। হয়তো পরীমণি তার এই সহায়তার খবর জোরেশোরে প্রচারনা করেন বলেই আমরা আম জনতা সেসব জানি, কিন্তু এদেশে এক মগ চাল দিয়েও বহু ক্ষমতাবান ব্যক্তি বিশাল প্রচারণা করেন। পরীমণি যখন তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তখন বিরাট একটা অংশ তার এই অবস্থা নিয়ে নোংরামো করেছেন। কিন্তু কিছু সংখ্যক মানুষ পরীমণির হয়ে কথা বলেছেন, পরীমণি তাদের আত্মীয় বন্ধু না, তারপরও তারা সঠিক বিচার চেয়েছেন, তারা কমেন্ট বক্সের উগ্র মানসিকতার মানুষগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কারণ তারা জানেন এ দেশের বিচার ব্যবস্থা দুর্বল, এদেশে ধর্ষক খুনিরা সমাদৃত হোন আর ভিকটিমকে চরম নোংরা পরিস্থিতির মধ্যে বাঁচতে হয়, এ মানুষগুলো শুধু পরীমণির পাশে দাঁড়ানোর জন্য কথা বলেননি, তারা তাবৎ ভবিষ্যৎ ধর্ষক সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন।
এর পরের অবস্থা ভয়াবহ। পরীমণির জীবন যাপন পদ্ধতি এবং তিনি বারে গিয়ে কী করেন সেসব ফুটেজ ব্যবহার করে এখন প্রতিবাদ করা মানুষগুলোকে নিয়ে নানারকম খোঁচানো চলছে, একেকজনের প্রশ্ন করার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে ‘‘পরীমনি তো এরকম করে, তারপরও নীতিবানরা কেন তার পাশে দাঁড়ায়?”
ওনাদের সাধারণ জ্ঞানে এটা ঢোকে না যে একজন মানুষের আচরন যতোই খারাপ হোক, তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা, নির্যাতন করার চেষ্টা সবসময়ই অপরাধ। পরীমণির জন্য সুবিচার চেয়েছেন ক্ষুদ্র কিছু মানুষ, তারা কিন্তু কোনো বায়াসড বিচার চাননি। তারা বলেননি বিচার পরীমনির পক্ষেই যেতে হবে, তারা চেয়েছেন পরীমণি বিচার চাইছেন যেহেতু, তিনি যেন বিচার পান।
সেটাই আসল কথা, একজন বিচারপ্রার্থীকে যেন তার ন্যায্য বিচার দেওয়া হয়। সে বিচার সুষ্ঠু হয়ে যদি প্রমাণ হয় বিচারপ্রার্থী নিজেই দোষী, সেটা কখনোই ওই প্রতিবাদ করা মানুষগুলোর দোষ না। কারণ তারা নায়িকা পরীমণির পাশে দাঁড়াননি, তারা পরীমণির প্রতি হওয়া নির্দিষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এ অন্যায় যার প্রতিই হোক না কেন মানুষের উচিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, কারণ এ প্রতিবাদ জরুরি। আজকে এই প্রতিবাদ না হলে ৮০ শতাংশ মন্তব্যকারী মনে করবে তারা যা ভাবছে তা ঠিক। তারা ভাববে কাপড়ের জন্য, নায়িকা হবার জন্য, কারো বাসায় মদ খুঁজে পাবার জন্য, রাত করে বাসায় ফেরার জন্য যেকোনো মেয়েকে ধর্ষণ করা জায়েজ।
কয়েকদিন আগে যে গার্মেন্টস কর্মী কাজ শেষে রাতের বাসে করে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, তখনও এই নোংরা শ্রেণি বলেছিল- এতো রাতে বের হলে ধর্ষণ তো হবেই। এই মানুষগুলো কখনো প্রশ্ন করবে না একটা মেয়েকে একলা পেলেই ধর্ষণ কেন করতে হবে? আজকে এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুললে সমাজ বদলাবে না। এদের চুলকানি বাড়বে, এরা আজকে রাত করে বাসায় ফেরার জন্য ধর্ষণ করা জায়েজ বলছে, কালকে বলবে ঘর থেকে বের হলেই ধর্ষণ জায়েজ। এদের থেকে আমরা কেউ নিরাপদ না, আজকে আমি রাতের বাসে বাসায় ফিরতে যে ভয়টা পাই সে ভয়ের উৎপত্তিস্থল এই মানুষগুলোর নোংরা মস্তিষ্ক। তাই এদের থামানোর জন্য আপনার আমার কথা বলা জরুরি, অন্যায় যার সাথেই হোক না কেন, কথা বলা জরুরি। আবার পরীমণিকে নিয়ে কথা বললেই একদল এসে বলবেন “একজন আলেম হারিয়ে গেলো সেটা নিয়ে কথা বলেন না কেন”, এই কম্পারিজম একটা নোংরা কম্পারিজম, একজন ভিকটিম নিয়ে কথা বলা হচ্ছে বলে সে আরেকজন নিয়েও বলছে কিনা এ নিয়ে খোঁচানো কোনো যুক্তির কথা না। আওয়াজ সবার জন্যই তোলা উচিত, কিন্তু একজনের জন্য তোলেনি বলে যে আরেকজনের জন্য তোলা যাবেনা, এটা নোংরা একটা ধারনা।
পৃথিবীতে হাজারটা বাস্তবতার মধ্যে একটা চরম বাস্তবতা হচ্ছে এদেশে মেয়েরা নিরাপদ না, কোনোভাবেই নিরাপদ না। এদেশের একজন নারী হয়ে পরীমণি সাহস করে বিচার চেয়েছেন সেটা প্রশংসার দাবি রাখে। পরীমণির হয়ে যে মানুষগুলো কথা বলছেন, তারা আরো বড় প্রশংসার দাবি রাখেন। এখন যে সুশীলদের মনে হচ্ছে পরীমনি এসব নাটক করছেন তাদের একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে “ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিলটি”। পরীমণিকে নিয়ে আপনাদের কোনো প্রেডিকশন কেউ গিলবে না, প্রমাণের আগ পর্যন্ত পরীমণি একজন বিচারপ্রার্থী নিরপরাধ। আজকে আপনি সেই বিচারপ্রার্থীর পাশে তার পেশা, সে আগে কী কাজ করেছে, সে কেমন কাপড় পরে, এসব ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কিনা সেটাই প্রশ্ন, এর বাইরে গিয়ে যদি আপনি তার জীবনধারা নিয়ে নোংরা কথা বলে শেষে গিয়ে হালকা বিচার চান, সেটা হচ্ছে হিপোক্রেসি। কালকে যদি এটাও প্রমাণ হয় যে পরীমণিই দোষী, তাও তার পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোর লড়াই ভুল হয়ে যায় না, কারণ তারা পরীমনির প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিল, এখানে অন্যায়টাই প্রধান, পরীমনি প্রধান না।
আজকে পরীমণির পাশে দাঁড়ানো মানে আপনি পাওয়ার প্র্যাকটিস করা তাবৎ রাঘব বোয়ালদের ধারণ করা “নারী মানেই ভোগ্যবস্তু” এই ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন, যে রাঘব বোয়ালদের নাম মিডিয়া কখনো বিরাট চাপে না পড়লে নেয় না। কালের কণ্ঠ নামক পত্রিকা পড়ে আছে পরীমণির বাসায় কত বোতল মদ পাওয়া গেছে সেটা নিয়ে, যেন পরীমণির বাসায় মদের বোতল থাকলেই তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা জায়েজ, আবার এই কালের কণ্ঠ একজন বিশিষ্ট খুনিকে মাথায় তুলে রাখে। এখানেই আসলে পার্থক্যটা। তাই আজকে আমরা কোথায় দাঁড়াবো, কার পাশে দাঁড়াবো সেটা যদি না বুঝি তবে কালকের দিনটা আমাদের জন্য নিরাপদ না। সেজন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটাই মূখ্য, আপনি কার জন্য করছেন, সে নিজে দোষী সেটা প্রমাণের পরও যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনি কথা বলেছেন, সেই প্রতিবাদটা মিথ্যা হয়না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]