November 22, 2024
কলামফিচার ৩

পুরুষতান্ত্রিক ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে? আসলেই!

ইমতিয়াজ মাহমুদ।।


এই পোড়ার দেশে ভাল খবর তো আজকাল পাইনা বললেই চলে। আর এখন তো এই মরার করোনা এসে সংবাদ শব্দটির অর্থই যেন দুঃসংবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। এইরকম অবস্থার মধ্যেই খবরটা এসেছে- আমাদের মাননীয় আইনমন্ত্রী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন যে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের প্রস্তাব কিছুদিনের মধ্যেই সংসদে উপস্থাপন করা হবে। কবে আইনমন্ত্রী এটা পার্লামেন্টে নিয়ে যাবেন আর কবে সেটার উপর আলোচনা হবে আর কবে আইন পাশ হবে জানি না। আদৌ এই পরিবর্তনটা আসবে কিনা সেটাও নিশ্চিত হতে পারছি না এখনো। কিন্তু এই যে আইনমন্ত্রী কথাটা বললেন যে তিনি এই পরিবর্তনটা করবেন, আইনের এই বিধানটা বাতিল করবেন, এইটাও আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক বড় সুসংবাদ। কেননা এই পরিবর্তনটা কেবল সাক্ষ্য আইনের একটা ধারার ছোট্ট একটা উপধারার বিলোপ মাত্র নয়। এটা হবে বাংলাদেশের আইন থেকে নারীর প্রতি অবমাননাকর একটি বিধানের অবসান।

সাক্ষ্য আইনের এই বিধানটা কী সেটা আগে দেখে নিই। সাক্ষ্য আইনে সাধারণভাবে একজন সাক্ষীর ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে আদালতে প্রশ্ন করা যায় না। ১৫৫ ধারায় এর কয়েকটি ব্যতিক্রমের বিধান করা হয়েছে যেগুলি দিয়ে সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। এই রকম একটি বিধান হচ্ছে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারা। এই উপধারায় বলা হয়েছে যে যখন একজন পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়, সেখানে আসামিপক্ষ চাইলে দেখাতে পারবে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে একজন অনৈতিক চরিত্রের নারী। মূল আইনটা ইংরেজিতে, ১৮৭২ সনে তৈরি হয়েছে এই আইনটা। ইংরেজিতে আইনটা হচ্ছে, “(4) when a man is prosecuted for rape or an attempt to ravish, it may be shown that the prosecutrix was of generally immoral character.” এই কথাটার অর্থ কি বা তাৎপর্য কী? বাংলায় কথাটা কী হবে সে তো আর বলার দরকার নাই, কিন্তু আইনের এই বিশেষ বিধানটা সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা অংশের প্রতিফলনও বটে।

যখন একজন নারী ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ করেন তখন আপনি সমাজে মুখে মুখে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী দেখতে পান? দেখবেন যে নারীটিকে স্ক্যান্ডালাইজ করা হচ্ছে। ভিক্টিম ব্লেইমিং করা হচ্ছে। শুনতে পাবেন যে চারিদিকে বলা হচ্ছে যে, এটা হচ্ছে নারীটির চালচলনের দোষ – ওর চালচলন খারাপ। সম্প্রতি সিনেমার নায়িকা পরীমণি যখন অভিযোগ করেছে যে তাকে প্রহার করা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনও কি এই রকম হয়নি? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো লোকজন বলেই বেড়াচ্ছে যে এই মেয়ে অত রাতে ক্লাবে কেন গিয়েছে, কেন সে মদ খেয়েছে ইত্যাদি। মূলধারার খবরের কাগজগুলিও নানা রকমভাবে ওকে দোষারোপ করার চেষ্টা করেছে। একটা কাগজে দেখেছি ওর ঘরের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে যে পরীমণির ঘরে সারি সারি মদের বোতল সাজানো। সিনেমার বয়স্ক অভিনেতা, অভিনেতাদের নেতা, ওরাও নানাভাবে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পরীমণিকে নিয়ে মন্দ কথা বলেছে। অনেক নকল আর নিচু রুচির ছবি বানিয়ে খ্যাতিলাভ করেছেন এমন একজন তো দেখলাম খুব করে পরীমণির চরিত্র নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন।


বিশেষভাবে পরীমণির ঘটনার কথা ছাড়াও, সাধারণভাবে একটা কথা আমরা সবসময়ই শুনতে পাই, নারীরা পর্দা করে না বলে ধর্ষণের শিকার হয় বা নারীরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করে বলে ধর্ষণের শিকার হয়। নারীর পোশাকের দোষ, পোশাকের জন্যেই নারীরা ধর্ষণের শিকার হয় এই কথা কি আমরা প্রতিদিনই শুনি না?

এই দৃষ্টিভঙ্গিটা যে মন্দ সে কথা আমরা অনেকেই বলি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে দর্শনটা কী? দর্শনটা হচ্ছে যে, নারী হচ্ছে পুরুষের অধীন একটি বস্তু। পুরুষ হচ্ছে মালিক আর নারী হচ্ছে পুরুষের মালিকানায় একটি বস্তু। নারীটি যখন শিশু থাকে তখন থেকেই তাকে শেখানো হয় যে তুমি হচ্ছ পিতার ঘরে বড় হওয়া পরের আমানত। পিতার দায়িত্ব হচ্ছে এই আমানতকে ঠিকঠাক মতো দেখাশুনা করে বড় করা আর বড় হওয়ার পর তাকে তার প্রকৃত মালিক, অর্থাৎ ওর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া। স্বামী মানে যে আক্ষরিকভাবেই মালিক বা প্রভু সে কথা তো আপনি জানেনই। পিতৃতন্ত্রে এই হচ্ছে নারীর আদর্শ স্থান। পুরুষ স্বামী আর নারী দাসী। পুরুষ মালিক আর নারী দাসী। এইটাই হচ্ছে মূল দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিরই একটা অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে যে, যে নারীর কোনো প্রভু বা মালিক বা স্বামী নেই, সে হচ্ছে পরিত্যাক্ত সম্পত্তি – রাস্তায় পরে থাকা রসগোল্লা। যেন সমাজের সকল পুরুষের জন্যেই সেই নারীকে ভোগ করার অধিকার হয়ে যায়।

একজন নারী যখন এই বিধান মানতে অস্বীকার করে, যখন সে তার নিজের পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হতে চায় তখনও পিতৃতন্ত্র তাকে একই যুক্তিতে একইভাবে চিত্রিত করে। এইজন্যেই দেখবেন যে চূড়ান্ত দক্ষিনপন্থী রক্ষণশীল লোকেরা, এবং ধর্মগুরুরা, ওরা একজন স্বাধীন নারীকে কখনোই সম্মানের চোখে দেখে না। আপনি এর প্রতিফলন দেখবেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মেয়েদের ছবির নিচে ঐসব গালি দেওয়া, ‘এই মেয়ে তোর ওড়না কই’ ধরনের মন্তব্য করা এই সবই হচ্ছে সেই দর্শনেরই প্রবল প্রকাশ। সিনেমায় টেলিভিশনে যারা অভিনয় করেন বা গান করেন বা নাচ করেন, ওদেরকে যে আমাদের সমাজে কী দৃষ্টিতে দেখা হয় সে কথা তো গোপন কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি যে মেয়েটি তার নিজের ইচ্ছামত কাপড় পরে বা ফ্যাশন ট্যাশন করে বা রাস্তাঘাটে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ায় বা ছেলেদের সাথে প্রকাশ্যে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, ওদেরকে যে কী দৃষ্টিতে দেখে ওরা সে কথা তো অজানা কিছু নয়।


আর কোনো নারী যদি বিবাহ বহির্ভূত কোনো সম্পর্কে জড়ায়, তাইলে তো আর কোনো কথাই নাই। বিবাহের আগে একজন নারী তার ছেলেবন্ধুর সাথে শুয়েছে শুনলে দশটা ছেলে লাফিয়ে উঠবে। ওর সাথেই যদি শুতে পারিস বেটি তাইলে আমি কী দোষ করেছি? কথাটা হচ্ছে সমাজের বিধান যদি নারীটি ভঙ্গ করে তাইলেই সে বেশ্যা হয়ে গেল। আর এই যে immoral character বা অনৈতিক চরিত্র কথাটা আইনে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটার অর্থ ও শানে নজুলও হচ্ছে ঐটাই। একজন পুরুষের বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ ওঠে, তাইলে পুরুষটি দেখানোর চেষ্টা করবে যে নারীটির চালচলন ভাল না। চালচলন ভাল না মানে? মানে হচ্ছে যে সে পিতৃতন্ত্রের নির্ধারিত আচরণবিধি মানে না। মানে হচ্ছে যে নারীটি তার নির্ধারিত ভূমিকা অর্থাৎ ‘একজন পুরুষের অধীন একটি ভোগের বস্তু’ এই ভূমিকা নিখুঁতভাবে পালন করেনি।

আর যদি নারীটির চালচলন ঠিক না থাকে অর্থাৎ নারীটি যদি পিতৃতন্ত্র কর্তৃক নির্ধারিত ভূমিকার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রাখে তাইলে কী হবে? তাইলে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোগ করায় কোন দোষ নাই। এইটাই হচ্ছে এই আইনের আসল মতলব। ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করলে, এই আইনের অর্থ হচ্ছে, যে নারীর চালচলন সমাজের নির্ধারিত ভূমিকার সাথে মেলে না, সেই নারীর সম্মতি আছে কি নাই সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কেননা যা নারী তার মালিকের অনুগত নয় বা যার কোনো মালিক নাই, তাকে ভোগ করলে তো কোনো পুরুষের কোনো অপরাধ হচ্ছে না।

ধর্ষণে পুরুষের অপরাধটা কী? পুরুষতন্ত্র ধর্ষণকে কীভাবে দেখে? ধর্ষণকে দেখা হয় যে, ধর্ষক আরেকজনের ভোগের বস্তু নষ্ট করে দিয়েছে। দেখবেন যে সিনেমাতে ধর্ষণের শিকার নায়িকা নায়ককে বলছে, ওগো আমি তো আর তোমার স্পর্শের যোগ্য নেই, ওরা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। অথবা বলে কিনা যে, ওরা তো আমাকে অপবিত্র করে দিয়েছে। এইসব কথা বলে মেয়েটা ফাঁসিতে ঝুলে পড়ে। মানে কী? মানে হচ্ছে যে ধর্ষণের ফলে মেয়েটা আর তার প্রভু বা স্বামীর ভোগের যোগ্য থাকে না, অপবিত্র হয়ে যায়। তাইলে ধর্ষকের অপরাধটা কী দাঁড়ালো? সে আসলে আরেকজন পুরুষের ভোগের বস্তু নষ্ট করে দিয়েছে, এঁটো করে দিয়েছে। আমাদের ভাষায়ও দেখবেন এই চিন্তারই প্রতিফলন, ধর্ষণকে ওরা বলে ‘সম্ভ্রমহানি’ বা ‘ইজ্জৎ নষ্ট করা’ ইত্যাদি। কেন ভাই? অপরাধ করলো ধর্ষক আর নষ্ট হয়ে গেল নারী? মূল ধারনাটা ঐটাই – ধর্ষণ হচ্ছে অপরের ভোগের বস্তু চুরি করার মতো।


পিতৃতান্ত্রিক এই ধারনা থেকেই আইনে এই বিধানটা করা হয়েছে। যদি দেখা যায় যে যিনি ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন তার চরিত্র সমাজের চোখে অনৈতিক, তাইলে তাকে বিশ্বাস করার দরকার নাই। আইনটা সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে করে পুরুষ দেখাতে পারে যে, আরে, এই মেয়েটা তো নষ্টা মেয়ে, ওকে জোর করলে তাতে দোষের কী আছে! আর এই সুযোগে আদালতে নারীটির জীবনে কবে কোথায় কখন কতোটুকু পান থেকে চুন খসেছিল তার চর্চা শুরু হয়ে যায়। এই বিধানের সুযোগ নিয়ে আসামী পক্ষের উকিল সাহেবেরা খুঁড়ে বের করতে থাকেন নারীটি কবে কখন কোথায় কী আচরণ করেছিলেন যেটা সমাজের গজ ফিতার মাপে যথার্থ ছিল না।

আর এর ফলাফল হয় দুইটা। প্রথমত যে নারীটি ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছিলেন, তাকে আদালতের সামনে পারলে যেন বস্ত্রহরণ করা হয় – দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করতে গিয়ে নারীটিকে কী কী সব প্রশ্ন করা হতে পারে সেসব আপনারা অনুমান করতে পারেন। আর দ্বিতীয় ব্যাপার যেটা হয়, ধর্ষণের অভিযোগ প্রসঙ্গে জজ সাহেবের মনে খানিকটা সংশয় তৈরি হয়ে যায়। আপনারা জানেন যে ফৌজদারি মামলা প্রমাণ করতে হয় সন্দেহাতীতভাবে। ন্যূনতম একটু সন্দেহও যদি থাকে, যে অভিযুক্ত লোকটি সম্ভবত বা হয়তো এই অপরাধটি নাও করে থাকতে পারে – তাইলে অপরাধীকে সাজা দেওয়া যায় না। জজ সাহেবের মনে যদি ঐটুকু কণামাত্র সন্দেহও তৈরি করা যায় তাইলে অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় – খালাস। এইজন্যে দেখবেন ধর্ষণ মামলায় বেশিরভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তিই – একশজনের মধ্যে নব্বই জনের চেয়ে বেশি – খালাস পেয়ে যায়।

এই বিধানটি একটি নষ্ট বিধান। কেবল পুরুষতান্ত্রিক বিধান বললে কম বলা হয়, কেননা আমাদের পুরো বিচার ব্যবস্থা, আইনের কাঠামো পুরোটাই তো পুরুষতান্ত্রিক। কিন্তু এর মধ্যেও এই বিধানটি একটি নষ্ট বিধান, মন্দ বিধান। এবং এটা যে মন্দ বিধান এটা আজকের দুনিয়ায় একরকম সর্বজনস্বীকৃত কথা। ইংরেজরা আমাদের জন্যে এই বিধান তৈরি করেছিল, ওদের নিজেদের দেশেও তখন এই আইনটা ছিল। বেশিদিন আগের কথা নয়, আমি যখন আইনের ছাত্র তখনো বিলেতের সাক্ষ্য আইনে এই বিধানটা ছিল। বিশ পঁচিশ বছর আগে ইংরেজরা এই আইনটা বাতিল করেছে। আমাদের পাশের দেশ ভারত, ওরাও এই আইনটা বিলোপ করে দিয়েছে সেও অনেক বছর হয়ে গেছে।


আমাদের এখানে আইন ও সালিশ কেন্দ্র সহ অনেকেই অনেকবার এই আইনটির অন্যায় দিকটি তুলে ধরেছে। গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আদালতে কীভাবে এই আইনের বিধানটি ব্যবহার করে আসামীরা বেরিয়ে যায়। খবরের কাগজে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ মাসের এক তারিখে ডেইলি স্টারে খবর এসেছে, আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন যে এই আইনটা নাকি বাতিল করতে চান ওরা। আইনমন্ত্রী মহোদয়ের কথার উপর ভরসা রাখতে চাই, আশা করছি খুব শিগগিরই এই আইনটি বাতিল হবে। কিন্তু সেই সাথে আশঙ্কাও করি, আমাদের পার্লামেন্টে মেল শভিনিস্ট লোকের অভাব নেই। ওরা হয়তো সহজে এটা ছেড়ে দেবেন না।

সেই জন্যেই আশান্বিত হই, আবার নিশ্চিতও হতে পারি না। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে? আসলেই!

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]