November 3, 2024
সম্পাদকীয়

সেরে যাক নারীর দাসত্বের ব্যামো

শারমিন শামস্ ।।

বহুকাল আগে পশ্চিম ও দক্ষিণ জার্মানিতে, আলসাস ও অন্যান্য জায়গায় একটা প্রথা ছিল। বছরের বিশেষ কয়েকটা দিনে গ্রামের মেয়েদের ছুটি দেয়া হতো। কীসের ছুটি? ছুটি হলো সব গেরস্থালী কাজ থেকেই শুধু নয়, পুরুষের নিত্য দাসী হয়ে থাকবার ভূমিকা থেকেও। ওই কটা দিন মেয়েরা আনন্দ করতো, ওই কটা দিন পুরুষরা তাদের ওপর কোনো অত্যাচার করতে পারতো না। জার্মানির সমাজতান্ত্রিক পণ্ডিত আগস্ট বেবেলের মতে, এই ধরণের প্রথা ছিল মানে হলো ওই গ্রামের লোকগুলোও অনুভব করতো যে মেয়েরা পুরুষদের কতটা দাসত্ব করে, কতটা অধীনে জীবন কাটায়। সেজন্যই বছরের কটা মাত্র দিন নারীকে দাসত্বের কষ্ট ভোলাতে এই প্রথা চালু হয়েছিল।

ঠিক যেন মধ্যযুগের রোমানদের মধ্যে প্রচলিত স্যাটারনালিয়া আর ফ্যাসিং প্রথা। এই প্রথাগুলোও ঠিক এমনি। তবে এক্ষেত্রে রোমান প্রভুরা তাদের দাসদের দুদিনের জন্য মুক্তি দিত। ওই দুদিন ইচ্ছেমতো ফুর্তি করবার পর আবার দাসেরা পরে নিতো দাসত্বের চিরশৃঙ্খল। শুরুতে স্যাটারনালিয়া প্রথাই ছিল। পরে রোমান পোপরা চালু করলেন ফ্যাসিং, জিনিস একই, নাম আর মোড়ক আলাদা আর কি! দুদিনের জায়গায় তিনদিন।

ওই যে দুদিন বা তিনদিনের মুক্তি, দাসেরা সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যেত আর বছরভর অপেক্ষা করে থাকতো বাৎসরিক মুক্তি উৎসবের জন্য। ওই তিনদিনে এত আমোদ আহ্লাদ করতো যে সব শক্তি শেষ হয়ে আসতো দাসদের। তারপর তারা ফিরে যেতো সেই পুরোনো গোলামির শেকল পরতে। এই ক্ষণিক মুক্তির জন্যই তারা কৃতজ্ঞ থাকতো প্রভুদের প্রতি।

জার্মানীর ওই গ্রামাঞ্চলের নারীদেরও তেমনি। ওরাও দুদিনের মুক্তি পেয়ে আনন্দে আটখানা হতো। বেবেল বলছেন, দাস হয়ে থাকা নারী বোঝেই না যে তারা দাস, দাসত্ব অনুভব বা উপলব্ধি করানোটাও বিরাট একটা কষ্টসাধ্য কাজ। নারী জানেই না যে সেও মানুষ, সেও পুরুষের সমান, তারও একই পরিমান অধিকার রয়েছে যা পুরুষের আছে। তাদের কাছে দাস জীবনটাই সঠিক আর স্বাভাবিক। বেবেল এখানে প্রুশিয়ার কৃষকদের উদাহরণ এনেছেন। ১৮০৭ এর পর স্টেইন আইনে প্রুশিয়ার ভূমিদাসদের মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তখন সেই ভূমিদাসরাই দরখাস্ত পেশ করে যে তারা মুক্তি চায় না। কারণ কী? কারণ অসুস্থ আর বৃদ্ধ হলে তাদের কে দেখবে? দাস হলেও মালিক তো তাদের দেখভাল করতো!

নারীর এই দাসত্ব ব্যামোর গল্প বেবেল লিখে গেছেন সেই ১৮৮৩ সালে, (Woman in the past, present and future)। নারীর এই ব্যামো আজো সারেনি। মালিক পুরুষ তার বেশ দেখভাল করে, সেই দেখভালের আরামে অভ্যস্ত নারী আজো শৃঙ্খল মুক্তিকেই ভয় পায়। কে করবে তার দেখভাল? কে তাকে দেখে রাখবে? কে তাকে দেবে নিরাপত্তার আশ্বাস? কে তাকে দেবে ছায়া?

নারীর প্রধান বাধা পুরুষ নয়, পুরুষের ছদ্মবেশে থাকা পুরুষতন্ত্র। সেই পুরুষতন্ত্র আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে যখন নারী তার নিজের ভেতরেই সেটি লালন করে। যখন পুরুষতন্ত্র নারীর দেহ মন আত্মা ও চেতনাকে গড়েপিঠে নেয়, নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সেই নারীর ভেতরে যে মানুষটি বেড়ে ওঠে, সেটি কোনো পূর্ণ মানুষ নয়, সেটি একজন দাস। সেই দাস, যে দাস মনে করে পুরুষ ছাড়া তার বুঝি মুক্তি নেই। পুরুষ ছাড়া তার কোনো গতি নেই। পুরুষ ছাড়া তার মাথার উপরে ছাদ নেই।

উৎপাদনশীল কাজ, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, নিজের ছাদটুকু নিজের কিনে নিতে পারবার সক্ষমতা নারীকে এই দাসত্বের ব্যামো থেকে মুক্তি দিতে পারে। সেজন্য আয় রোজগারের পাশাপাশি নিজের আত্মবিশ্বাস নির্মাণের দায়িত্বও নারীকে নিতে হবে। সচেতন থাকতে হবে যেন কোনো অবস্থাতেই পুরুষের ওপর নিজের নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণের দায় চাপানোর বদভ্যাস না হয়। আর যদি এই নষ্ট অভ্যাস থেকেও থাকে, সেটি থেকে বেরিয়ে আসাটাই মুক্তির একমাত্র পথ।

পুরুষ নারীর মালিক নয়, প্রভু নয়, অভিভাবক নয়। পুরুষ নারীর মতোই আরেকটি মানুষ। পুরুষের সক্ষমতা ও নারীর সক্ষমতা এক ও অভিন্ন। পুরুষ ও নারী রাষ্ট্রের চোখে সমান। এটিই আইন। নারীকে এই সত্যগুলো অনুধাবন করতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের প্রতি এবং সংগ্রাম করতে হবে সমতার লক্ষ্যে, সর্বস্তরে সব ধরণের বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্যে।

জয় হোক নারী ও পুরুষের। বিনাশ হোক পিতৃতন্ত্রের।