পুরুষতান্ত্রিক বাবা সন্তানের মঙ্গল নয়, ক্ষতির কারণ
নন্দিতা সিনহা।। পিতা দুই অক্ষরের একটা শব্দ। কিন্তু এই পিতা মানুষটার ভূমিকা ও প্রভাব একজন সন্তানের জীবনে কিছুমাত্র কম না, অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যাপ্তি জীবনভর। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সংসার ও সন্তান ভরণপোষণের দায়িত্ব প্রধানত পিতার উপরই ন্যস্ত। আর সেই সাথে সংসার ও সন্তান নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও। কিন্তু এই ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে পিতা নামক ব্যক্তিটির দায়িত্ব ও সন্তানের উপর প্রভাব কেমন? এবারের বাবা দিবসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাবাদের নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন ধরনের বার্তা চোখে পড়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগই বাবাদের নিয়ে ইতিবাচক বার্তা লিখেছে। কিন্তু সেই সাথে ছিল বেশকিছু নেতিবাচক কথাও। সেই নেতিবাচক বার্তাগুলো মাথায় রেখে এখন যদি আমরা আমাদের সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বন্ধুমহলের দিকে তাকাই তাহলে বাবাদের নিয়ে এই নেতিবাচক মনোভাবটার কারণ সুস্পষ্টভাবে চোখে পড়ার কথা।
একথা স্বীকার করতে ভালো না লাগলেও আমরা আজন্ম দেখে এসেছি আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সন্তান ও অভিভাবকদের (বিশেষত পিতার) মুখোমুখি দাঁড়ানোর জায়গাগুলোতে সমাজ সবসময়েই সবক্ষেত্রেই পিতাদের অনুকূলে, আর সেটা আইন, নীতি ও মানবিকতার বিপরীতে গিয়ে হলেও। এখানে পিতার প্রতি সমাজের এই পক্ষপাতিত্বের মূল কারণ তিনি পুরুষপিতা, আরেকটি কারণ একটু আগে বলা, সেই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। কিন্তু আদতেই কি পিতা মানে সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল ও মমত্ববোধে পরিপূর্ণ একজন মানুষ? পিতা মানেই কি তিনি সন্তানের প্রতি করা সকল অন্যায় অবিচারের জবাবদিহিতার উর্ধ্বে?
আমাদের সমাজে এখন পর্যন্ত পিতৃতন্ত্র তার সুগভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে, আর এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজও প্রায় সকল ক্ষমতাই পুরুষের হাতে ন্যস্ত। তাই আমি এখানে পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতাধর পিতৃত্বপ্রাপ্ত পুরুষপিতাকেই বিশ্লেষণ করতে চাইছি।
আমাদের এই সমাজে একটি সুবিধাবাদী ও একপাক্ষিক সংস্কৃতি ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, পিতা সন্তানের পক্ষে কখনোই ক্ষতিকর হতে পারেন না, তিনি সবসময়য়েই সন্তানের শুভাকাঙ্ক্ষী, সন্তানের সুখেই নাকি উনারা সুখি হন। প্রচলিত এই বিশ্বাসটা আসলে কতটা নিরীহ ও নিরপেক্ষ সেটা আলোচনার অপেক্ষা রাখে। সমাজের পরিবারগুলোতে দায়িত্ববান সুবিবেচক বন্ধুপরায়ণ পিতা যেমন আছেন, রয়েছেন দায়িত্বজ্ঞানহীন,অবিবেচক, অত্যাচারী পিতাও। আচরণ ও জ্ঞানগত দিক থেকে এই দুই ধরনের মানুষ আলাদা হলেও পিতৃত্বের ক্ষেত্রে উনারা একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আর এই পিতা নাম নিয়েই উনারা নিজেদের তৈরি করে রাখা এই সমাজব্যবস্থায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন আর সেই ক্ষমতার চরম অপব্যবহারও করেন। আর সেখানে থাকে না কারো কাছে কোনো জবাবদিহীতার বালাই। কারণ সমাজব্যবস্থাও যেহেতু সেইসব পুরুষ ও পুরুষপিতাদের সুবিধা অনুযায়ী গড়ে তোলা।
সন্তানের পিতা হিসেবে এই অবিবেক পুরুষতান্ত্রিক পিতারা কতটা ভয়ংকর সেটা সহজে অনুমান করার মতো নয়।উনারা সন্তান জন্ম দেন ঠিকই কিন্তু চিরকাল সন্তানদের পুরোপুরিভাবেই নিজের সম্পত্তি ভেবে থাকেন, ভাবেন সন্তানদের নিয়ন্ত্রণের কলকাঠি উনাদের। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানের বেলায় সেই অধিকারটা আরও শক্তপোক্তভাবেই ফলানো হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই মেয়েসন্তানের মানুষ হিসেবে পাওয়া মানবাধিকারটা পর্যন্ত হরণ করা হয়। কিন্তু তারপরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ নির্লজ্জভাবে সেটাকে স্বাভাবিক চোখেই দেখে থাকে।সন্তানদের (বিশেষ করে মেয়েদের) অবদমিত করে রাখার যে প্রক্রিয়া, সেটা শুরুই হয় এমন সব পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারী নির্যাতক পিতাদের হাত ধরে। যার ফলশ্রুতিতে মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে বিকশিত হতে ও কেরিয়ার নির্বাচনে ভয়াবহ রকমের বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন পিতারা সন্তানের জীবনের সূচনালগ্ন থেকে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত পুরো জীবনটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেন। নিজেদের তৈরি করে রাখা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়াবহতার দোহাই দিয়ে এরা মেয়েদের চলাফেরা থেকে শুরু করে পোশাকআশাক, শিক্ষা, কেরিয়ার, ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত সবকিছুতেই নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেন।
আমাদের পরিবারগুলোতে সেই ছোটকাল থেকে এমনকি ছেলেমেয়েরা সাবালক হওয়ার পরও যে হারে ও যে ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে সেটা একজন মানুষের হতাশাগ্রস্ত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ঠ। এখনকার সংবাদমাধ্যমের উন্নতির বদৌলতে পিতামাতার হাতে সন্তান খুন হওয়া, মায়ের সহায়তায় পিতার দ্বারা কন্যার ধর্ষিত হওয়ার মতো নিকৃষ্টতর ঘটনা আজ আর নতুন নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই পুরুষপিতাদের কাছে নিজেদের ক্ষমতা ও নিজেদের পুরুষসত্তার প্রতি যে আনুগত্য সেটা নিজ সন্তানদের সুখের চেয়েও বড় হয়ে থাকে।
এখন আসি এই সব পিতাদের পিতৃত্বলাভের গোড়ার দিকটাই। আমাদের সমাজে বিয়ের পর প্রথম দিকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যখনই কোনো জটিলতা দেখা দেয় তখন জটিলতার সমাধান হিসেবে একদল আত্মীয় ও তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী এসে চট করে একটা সন্তান নিয়ে নেওয়ার কাণ্ডজ্ঞানহীন উপদেশ দিয়ে যান। আর অনেক নারীই সেটাকে দৈববাণী ধরে নিয়ে সন্তান নিয়ে বসেন। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় এই নারীরা কোন যুক্তিতে ভাবেন যে তারা সন্তান ধারণ করার পরপরই সেই নিপীড়ক পরকীয়াসক্ত স্বামী তার এতদিনের কাপুরুষতা ত্যাগ করে মহাচরিত্রবান মানুষে রূপান্তরিত হবেন! আদতে তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং এটা নারীকে সীমাবদ্ধ করার একটা কৌশলমাত্র। মনোভাবটা এমন যে – আমি পুরুষ, আমার স্বৈরাচার আমি করেই যাব আর তুমি নারী সবকিছু মেনে নিয়ে সন্তানের মায়াপাশে আটকে আমার ঘরে বিনামূল্যে দিনরাত কামলা খাটতে থাকো।
এই জায়গায় নারীদের আরও একটু বেশি সতর্ক ও যৌক্তিক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি যথার্থ কথা বলেছিলেন, ‘সেই পুরুষমাত্রই কাপুরুষ যে তার স্ত্রীর প্রেমিক হতে পারে নি’।নারী, আপনার প্রতি যে পুরুষ নির্দয় দায়িত্বজ্ঞানহীন, যে পুরুষ আপনার মন জয় করতে পারে নি, প্রেমিক হতে পারে নি, আপনি কীভাবে ভাবতে পারেন আপনার নিষ্পাপ সন্তানের জন্য সেই পিতা দায়িত্বশীল হবেন! এরপর যদি সেই পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতায় বলীয়ান অমানুষ পিতার ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে আপনার সন্তান সমস্ত স্বপ্ন হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে, তাহলে এর কিছুটা দায় কি আপনার উপরও বর্তায় না! কোনো সন্তানই তাকে জন্মানোর জন্য আপনার কাছে এসে আকুতিমিনতি করেনি, আপনি তাকে স্বেচ্ছায় সেই বিরূপ পরিবেশে আনছেন। আর যদি একান্তই নিজেদের বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন হিসেবে সন্তান চান, তাহলে সেটা আপনাদের স্বার্থবাদীতার নির্লজ্জতম রূপ।
অনেক বছর আগে আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া একটি মেয়েশিশু জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন জানতে পারলেন তিনি মেয়েসন্তান জন্ম দিয়েছেন সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি ছেলে চাইছিলেন, কারণ তিনি জানতেন এই পুরুষতান্ত্রিক অসম সমাজ ও পরিবারব্যবস্থায় আর্থসামাজিক দিক থেকে একজন দুর্বল নারীর বিড়ম্বনা কতটুকু। ঠিক কতটা শোষিত হলে, কতটা নিপীড়িত হলে, কত চাওয়া অপূর্ণ থাকলে একজন মায়ের তার সন্তানকে দেখে সুখি হওয়ার পরিবর্তে সন্তানের মধ্যে নিজের নিপীড়িত প্রতিচ্ছবি দেখে তার ভবিষ্যত ভাবনায় বেদনার্ত হতে পারেন!
একবার ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “হা অবলাগন, যে দেশের পুরুষের দয়া নাই, ধর্ম নাই, সদ্বিবেচনা নাই, ন্যায়-অন্যায়বোধ নাই, জানিনা তোমরা কোন পাপে সেই দেশে আসিয়া জন্মগ্রহণ করো”। আজ বিদ্যাসাগরের সেই সময়কে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি অনেককাল, কিন্তু আজও সেই নারী নিপীড়িনদশার উল্লেখযোগ্য পরিমান কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সেই মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা কি মানুষ বয়ে বেড়ায় না?
আর যদি পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় তাহলেও ক্ষমতাধর পিতার জন্য একেকজন সন্তান শ্রমিকমাত্র। যারা পিতার বার্ধক্যের অসহায় সময়গুলোতে সাহায্য করবে। এখন এটাকে হয়তো অনেকেই বলবেন মনমানসিকতার সংকীর্ণতা, তাহলে আমার প্রশ্ন – সন্তান হিসেবে আজও কেন পুত্রসন্তানই কাম্য (অনেকে আবার কন্যাসন্তানও চান কিন্তু সেটা নিতান্তই শখের বশে, পুত্রসন্তান লাভ করার পরে)?
কোনো সম্পর্কে সম্পর্কিত ব্যক্তির সর্বপ্রথম পরিচয় তিনি একজন স্বতন্ত্র মানুষ। সেই স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে তিনি কেমন, তার প্রতিফলন ঘটে তিনি যেসব সম্পর্কে জড়িত আছেন সেই সব সম্পর্কের উপর। একজন দায়িত্ববান মানবিক মানুষ যখন কোনো সম্পর্কে জড়িত হন তখন সেই সম্পর্ককে নিজের সদগুণ দিয়ে সুখি ও সুন্দর করে তোলার সম্ভাবনাটা শতভাগ থাকে। যে মানুষটা ব্যক্তি হিসেবে অমানবিক অবিবেচক, কাল ওই মানুষটা পিতা হিসেবেও হবেন একজন অমানবিক অত্যাচারী অবিবেচক পিতা। পিতামাতা হলেই তারা সকল ভুল-অন্যায়ের উর্ধ্বে থাকা দেবতুল্য মানুষ, সেটা এক অযৌক্তিক ধারণা। পিতামাতা পরিচয়ের আগে তাদের সর্বপ্রথম পরিচয় তারা মানুষ, আর মানুষের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মানুষ হিসেবে তারা যেমন, পিতামাতা হিসেবেও ঠিক তেমনই। পিতা মানেই তিনি সদ্বিবেচক, মমতাবান হবেন এমন কোনো কথা নেই, কারণ সব মানুষ সেইসব সদগুণ প্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীতে বাস করেন না। নেতিবাচক ক্ষতিকর মানুষ যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক ক্ষতিকর পিতামাতারাও আছেন।
পিতা হিসেবে সন্তানকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবা বন্ধ করুন, সন্তান আপনার মনের চাহিদা অনুযায়ী আপনার জেরক্স কপি হবে সেই ধারণাও ত্যাগ করুন। কারণ আপনাদের সন্তানেরাও এই পৃথিবীতে একেকজন আলাদা সত্তা। তাদের নিজস্ব পছন্দ, মতামত, অভিরুচি আছে; আছে জীবনযাপনের জন্য নিজেদের প্রেফারেবল পদ্ধতি। সন্তান যদি কারও ক্ষতি না করে নিজেকে নিয়ে নিরীহ জীবন যাপন করতে চায়, তাহলে তাকে করতে দিন। সন্তানকে চিরকাল ছোট বলে ভাবার মন-মানসিকতা বর্জন করুন। সন্তান সাবালক হলেই তার সকল মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুন। সন্তানকে প্রকৃত অর্থেই বড় হতে দিন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]