November 21, 2024
মুক্তমত

নারীরই কেন এত পাপের ভয় আর পবিত্রতার চিন্তা?

সাদিয়া মেহজাবিন।। আপনার কাছে পবিত্রতার সংজ্ঞা কী? বই পুস্তক কিংবা নেট দুনিয়ায় যেখানেই পবিত্রতার সংজ্ঞা খুঁজবেন, দেখবেন পবিত্রতার সাথে দেহের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। সাথে ধর্মীয় নীতির কথা উঠে আসবে নিশ্চিত। আপনার মুক্তমন ভাবছে পবিত্রতা শুভ্র সুন্দর কিছু। তবে সত্য কি আদৌ এমন?

এই পবিত্র শব্দ দিয়েই নারী এবং তার মনকে সবচেয়ে বেশি বন্দি করে রাখা যায়। কেননা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে পবিত্র শব্দটি শুনলে সর্বপ্রথম আপনার ধর্মীয় বাণীর কথা মাথায় আসবে। যেকোনো ধর্মের নীতিমালায় দেখবেন বেশিরভাগ পবিত্র শব্দ নারীর জন্যে ব্যবহার হয়েছে। এখন নারী এই তথাকথিত পবিত্র থাকার সিলেবাসের বাইরে  গেলেই তাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করা যায়। তাছাড়া পবিত্র থাকার বেলায় আমরা আমাদের মনের শুভ্রতাকে যত না প্রাধান্য দেই তার চেয়ে বেশি শরীরের পবিত্রতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

এখনো আমাদের সমাজে পিরিয়ড হলে সে নারীকে অপবিত্র ধরা হয়। বিবাহ বহির্ভূত নারীর একবার যৌনসঙ্গম হলেই সকলে তাকে অপবিত্র বস্তু ভাবেন। এখন এই সঙ্গম তার ইচ্ছেতে হোক আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে, দুই ক্ষেত্রেই আপনারা নারীকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দেন। কারণ কী? আমাদের মাথায় খুব ছোটবেলাতে পবিত্র নামক একটি ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শরীরবৃত্তীয় পবিত্রতার সংজ্ঞায় থাকে একজন নারীকে কোনো পরপুরুষ দেখলে, স্পর্শ করলে সে নারী আর পবিত্র থাকেন না। মাসিক চলাকালীন নারী অপবিত্র থাকে তাই সে নারীর স্পর্শে অন্য জিনিস অপবিত্র হয়ে যেতে পারে। নারীর শরীর সবসময় পবিত্র থাকে না তাই তাকে ধর্মীয় কাজে রাখা যায় না। এই ভাবনাগুলো আমাদের ভেতর আছে বলেই আমরা দুশ্চরিত্রা আখ্যা পাই।

ধরুন একজন পুরুষ যে কিনা যে কোনো নারীকে ধর্ষণের মনোভাব রাখেন কিংবা করেন, দুর্নীতি করেন, ঘুষ নেন, নারীদের ইভটিজিং করেন ইত্যদি। কিন্তু এই পুরুষগুলোকে সমাজের কোনো মানুষ কখনো দুশ্চরিত্র আখ্যা দেবেন না। কারণ? কারণ হিসেবে তারা বলবেন পুরুষের চরিত্রই এমন। বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থেই বলা আছে পুরুষ মানুষের শরীরে অন্য নারীকে পাওয়ার বাসনা থাকবে, হাজার হাজার বিয়ে করা জায়েজ, পুরুষ মানুষকে শয়তানে ধোঁকা দেয় ইত্যাদি। এখন ভাবুন তো ধর্মের বাণীতে কিংবা সমাজের রীতিতে পবিত্র শব্দ কেবল নারীর জন্যেই কেন ব্যবহার হয়েছে? মূলত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে এই নিয়ম তাদের নিজেদের বানানো এবং এর ব্যবহার কেবল নারীকে বন্দি করতে। শুধু নারীর শরীর নয় সাথে নারীর মনের উপর জোর খাটাতে এই রীতিগুলো এত প্রবলভাবে মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে , যার ফলস্বরূপ এখন নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠছে।

সাধারণত ভারতীয় সিনেমা, বিশেষ করে নতুন সিনেমাগুলো দেখার রুচি না ধরলেও অনেক সময় নিরপেক্ষ থেকে দেখার চেষ্টা করি। কিছুদিন আগে একটি সিনেমা দেখেছি নাম ব্রহ্মাই জানেন গোপন কম্মটি। মূলত সিনেমাতে দেখানোর চেষ্টা করেছে পুরোহিত একজন নারীও হতে পারেন। কেননা শাস্ত্রে কিংবা বেদে কোথাও বলা নেই নারী ধর্মীয় এসব কাজ করতে পারবেন না। বরং নারী মাসিক চলাকালীন পূজোর জিনিস যোগাড় করতে পারবেন। মা সরস্বতীয়ও মাসিক চলাকালীন ভোগ রান্না করতেন।

সিনেমার আলোচনা পরে হবে, আমার কেবল একটি প্রশ্ন পুরো সিনেমাতে কোথাও নায়িকাটি বলতে পারেননি শাস্ত্রে কিংবা বেদে বলা আছে পুরোহিত একজন নারীও হতে পারেন। নায়িকাটি কিছু শাস্ত্রের সংস্কৃত বাণীর সাথে বাংলাও বলেছেন কিন্তু তাতে কেবল আছে মাসিক চলাকালীন নারীরা ভোগ রান্না করতে পারবে। যাই হোক মূল কথা হলো ধর্মে আদৌ নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবছে কিনা তাই আমার সন্দেহ। শুধু কি হিন্দু ধর্ম? আমার ভাই একবার আমাকে প্রশ্ন করেছে, “এত যে নারীবাদ করে চিল্লাও, বলো তো নবী হিসেবে কোনো নারী নেই কেন? কেন আয়াত নারীর উপর নাজিল হয়নি?” আমি চুপ করে আছি। আমার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে আমার ভাই বললো, মূলত নারীর শরীর গরম (যৌন দিক থেকে) আর নারী মাসের বেশিরভাগ সময় অপবিত্র থাকে।” আমি উঁচু স্বরে বললাম, তাহলে পবিত্রতার সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে।

ছোট মুখে একটি প্রশ্ন করি, একেক জনের ধর্ম না হয় একেক রকম, কিন্তু রাষ্ট্র তো সবার। তাহলে রাষ্ট্রেরও কেন সামান্য নিরপেক্ষতার বালাই নেই? আমার রাষ্ট্র ধর্ম যখন ইসলাম তখন আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ধারা, আইন, সংবিধান? ১৫৫ ধারার উপধারায় ছিল কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হলে তাকে দুশ্চরিত্রা বলে প্রমাণ করা যাবে। একটু স্বস্তি পাই, যখন দেখি এই আইন সংশোধনের প্রতিশ্রতি দেয়া হচ্ছে । কিন্তু সুবিধাবাদী এই আমি একটি প্রশ্ন না করে পারছি না, সংবিধান দুশ্চরিত্রা বলতে নারীর কোন কোন কর্মের কথা বোঝাচ্ছে?

গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে কোনো নারীর ধর্ষণ হলে তাকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় কেন? ভিক্টিমের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে রেইপ করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, সাথে ভিক্টিমকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়ার মানে দাঁড়ায় নারীর কোনো স্বাধীনতা নেই, সম্মান নেই, মর্যাদা বলতে কিছু নেই। ধর্ষণ হওয়া মানে নারীর সব শেষ। যোনিকেন্দ্রিক এই ভাবনা কোথা থেকে আসে জানেন? পবিত্রতার সংজ্ঞা থেকে। যা আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এবার অন্তত নিজেকে প্রশ্ন করুন। পবিত্রতা আর দুশ্চরিত্রা শব্দগুলো আমাদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারীর কেন এত পাপের ভয়? পাপ পবিত্রতার সব নিয়ম কেন নারীকে কেন্দ্র করে? ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন। তীর ছুঁড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিন পুরুষতান্ত্রিক এই সভ্যতা ও প্রাচীন শব্দগুলোকে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]