September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

শিশুদের লাশ পাশ কাটিয়ে তারাও কি হাসতে হাসতে ফিরবেন?

সাদিয়া মেহজাবিন।। ছোট বেলায় সেজান জুস আমার প্রিয় ছিল। এর স্পষ্ট কারণ বিজ্ঞাপনে দেখতাম বাবারা কীভাবে বাচ্চারা রাগ করলে সেজান জুস এনে খাওয়াতো। আমার বাবা তখন প্রবাসী ছিলেন। বাবার আদর আমি এখনো বুঝি না। তাই তখন সেজান জুস খেলে আমার মনে হতো আব্বা সেজান জুস এনেছে। বয়স বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে দেখি সেজান জুসে আমের বদলে দেয় মিষ্টি কুমড়ো। তখন আর সেজান জুস আম্মা খেতে দিত না। এরপর বড় হয়েও আর তেমন খাইনি।

তবে এখন নারায়ণগঞ্জের সেজান জুসের কারখানায় আগুনে শিশু সহ শ্রমিক হত্যার ঘটনায় আমার নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জে ঘটে যাওয়া হত্যা মামলার প্রধান আসামী সেজান কোম্পানীর মালিক আবুল হাসেম। কারণ আমাদের সকলের জানা। যখন আগুন লাগে তখন কারখানার গেটে তালা দেওয়া ছিল। আপনাদের মনে কি প্রশ্ন ওঠে না? কেন তালা দেওয়া ছিল? কেন আগুন লেগেছে অথবা জানার পরেও কেন তালা খোলা হয়নি? আপনাদের হাজার প্রশ্ন থাকতে পারে। আবুল হাসেমের মনে কোনো প্রশ্ন, নেই উত্তরও।

ওনার প্রশ্ন নেই কারণ এটা পরিকল্পিত হত্যা। আর আবুল হাসেমের উত্তর দেবার প্রয়োজন হয় না কারণ আমাদের দেশের রাঘব বোয়াল সব ওনার ঝুলিতে। কীভাবে এতদিন অব্দি সেজান গ্রুপ লাইসেন্স পেয়ে আসছে তাদের অবৈধ কাজের? আবুল হাসেম নিশ্চিন্ত, তাই গৌরবের সাথে বলছেন কারখানার আগুন লাগলে ওনার দোষ কোথায়! আসলে তো ওনার দোষ কীভাবে হয়! ওনার মত শিল্পপতিদের তো একটা কারখানা দিলেই হলো। চুষে চুষে শ্রমিকের রক্ত খাবে আর ব্যাংকে টাকা রাখবে, জমিজমা কিনবে।

শিশুরা আমাদের কাছে ফুলের মত। তাই আমরা ফুলের মত শিশুদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতে চাই।

আমাদের সংবিধান আছে। সমাজের রীতি আছে কিন্তু আমার মনে হয় না আমাদের আর এসব সংবিধান পড়ার কিংবা জানার দরকার আছে; কী হবে এসব সংবিধান দিয়ে যদি আপনার বিবেক বলে শিশুদের শরীর পোড়া ছাই দিয়ে তৈরি সুশীলের মুখোশ পরতে?

শিশুদের দিয়ে কাজ করানো অন্যায়। এরপরেও বাসা বাড়িতে সকলে শিশু শ্রমিক রাখি। যে বয়সে আপনার সন্তান দুধে ভাতে থাকে সে সময়ে যদি সেজান গ্রুপের কারখানায় শিশুর লাশ পোড়া গন্ধ আপনি না পান তবে দয়া করে আপনারা আর মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেবেন না।

সেজান গ্রুপের শুরু থেকে বস্তা পচা কাজ কর্ম আমাকে বিরক্ত করে। সেজান জুসের বিজ্ঞাপন দেখেছেন? যদি দেখে থাকেন তাহলে খেয়াল করুন সেখানে কেবল অভিজাত পরিবারের শুটিং করা হয়, যাদের মা বাবা গাড়িতে চড়ে বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার পথে সেজান জুস ব্যাগে ভরে দেয়। এবার আসুন সেজান জুসের গুণগত মানের ব্যাপারে কথা বলতে। অনেক বছর আগেই সকলে জানে সেজান জুসে আমের ফ্লেভারে যা খাওয়ানো হয় সেখানে আমের কিছু দেয় না বরং তার বদলে মিষ্টি কুমড়ো সাথে থাকে, থাকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ যা শিশুদের জন্যে ক্ষতিকর। কিন্তু এসব তথ্য পুরানো তবে কার্যকারিতা নেই কেন? কারণ সেজান গ্রুপ সমাজের সে দলের বোয়াল মাছ যা বাকিদের হাত করে রাখে। যাদের  হাত করে রাখে সে তালিকায় আমলা থেকে কামলা সকলে আছে।

সেজান জুস প্রস্তুতকারক কোম্পানির বেশিরভাগ পণ্য শিশুদের জন্যে তৈরি করা। তারা দাবি করে তাদের পণ্য নির্ভেজাল। তবে তাদের কারখানার খবর আমরা কেউ নেই না। আমরা নেবার থেকেও বড় প্রশ্ন আসে সরকারি কর্মকর্তারা যারা এ কাজের দায়িত্বে, তারা কোথায় ছিলেন? কারখানায় শিশু শ্রমিকদের উপর নির্যাতনে কেন কোনো আইনী পদক্ষেপ ছিল না? আবুল হাসেম শিশুদের দিয়ে কারখানা চালিয়ে অন্যায় করেছেন। এটি স্পষ্ট বলার প্রয়োজন আছে। কারখানায় আগুন লেগেছে জেনেও গেটের তালা না খোলা একটি পরিকল্পিত হত্যা ছাড়া কিছু না। সেজান গ্রুপের কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই, আগুন লাগলে বাইরে যাবার রাস্তা নেই, আগুন নেভানোর সরঞ্জাম নেই, এই না থাকার তালিকায় মালিকের মগজ আর বিবেকও নেই।

কারখানার ইতিহাস মাত্রই শোষণ। শ্রমিক শোষণ আর তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে শুধু সেজান গ্রুপই নয় সাথে আমাদের দেশের বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানও আছে। গুটি কয়েক কারখানা মনসই হলেও তা কেবল উদাহরণ কিন্তু দেশের সামগ্রিক অবস্থা সেজান গ্রুপের কারখানার মতই।

করোনাকালীন একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত মৃত্যু হার বাড়াচ্ছে। মানুষগুলো একেকটা পরিবারকে প্রতিনিধিত্ব করে। করোনাকালীন শ্রমিক শোষণ দ্বিগুন হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে তারা ছুটে যাচ্ছে কারখানায় কিন্তু যে সরকার জনগণকে উপেক্ষা করে চলে, তাদের কাছে নিজের বাসায় কেন, কারখানাতে নিরাপত্তা চাওয়াও অন্যায়। দেশের উন্নতি কতখানি হলে ৩০ ঘণ্টা আগুনে পুড়ে শিশুর লাশ ছাই হবার পরেও আগুন নেভানো যায় না। নাকি এটি আপনাদের নিজেদের লাগানো সেই আগুন যা মস্তিষ্ককে দিন দিন খাচ্ছে, যা কখনো নেভানো সম্ভব নয়?

গণমাধ্যমের সুবাদে জানলাম আবুল হাসেমসহ কয়েকজনকে আদালতে তোলা হচ্ছে কিন্তু প্রশ্ন আদালতে তারা আড্ডা দিতে যাননি নিশ্চয়? এরপরে তারা কি উপযুক্ত শাস্তি পাবেন, নাকি শিশু হত্যার পরেও বেঁচে যাওয়ার আনন্দ নিয়ে ফিরবেন?

এমন পৈশাচিক মানুষদের এই পাশবিক অন্যায়ের কঠিন শাস্তি দাবি করে গেলাম।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]