একটু সহ্য কর মা, মানিয়ে নে, ডিভোর্স দিস না
সুমাইয়া আলম।। ডিভোর্স অর্থ বিবাহ বিচ্ছেদ আর কলঙ্ক অর্থ দাগ বা অখ্যাতি। ডিভোর্স-এর বিপরীত শব্দ হিসাবে ম্যারেজ বা বিবাহ কিংবা যুগলের একতাবদ্ধতাও বলা যায়। দুজন মানুষের মধ্যে বৈবাহিকভাবে যে মিলন হয়, ডিভোর্স মূলত সেটা সমাপ্ত করার প্রক্রিয়া। কিন্তু কোনো একটা কারণে আমরা কোনো মেয়ে ডিভোর্সি শুনলে মনে মনে বা প্রকাশ্যে হুট করে তার নামের পাশে ‘কলঙ্কিনী’ শব্দটা যোগ করে দেই। এর কারণ কী? শব্দটি না ডিভোর্স শব্দের সমার্থক, না বিপরীতার্থক শব্দ। শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত, আমরা একটা মেয়েকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা মুখে আনতে দেওয়াটাই পাপ মনে করি। বরং তার বদলে বলতে থাকি – ‘একটু সহ্য করো মা, একটু মানিয়ে নাও। ধৈর্য্যের ফল উপরওয়ালা দেবে তোমাকে।’ আর বাচ্চা হয়ে গেলে তো কোনো কথাই নেই। তখন আমরা বলতে থাকি – ‘বাচ্চাটারে এতিম করবা, তোমার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই!’
অবশ্যই একটা বাচ্চাকে নিরাপদ সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া উচিত, তবে সেই নিরাপত্তার ঢাল হিসাবে আমরা শুধু মেয়েকেই কেন ব্যবহার করি? একটা ছেলেকে কেন কখনো বুঝাইনা – বাবা, তোর বাচ্চাটার নিরাপত্তা কিংবা মানসিক বিকাশ শুধুামাত্র তোর বউয়ের উপর না, তোর উপরও নির্ভর করে। বরং আমরা ধরে নেই টাকা পয়সা বাদে বাবা আর কোনো কিছুতেই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে না। এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বাদে বাকি সব দায়িত্ব অতিশয় নগণ্য। যেহেতু পরিবারে শুধুমাত্র বাবা এই ভূমিকা পালন করে সেহেতু সর্বক্ষেত্রে সে গডফাদার। এবং মা যা করবে সেটা তার খাওয়া দাওয়ার মতোই ছকবাধা দায়িত্ব। এর জন্য সে আলাদাভাবে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য না।
মানুষ যেমন কর্মক্ষেত্রে ভাল না লাগলে নতুন কিছু শুরু করার কথা ভাবতে পারে কিংবা চাইলে সে চাকুরিটা ছেড়ে দিতেও পারে, এটা যেমন তার একান্তই ব্যক্তিগত ডিসিশন, কারো হস্তক্ষেপ করার কোনো রকম লিগ্যাল অধিকার নেই, তেমনি একটা মানুষ সব ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে কী করবে না করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না অবৈধ এবং অন্যের জন্য ক্ষতিকর হয়। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে কিংবা যে কোনো মানুষ। প্রতিটা মানুষই একজন পূর্ণ অস্তিত্ব। ডিভোর্সের সিদ্ধান্তই শুধু না, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে একটা মেয়েকে আমরা হুট করে বলে ফেলি – তুমি মেয়েমানুষ, এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া তুমি বুঝবে না। আমরা কি কখনো ভেবে দেখছি এই বাক্যটা একটা নির্লজ্জ এবং বেহায়া বাক্য? সৃষ্টিকর্তা যেহেতু সবাইকে পূর্ণ মস্তিষ্ক দিয়েছেন এবং নারীর মস্তিষ্কও যেহেতু অর্ধেকটা তার নিজের কাছে এবং বাকি অর্ধেক কোনো পুরুষ এর কাছে থাকে না, তাই তার ভাবনা চিন্তার জন্য সব উপকরণও তার মস্তিষ্কেই রাখা আছে। এবং সে অবশ্যই চাইলেই বুদ্ধি বিবেচনা ঠিকঠাক কাজ করে।
ডিভোর্স দুজন মানুষের বৈবাহিক জীবনের সমাপ্তি ঘটানোর একটা আইনগত অপশন। এর সাথে আসলে মানুষের মানসম্মানের লেজ বেঁধে দেওয়া থাকে না। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই ভাবে জন্ম, মৃত্যু এবং বিয়ে একবারই হয়।অবশ্য এই নীতি শুধুমাত্র একটা মেয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মদ্দা মানুষের আবার বয়স কীসের? যতবার বেটা ছেলের বিয়ে হয় তত বেশি বউ সামলানোর ক্ষমতা হয় তার। সেই একই ব্যাপার একটা মেয়ের ক্ষেত্রে হলে সে অবশ্য হয় বেশ্যা।
অথচ মেয়ে যদি শ্বশুর ঘরে গিয়ে কোনোরকম সমস্যার সম্মুখীন, সে যদি সাহস করে বলেও “মা আমি আর ও ঘরে ফিরতে চাইনা”, তো বাবা মায়ের আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মাথার উপর। মাঝেমধ্যে মেয়ের মাথায় সমস্যা ভেবে হুজুরের তাবিজও গলায় পরানো হয়। একটা মেয়েকে প্রথমে মা কিংবা দাদী-নানী বা বড় চাচী গোপনে ডেকে বোঝায় – শোন মা তোর কাকা/দাদা’রে যেমন দেখছিস আলাভোলা সরল সোজা, তারা তো আসলে এমন না। সেই ছোট বয়সে আমাদেরও বিয়ে হইছিলো, কত কষ্ট যে সহ্য করছি। মানুষটার সে কি রাগ। একটু কুটো সরাতে এদিক-ওদিক হলেও রক্ষা ছিলনা। কি মারাটা যে মারতো। রাতে ভয়ে আমি শুতেও আসতাম না। তোর দাদী আমারে ম্যালা রাত্তিরে “বাজান ভালো, আমার বৌমারে আর কিছু কইয়ো না” এটা বলে ঘরে ঢোকাতো। একে তোর মারের ব্যাথা, তার উপর আবার জোয়ান মানুষটা বাঘের মতো আমার উপর উপর হামলে পড়তো। তো সেসব কথা মনে রাখলে কি আমার এমন সুখের সংসারের মুখ আমি চোখে দেখতাম? মেয়ে মানুষের এত দেমাগ কি লো! তোর দেমাগ সামলানোর জন্য কি তোর বর বসে আছে? এত দেমাগী হলে সংসার টিকবেনা। গায়ের চামড়া মোটা বানা।
পুরুষ মানুষ যে মার মুখো এটা আসলেও সত্যি। যদি পুরুষটার মনে মায়া-দয়া থাকে তবে তা নিয়েও আবার কানাকানি হয় – বৌয়ের আঁচল ধরে চলে, এমন মদ্দা মানুষ কোনো কাজের না। এবং এমন ছেলে যে মা পেটে ধরেছে তার নিজেরও লজ্জার কোনো শেষ থাকে না।
আমি নিজে চোখে দেখছি পাশের বাসার ভাবিকে গরুর হালে নেওয়া লাঠি দিয়ে মারতে। ভাবি ফর্সা হওয়ার সুবোদে পিঠের উপর লাল-লাল লম্বা সরলরেখা এঁকে যেতো ।মনে হতো পিঠে কেউ সুন্দর এলোমেলো নকশা করে দিয়েছে।সমস্যা হচ্ছে সেই নকশায় হালকা রক্তের কস ঝরে আর ভাবি উহ করে ওঠে ব্যাথায়। এ অবশ্য গ্রাম বাংলার পুরোনো রূপ। যে রূপের সাথে হয়তো ভাবিও আগে থেকেই পরিচিত। ছোট থেকে তো চারপাশে মা-খালাদের সাথে এটাই হয়ে আসছে। আমরা দেখে আসছি এবং ব্রেনে ইনফরমেশন ঢুকিয়েছি “এ সবার সাথে হয়, একটু সহ্য করো, শান্তি আসবে”। হয়তো সেও জানে মুখ বুজে সহ্য করলে একদিন শান্তি আসবে। বয়স বাড়বে মদ্দা মানুষটার, গায়ে বল থাকবেনা। তখন আর তার মাইর খেতে হবেনা। তখন তার সুখের সংসার হবে। আর তাছাড়া সে যাবে কোথায়?এই তো তার শেষ ঠিকানা। সে চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ায়, মানুষটারে বাতাস করে খেতে বসায়। আহারে মানুষটাকে না রাগালেই পারত। মানুষটার মারতে কত কষ্ট হলো! অবশ্য সে নিজেও জানে না মানুষটা হঠাৎ কী নিয়ে এমন রেগে গেল। সে হয়তো আর ভাবে না বা ভাবতে চায় না কারণ মদ্দা মাইনষের শরীর তো না রাগের গোলা। এত ঘেটে কাজ কী। শেষমেষ সে নিজের উপরই দোষটা দেয়। গ্রামের ‘স্নিগ্ধতা’র আরেকটা রূপ হচ্ছে মেয়ে তুমি যত চোখ নামিয়ে কথা বলবে ঘর কানায়-কানায় সুখে তত পূর্ণ হবে। তুমি উচ্চস্বরী হলে তুমি অবাধ্য এবং বেহায়া। অন্যায় দেখলেও তোমাকে সহ্য করতে হবে এবং নম্রস্বরে বলতে হবে। পুরুষ লোকে ভুল করলেও তুমিই নত হয়ে থাকবে।
দু’একজন এতো কিছুর পরেও সাহস করে কিংবা মুক্তি চায়। তাদের নিয়ে বাবা মায়ের জীবন হয়ে ওঠে দূর্বিষহ। বাবা-মা দুজন দুজন কে এটা বলে দোষারোপ করে – এ তোমার কোনো পাপের ফল, নাহলে মেয়ে কেন ডিভোর্স চাইবে? কিংবা এ কোনো অভিশাপ। মেয়েটাও বুঝে যায় এ সমাজে সে নাপাক একজন মানুষ। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে বিয়ের পরে মেয়ে মানুষকে ব্যবহৃত ধরা হয় এবং তাকে আগে পিছে ডাকা হয় “সেকেন্ডহ্যান্ড” জিনিস বলে।তাকে তার নিজের পরিবারই ঠিকমতো সহ্য করতে পারে না কারণ সে বংশের কলঙ্ক। অথচ সৃষ্টির সেরা জীব হওয়া সত্ত্বেও ওই মুহূর্তে আমাদের এই একফোঁটা বিচার বিবেচনা বোধ কাজ করে না যে- ডিভোর্স এর সাথে আসলে পাক-পবিত্রতা কিংবা মানসম্মান জুড়ে দেওয়া থাকে না| ডিভোর্স মানে বৈবাহিক জীবনের মুক্তি। এটার সাথে নিজের মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাওয়ার কোনো রকম কোনো যোগসূত্র নেই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]