সাবিলা চরিত্রটি যেন এদেশের প্রতিটি কর্মজীবী নারীর প্রতিনিধি
নাহিদা নিশি।। মিডিয়া একটা সময় বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমার মাধ্যমে নারীকে পণ্য বানিয়েছে, অসন্মানিত করেছে, যার প্রভাব পড়েছে নারী-পুরুষের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে। শক্তিশালী হয়েছে পিতৃতন্ত্রের শেকড়। বর্তমানে ধীরে ধীরে মিডিয়ায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। নারীবাদ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে মিডিয়াকর্মীরাও। দেরিতে হলেও বিজ্ঞাপন, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা সবখানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আশফাক নিপুণের মহানগর, কান ফেস্টিভ্যালে যাওয়া আবদুল্লাহ মোহম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এবং ফারুকীর ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’, তিনটি কন্টেন্টেরই মূল উদ্দেশ্য হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা এবং অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা।
“অ্যাবিউজার যদি প্রত্যক্ষদর্শী জড়ো করে গ্যালারিতে বসিয়ে আমাকে অ্যাবিউজ না করে, তাহলে আমি কি সেটার বিচার পাবো না?” সাবিলা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বিচার চাইলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আছে কি না?
আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা এরকমই, এখানে যৌন নির্যাতনের বিচার ততক্ষণ পর্যন্ত চাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না আপনার কাছে কোনো ভিডিও, ছবি কিংবা প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকবে! (অনেকে তো ভিডিও থাকলেও এডিটেড বলে বসেন) যাই হোক, আমি জানিনা, কেউ প্ল্যান করে ফোন-ক্যামেরা কিংবা লোকজন নিয়ে গিয়ে ফিজিক্যালি অ্যাবিউজড হয় কি না!
বলছি, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ নামের ওয়েব সিরিজের কথা। আমি যেহেতু সিনেমাবোদ্ধা নই, তাই সিনেমাটোগ্রাফি কিংবা অভিনয়ের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তবে যে ব্যাপারে বলার আছে, তা হলো গল্প! সাবিলা চরিত্রটি যেন বাংলাদেশের প্রতিটি কর্মজীবী নারীর প্রতিনিধিত্ব করছে। অনেকেই বলে থাকেন যে, বসের সাথে শুয়ে শুয়েই নারীরা চাকরি পায়, টাকা কামায়, প্রমোশন বাগায়। কিন্তু তাদের কথা কেউ বলে না, যাদের চাকরি চলে যায় বসের সাথে শুতে রাজি না হওয়ায়, যাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রমোশন হয় না।
সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান খাইরুল আলম একজন কবি, প্রগতিশীল এবং তথাকথিত নারীবাদী। সাবিলা তার কবিতা অত্যন্ত পছন্দ করে। চেয়ারম্যান তাকে তার চাকরি স্থায়ী করার ব্যাপারে কথা বলতে ডাকলে অফিসের অন্যান্য কলিগদের সামনে না গিয়ে অফিস শেষে দেখা করতে চায় সাবিলা। অফিস শেষে যেহেতু দেখা করতে চেয়েছে, তার মানে সাবিলা তার সাথে শুতে ইচ্ছুক, এমনটাই ধরে নেন খাইরুল আলম। এটুকু দেখে দেশসেরা একজন কবি এবং প্রকাশকের কথা মনে পড়ে গেছে, ফেসবুকে কোনো মেয়ে তার কবিতার প্রশংসা করলে, ভালো ভালো দু’টো মেসেজ দিলেই, তিনি সেই মেয়ের ফিগারের সাইজ জানতে চান। পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ নারীর সম্বন্ধে এরকম ধারণাই পোষণ করে।। কেউ তাকে পছন্দ করে, তার মানে তাকে এবার সেক্সুয়ালি হ্যারাস করা যায়।
সাবিলা চেয়ারম্যানের নামে মামলা করতে গেলে উপর মহল থেকে তাকে মামলা করতে বাঁধা দেয়া হয়। তাকে আশ্বাস দেয়া হয় যে, সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক বিচার সে পাবে। কিন্তু বিচার তো পায় না বরং চাকরি হারায়। চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয় সে নিজেই।
কিছুদিন আগে একটা নিউজ আসে দেশের সমস্ত পত্র পত্রিকায়। শিরোনামটা এমন, “নারী নির্যাতন মামলার অধিকাংশই মিথ্যা”। আর কে পায়! এরপর থেকে যখনই কোনো নারী কারো বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে, তখনই লোকজন সেই নিউজের লিংক দিয়ে দিচ্ছে, আর বলছে ‘‘সব মিথ্যা। বানোয়াট”। কিন্তু সাবিলার মতো অসংখ্য নারী, যারা নির্যাতন, হয়রানির শিকার হয়েও মামলা করে না, তাদের সংখ্যা কত? গ্রাম-গঞ্জে টাকা-পয়সার মাধ্যমে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়, তার সংখ্যা কত?
প্রেস কনফারেন্স করে সাবিলা যখন খাইরুল আলমের বিচার চাইলো, তখন অভিযুক্তের উকিল বললো, ভিক্টিম দুশ্চরিত্র, সিগারেট খায়। কারণ, মেয়েদের যদি একবার দুশ্চরিত্র প্রমাণ করা যায়, তাহলে তারা কখনো যৌন নির্যাতনের বিচার পায় না। নায়িকা পরীমণি যখন তার উপর হওয়া যৌন হয়রানির বিচার চেয়েছিলেন, অভিযুক্তরা খুঁজে বের করতে লাগলো পরীমণির বাড়িতে মদের বোতলের সংখ্যা কত, পরীমণির পোশাক আশাক উত্তেজক কি না! কারণ নারী নির্যাতন মামলার হাত থেকে একজন পুরুষ খুব সহজেই রেহাই পেয়ে যায়, যদি একবার ভিক্টিম নারীটির চরিত্রের উপর দোষ চাপানো যায়।
সাবিলার সাথে তার অ্যাবিউজার খাইরুল আলমের মেয়ে লরা আলমের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো ছিল , লরা সাবিলাকে খুব পছন্দ করে, বিজনেস করতে চায় তার সাথে। এমন একটা অবস্থায় যখন সাবিলা লরা’কে জানায় যে, তার বাবা তাকে সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজ করেছে, লরা তখন কষ্ট পেলেও সাবিলার বিরুদ্ধে যায় না। বরং সাবিলার সাথে বিজনেস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরোটা সময় জুড়ে সাবিলার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেছি, খাইরুল আলমের জায়গায় অসংখ্য মুখ ভেসে উঠেছে। কিন্তু কোনো লরা’কে পাইনি জীবনে যার বাবার কুকীর্তির কথা তাকে বলা যায়, যাকে বললে সে আমাকে দোষ না দিয়ে আমাকে বিশ্বাস করবে। ব্যক্তিগত জীবনে ভালো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আমরা বেশিরভাগ সময়ই সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের কথা নিজের কিংবা অ্যাবিউজারের, কারো পরিবারকেই জানাই না। জানালেও অভিযুক্তের পরিবার বিশ্বাস করে না, উল্টে ভিক্টিমকে গালাগাল দিয়ে নিজের বাবা, ভাই, স্বামী, সন্তানের পাশে দাঁড়ায়। লরা তার বাবার পাশে দাঁড়াননি। সাবিলার সুবিচার পাওয়ার লড়াই নিয়ে কাহিনী এগোতে থাকে বিভিন্ন নাটকীয়তার মাধ্যমে।
সিরিজের আরেকটি অংশে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। সেটা হলো, পুরুষের ইগো! পৌরুষের ইগো! সাবিলার স্বামী আরিফকে কাহিনীর শুরু থেকেই ভীষণ প্রগতিশীল এবং নারীবাদী মানুষ বলে মনে হয় যিনি তার স্ত্রীর সমস্ত লড়াইয়ে পাশে থাকেন। কিন্তু তার স্ত্রীর গায়ে অন্য পুরুষ হাত দিয়েছে শোনার পরই তার পৌরুষে আঘাত লাগে। স্ত্রীকে তার অপবিত্র মনে হতে থাকে। তার ভিতরে দেখা দিতে থাকে এক ধরণের ক্ষোভ, যার থেকে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন সাবিলার সাথে, এবং জঘন্য একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন। বাকিটা জানতে হলে দেখতে হবে ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’। যদিও ‘জেন্টলম্যান’ শব্দটা বেশ আপত্তিকর।
যাই হোক, এতো এতো মিসোজিনিস্ট পরিচালকের ভিড়ে কেউ কেউ নারীবাদের কথা বলুক। নারীবাদ নিয়ে অনেক কাজ আসুক। মিডিয়াকর্মীরা তাদের পূর্বসূরিদের করে যাওয়া পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পাক। পিতৃতন্ত্র ও মৌলবাদ মাথা নোয়াতে বাধ্য হোক।