রান্না না জানা অনুন্নত প্রাণীদের প্রতি…
তানিয়া কামরুন নাহার ।। বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডায় বসলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় পুরুষ বন্ধুদের রান্নাবান্নার জ্ঞান বলতে ডিম সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ, চা, নুডুলস বানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তখন ওদেরকে খোঁচা মেরে কথা বলতে আমি ছাড়ি না। যারা রান্না জানে না, ওরা যে প্রাণী হিসেবে কতটা অনুন্নত, নানা রকম যুক্তি তর্কে বুঝিয়ে দিতে হয়। আর রান্না জানা মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে উন্নত প্রাণী। শুধু তাই নয়, পুরুষদেরকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর ও যৌন আবেদনময় লাগে, যখন সে রান্নাঘরে আনাজ তরকারি কাটে, খুন্তি দিয়ে রান্না করে, বাসন মাজে। বুদ্ধিমান ও উন্নত পুরুষেরা আমার এসব কথা বিনা বাক্যে মেনে নেবেন। কিন্তু ভজঘট লাগে অনুন্নত প্রাণী ও পুরুষদের নিয়ে! ওদের মধ্যে বিবর্তনই ঘটে নি এখন পর্যন্ত!
মানুষ যে কবে কখন রান্না শিখেছে সে খবর এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারে নি। আগে আগুন আবিষ্কার হয়েছে, তারপর মানুষ আগুন ব্যবহার করতে শিখেছে। কখনো আত্মরক্ষার কাজে, কখনো শীতের হাত থেকে বাঁচতে, বন্য প্রাণী তাড়াতে, আলোর উৎস হিসেবে, অস্ত্র তৈরিতে – সেও লক্ষ লক্ষ বছর আগের কথা। এরই মধ্যে হয়ত কখনো মানুষ রান্না করতেও শিখেছে। সেই শেখাটা কীভাবে হয়েছে কেউ তো জানে না। হয়ত কেউ আগুনের পাশে বসে মাংস খাচ্ছিলো, হাত থেকে টুকরোটা ছিটকে পড়ে গেছে আগুনে। কিংবা হঠাৎ কারো মাথায় বুদ্ধি এলো, দেখি তো আগুনে ঝলসে নিলে কেমন হয়! তারপর সেই মাংসের টুকরো খেতে গিয়ে আলাদা স্বাদ টের পেলো। খেতেও নরম ও সহজ হলো। পাথরের পাত্র , মাটির পাত্র তৈরির পরে পানি ফুটাতে শিখলো। সেই পানিতে কখনো মাংস, কখনো শাকপাতা ফলমূল সবজি, কখনো পোকা মাকড়ের ডিম, লার্ভা, কখনো মাছ এসব সিদ্ধ করে নেয়া শিখলো। লবণাক্ত অঞ্চলের মানুষ হয়ত কিছুটা লবণও ছিটিয়ে দিলো সেসব খাবারে! এভাবে রান্না করা খাবার খেতে মানুষের সময়ও কম লাগলো। অন্য সময়ে বন্য প্রাণীদের মতো কাঁচা মাংস ছিড়ে খেতে হতো। এতে চোয়াল আর দাঁতের ব্যবহার বেশি হতো। আদিম মানুষের ফসিলে এখনো আমরা দেখি তাদের করোটি চোয়ালের তুলনায় ছোট। কিন্তু অস্ত্র আবিষ্কারের পরে তারা খাবার কেটে টুকরো করে খাওয়া শিখলো, রান্না করা খাবার নরম হলো। ফলে চোয়াল আর দাঁতের উপর চাপ কমলো। চোয়াল, দাঁত , মস্তিষ্কের গঠনও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করলো। রান্না করা খাবার হজম করতে পরিপাকতন্ত্রের ভেতরেও পরিবর্তন এলো। কাঁচা মাছ মাংস খেতে ও হজম করতে অনেক বেশি শক্তি খরচ হতো। রান্না করা খাবার খেতে শক্তি খরচ কম হলো এবার। সময়ও বেঁচে গেলো। তখন আরো বেশি নতুন হাতিয়ার ও নতুন নতুন আবিষ্কারের পেছনে বাড়তি সময় ও শক্তি দেবার সুযোগ পেলো মানুষ। সুতরাং রান্না ও রান্না করা খাবার মানুষকে বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত অবশ্যই করেছে। ষোলশ’ শতকের অ্যাংলো আইরিশ ঔপন্যাসিক অলিভার গোল্ডস্মিথ বলেছেন, ‘’অন্য সব প্রাণীদের মধ্যে মানুষেরই খাবার খেতে সবচেয়ে কম সময় লাগে আর এটিই পশুদের সাথে আমাদের পার্থক্য স্পষ্ট করেছে।‘’
মানুষ ধীরে ধীরে আরো উন্নত হলো আর রান্নার রেসিপিতে যুক্ত হতে শুরু করলো আরো নানান মশলা ও উপাদান। স্বাদে গন্ধে রঙে রান্নাগুলো হয়ে উঠলো আরো বৈচিত্র্যময়। সামান্য এক পানের কথা ভাবতে গেলেও অবাক লাগে। পান জন্মায় এক ধরনের গাছে। এর সাথে আরো লাগে সুপারি, ওটা জন্মায় আরেক গাছে। চুন পাওয়া যায় ঝিনুকের খোল থেকে বা চুনাপাথর থেকে। সেই চুন তৈরির প্রক্রিয়াও আশ্চর্যজনক! ইত্যাদি সব উপাদান মিলিয়ে মিশিয়ে যে খাওয়া যায় আর ওভাবে খেলে সামান্য একটি পানের পাতার স্বাদ গন্ধ আমূল বদলে যায়, এসব মানুষ কীভাবে শিখলো? কীভাবে জানলো? কত শত শত বছরের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফল এসব? অথচ আজ এক খিলি পান কত সহজেই না মুখে পুড়ে, সাদা দেয়ালে পিচিক করে পিক ফেলে দেয় মানুষ!
মানুষ যতই উন্নত হলো, রান্নাটাকে স্রেফ আর দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন হিসেবে রেখে দেয় নি। একে নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। রান্না তো এখন শুধু খাবার বিষয় নয়, একই সাথে দেখারও হয়ে উঠছে দিন দিন। কতটা সুন্দর আর শৈল্পিকভাবেই না পরিবেশন করা হয়! এমনও শুনেছি, শুধুমাত্র নিখুঁত সুন্দর কিউবিক ফর্মে কাটা আমের টুকরো দেখেই একজন প্রেমে পড়ে গেছেন, আম যে কেটেছে তাকে না দেখেই।
শুধু শিল্পই নয়, রান্না রীতিমতো বিজ্ঞান! তা নইলে আর সিডনি অপেরা হাউজ রেস্টুরেন্টের বিশেষ ডেজার্ট ‘’গোল্ডেন ক্রেকার’’ এর রেসিপি বানাতেই তিন মাস সময় লাগে, বলুন? এক চিমটি লবণ বা মরিচ গুঁড়োর এদিক সেদিকও রান্নার এস্পার ওস্পার করে দিতে পারে। সুতরাং মানব সভ্যতায় আগুন বা চাকা আবিষ্কারের চেয়ে রান্না আবিষ্কার কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ? তারপর দেখুন, কুকুর বেড়ালের মতো প্রাণীরাও মানুষের রান্না করা খাবারের স্বাদ বুঝে গেলো কীভাবে! শেষকালে ওরা মানুষের সঙ্গ আর ছাড়লোই না। মানুষকে পোষ মানিয়ে নিজ থেকে রয়ে গেলো মানুষের সাথে, স্রেফ রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্য। যদিও ভাব দেখালো ওরা পোষ মেনেছে।
এত যে উন্নত মানুষ, সে মানুষের মধ্যে হঠাৎ যেন এক দল ইচ্ছে করেই অনুন্নত সেজে থাকবে বলে ঠিক করলো। ফলে মানুষদের মধ্যেও উন্নত শ্রেণির আরেক জাত মানুষ, যাদেরকে আমরা নারী বলে থাকি, তাদের উপর এসে পড়লো বাড়তি চাপ, বাড়তি দায়িত্ব। আর অনুন্নত মানুষ এসব দেখেও না দেখার ভান করে বসে বসে উন্নত মানুষের তৈরি করা খাবার মজা করে খেতে থাকলো। সেই অনুন্নত প্রাণী আবার বিজ্ঞ মতামতও দিলো, ‘‘লবণ কম হয়েছে।” এত দিক সামলে এত কষ্ট করে একজন রান্না করলো, আর তাতে সামান্যতম খুঁত হলেও যেন নিস্তার নেই। অথচ এই খাবারটাই যদি কোনো রেস্টুরেন্টে খেতেন তাহলে বয় বেয়ারাদের একশ বার থ্যাংক ইউ বলতেন!
বর্তমান ব্যস্ত সময়ে নারী ও পুরুষ সবাইকে সমান তালে কাজ করতে হয়, ঘরে বাইরে, অফিসে। শুধুমাত্র বাসায় গিয়ে কী রান্না করবো, এই চিন্তাতেই নারীদের অনেকটা সময় ও মেধা খরচ হয়ে যায়। কর্মজীবী নারীদের বেলায় তো দায়িত্ব আরো বেশি পড়ে যায়, যদি তার সঙ্গী পুরুষটি সহযোগিতাপূর্ণ মানসিকতার না হয়ে থাকে। ফলে নিজের কেরিয়ারেও ঠিক মতো মন দিতে পারে না। তাই নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও মানসিকতা বদলানো দরকার। সময় বদলাচ্ছে, জীবন যাপনের ধরন বদলাচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে আরো চ্যালেঞ্জিং। রান্নাঘরের কিছু দায়িত্ব ভাগ করে নিলে দুজনের জীবনই হয়ে উঠবে সহজ ও সুন্দর। মানুষের জীবন হবে আরো উন্নত।
কর্মজীবী ব্যস্ত নারীদের ইঙ্গিত করে অনেকেই ট্রল করে – ‘আমাদের প্রজন্মটাই শেষ প্রজন্ম, যারা মায়ের হাতের মজার রান্না খেতে পেরেছে।’ ভেবে দেখুন, ব্যাপারটা কি এমন নয়, পরবর্তী প্রজন্মই বেশি ভাগ্যবান, কারণ ওদের বাবা মা দুজনেই চমৎকার খাবার রান্না করতে পারে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]