যুব দক্ষতা বিকাশে পরিবার: চাই মানসিকতার পরিবর্তন
পূর্বাশা পৃথ্বী ।। তরুণদের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন, উৎসাহ দেয়া ও তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস পালিত হয় ১৫ জুলাই। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে যুব দক্ষতা বিষয়ে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট পর্যায়ে রয়েছে। তাই কর্মক্ষম যুবসমাজকে দক্ষ করে তোলার এখনই সময় নিঃসন্দেহে।
দক্ষতা বিভিন্ন ধরণের রয়েছে, কর্মসংস্থানের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন তার বিস্তৃতি বিশাল। বর্তমান যুগের একটা সুবিধা হচ্ছে প্রায় সব স্কিলেরই চাহিদা রয়েছে, বাজার রয়েছে। তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির এই পদক্ষেপ শুধু সরকার কিংবা বড় বড় সংগঠন, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব নয়, আমাদের ব্যাষ্টিক পর্যায়েও কিছু সচেতনতা প্রয়োজন। ‘কোনো কাজই ছোট নয়’ এই মূল্যবোধটা প্রধানত পরিবারেই শেখে একজন মানুষ। নিজেদের বাড়িতে ছেলেমেয়ের মধ্যে কাজের সমবণ্টন করে, বিভিন্ন কাজ শেখানোর মাধ্যমে আমাদের এটি শুরু করতে হবে। সেলাই শেখাটা একজন মেয়ের জন্য যেমন প্রয়োজন, একজন ছেলের জন্যেও তেমনই প্রয়োজন। ঠিক একইভাবে, মেকানিকাল কাজ, ইলেকট্রনিক্স জিনিস মেরামত করার দক্ষতা ছেলে মেয়ে দুজনেরই থাকা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকার রয়েছে বিশাল একটি অংশ, এছাড়া শিক্ষার্থীরা অনেকে রয়েছে যাদের নিজ খরচ চালাতে কর্মসংস্থান প্রয়োজন। সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে চলেছে। কিন্তু চাকরির বাজারের পরিবর্তে নিজ উদ্যোগ শুরু করতে চাইলেও অনেকে লোকলজ্জায়, পরিবারের দ্বারা নিরুৎসাহিত হয়ে পিছিয়ে যায়।
বাইরের দেশে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজ, সুইপারের কাজ করলেও আমাদের দেশে এই কাজটাকে রীতিমত লজ্জার মনে করা হয়। অথচ ছাত্রজীবনে এসব কাজ পকেটমানি উপার্জনের একটি ভাল উপায় হতে পারে।
অপরদিকে, মানুষের সুস্থ বিনোদনের জন্য চারুকলা, সঙ্গীত, নৃত্যকলা চর্চা প্রয়োজন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন এসব বিভাগকে ছোট করে দেখা হয়, এসব দিকে কেরিয়ার গড়তে চাইলেও অনুপ্রেরণার ঘাটতি হয়। অথচ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক শিল্পকে শক্তিশালী করা খুবই প্রয়োজন।
এই ধরনের নেতিবাচক মানসিকতা লালনের শুরুটা হয় পরিবারেই। যে মানবিক বা আর্টসে পড়ে, সে ভাল ছাত্র নয়, যে সাইন্সে পড়ে সেই ভাল ছাত্র- এই মানসিকতা গড়ে ওঠে মা-বাবার কাছেই। সেভাবে চারুকলা বা সঙ্গীত, কিংবা বাংলা, ইতিহাস প্রথম পছন্দের বিষয় যেন না হয়, সেই বিষয়টিও তারাই নিশ্চিত করেন। সন্তান কলেজ পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে যদি কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করে, সেক্ষেত্রে বাধাটি প্রথমে আসে নিজের অভিভাবকের কাছ থেকেই। তাই অভিভাবকের স্থান থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাটা সর্বপ্রথম জরুরি।
আমাদের এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশে আরেকটি অংশ রয়েছে তৃতীয় লিঙ্গ, যারা সমাজে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। তারা সমাজের জন্য লজ্জা ও বোঝা হিসেবে পরিগণিত হয়। অথচ সামাজিক সম্মান, কারিগরি প্রশিক্ষণ, মূলধারায় শিক্ষার সুযোগ পেলে তারাও হয়ে উঠতে পারে আমাদের মানবসম্পদ।
এইসব ক্ষেত্রে সমাজের যে অসহযোগী, কুসংস্কারপূর্ণ মনোভাব, তা দূর করার কাজটা পরিবার থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরই মা, বাবা, ভাই, বোন এর স্থান থেকে এই সচেতনতা, মূল্যবোধের প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা কাগজে কলমে মাইকে জোর গলায় বক্তব্য দিলেও নিজ পরিবারের আদর্শিক অংশের ক্ষেত্রে সচেষ্ট হই না।
একুশ শতকে সফট স্কিলস-এর চাহিদা অতীব। এই সফট স্কিলসের মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, দলগত কাজের দক্ষতা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়া, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও নতুন নতুন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের মানসিকতা, কর্মক্ষেত্রের মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা, সময়ানুবর্তিতা, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে স্থির থেকে সমস্যার সমাধান করা, বৈচিত্র্যকে সহজে গ্রহণ করা ইত্যাদি। এইসব দক্ষতার প্রাথমিক শিক্ষাটা নিশ্চিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব। নিজেদের ঘরে, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনের গণ্ডিতেই এই চর্চাটা সচেতনভাবে শুরু করা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের তরুণ সমাজ আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই একটি সুন্দর আগামী গড়ার লক্ষ্যে পরিবারেই সচেতন অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]