হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিনে…
আরাফাত লিও তন্ময়।। বৃষ্টি হচ্ছে—মগবাজার কাজী অফিসের সামনে দিয়ে হাঁটছি ছাতা মাথায়। বৃষ্টিজল থেকে বাঁচতে সতর্ক হয়ে হাঁটতে হচ্ছে, যেন কাপড় ভিজে না যায়। মধ্য চল্লিশের এক যুবককে চোখে পড়ল। উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কাজী অফিসের বিপরীতে। তার চশমা ঝাপসা হয়ে আছে; বৃষ্টির ছাঁটে? নাকি অশ্রুজলে? বোঝা মুশকিল। হঠাৎ দেখলে বুঝি বা খেয়াল হয়— আজ তার বিয়ের দিন ছিল। প্রেমের বিয়ে, পরিবারের অমতে। আচমকা বৃষ্টি এসে সব পণ্ড করে দিয়েছে। প্রিয়তম নারীকে নিজের করে পাওয়া হবে না এমন আফসোসে কাজী অফিসের দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকার সময় শরীর ভিজে যাচ্ছে কি না সেসবে খেয়াল থাকার কথা নয়।
পিচঢালা রাস্তায় ক্রমশ পানি জমছে। এই ঢাকা শহরের এমন এক অবস্থা, ব্যাঙে মুতলেও হাঁটু সমান পানি জমে যায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ছাতা দিয়ে কোনো রকম মাথা বাঁচানো গেলেও জমতে থাকা পানি থেকে শরীর বা কাপড় কিছুই বাঁচানো যাবে না। অগত্যা, হাঁটা বন্ধ করে মানুষটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, মগবাজার কাজী অফিসের সামনে। তিনি বোধহয় টের পাননি। তখনও পলকহীন তাকিয়ে আছেন। হুমায়ূন আহমেদ আহমেদের পাঠক যারা আছেন, এই মগবাজার কাজী অফিস তাদের বেশ পরিচিত। তার অনেক চরিত্রের বিয়ে হয়েছে এই কাজী অফিসে।
পাশে থাকা ভদ্রলোক পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞেস করলেন— ভাই সাহেব কি কিছু নিয়ে ভাবছেন?
বেশ অবাকই হলাম। ভেবেছিলাম মানুষটা এক খেয়ালে কাজী অফিসের দিকেই তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে যদি মহাপ্রলয় ঘটে যায় তাতেও তার তাকিয়েথাকা বন্ধ হবার নয়। কিন্তু না, আশেপাশের ঘটনার প্রতি মানুষটা বেশ সজাগ আছে মানতে হয়।
উত্তর না দিয়ে তাকে উল্টো প্রশ্ন করলাম— সকালে কি ঝগড়া করে বাসা থেকে বের হয়েছেন?
আমার প্রশ্নে তার মনে বোধহয় বিস্ময় জাগল। কাজী অফিস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিঃশব্দে আমার আগাগোড়া দেখলেন। চশমটা খুলে ফতুয়ার ঝোলা অংশ দিয়ে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন— কীভাবে বুঝলেন?
উত্তর না দিয়ে আমি নীরব থাকলাম। আমরা দুজনের কেউই কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করেছি; কেন?
কে জানে? এমনটাও হয় মাঝেমাঝে। প্রশ্নের উত্তর হয় প্রশ্নের মাধ্যমে। আমি বললাম— আপনি খুব দ্রুত শেভ করেছেন। এবং ঠোঁটের নিচে ব্লেডের পোঁচ বসেছে। শেভ করার সময় মানুষ যথেষ্ট সজাগ থাকে। মনোযোগ নষ্ট হয় বেখেয়ালে। যখন মানুষ প্রচণ্ড রেগে থাকে তখন এমনটা হয়। আর সংসারী মানুষের রাগ করার প্রাথমিক কারণ হলো, পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া।
মানুষটার চোখ ভিজে উঠল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দিলেন এক শব্দে— হুম।
তারপর ভেজা কণ্ঠে জবাব বললেন— আজকে আমার মেয়ের মৃত্যুদিন।
মানুষটার জন্য মায়া হলো। মানুষ মাত্রই সংবেদনশীল। সমবেদনা আপেক্ষিক। কিছুক্ষণ বাদে এই মায়া আর কাজ করবে না। তবুও কিছু কিছু ছায়া থেকে যায় স্থির সূর্য ক্রমশ ডুবতে থাকলেও। এই অতিমারির সময় স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যেকোনো সময় সংক্রমিত হতে পারেন নিষ্ঠুর করোনায়।
তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন, নিজ থেকেই বললেন— কেউ কেউ থাকে পৃথিবীর যাবতীয় বিনাশ যাদের স্পর্শ করতে পারে না।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম …
খানিক বাদে, মানুষটা খুব প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠলেন। দেখে ভালো লাগল। কিছুক্ষণ আগের সব যেন তিনি ভুলে গেলেন। আমাকে বললেন মাথার উপর থেকে ছাতা সরিয়ে নিতে। তিনি বেশ হাসি হাসি মুখ নিয়েই বললেন— বৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতি নিজের মতো করে সতেজ হয়। মানুষও তো এই প্রকৃতিরই অংশ। প্রাকৃতিক নিয়মের বৃষ্টিতে প্রকৃতির একটা অংশ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কৃত্রিম প্রতিরোধক ব্যবহার করবে, মানুষ নিশ্চয় এত বেরসিক নয়?
মানুষটা কি বৃষ্টিবিলাসী?
আমি সাধারণত বৃষ্টিতে ভিজতে পারি না। গায়ে বৃষ্টিজল লেগেছে কী লাগেনি— অমনি একশো তিন ডিগ্রি জ্বর। তাই অতো খায়েশও নেই। কিন্তু মানুষটার কথায় ভুলে গিয়ে কখন যে ছাতা গুটিয়ে রেখেছি বুঝে উঠবার আগেই দেখি কাকভেজা হয়ে আছি। তিনি মুচকি হাসছেন। দেখে আমারও হাসি পেল।
হাসি থামতে তিনি একটু আড়ালে মনোযোগী হয়ে উঠলেন সিগারেট ধরাতে। দেশলাইয়ের বারুদ কাজ করছে না। আমি লাইটার এগিয়ে দিলাম। সিগারেট ধরিয়ে তিনি তৃপ্তির টান দিলেন। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তার মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন নেই।
আমাদের সামনে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে একটা কুকুর। তিনি চুকচুক করে ডাক দিলেন। কুকুরটা মাথা তুলে একবার তাকিয়ে ফের হাঁটা ধরল। সামনে ময়লার ভাগাড়; তার গন্তব্য সেখানে। কুকুর ধীরপায়ে হেঁটে ভাগাড় থেকে সুবিধা মতো খাবার খুঁজে নিয়ে খাওয়া শুরু করল।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন— আচ্ছা, ভাই সাহেব; মানুষ যদি সৃষ্টির সেরা জীব হয় তাহলে মানুষের পর সৃষ্টির দ্বিতীয় সেরা জীব কারা? তৃতীয় সেরা জীবেরাই বা কে?
আসলেই তো। পৃথিবীর সব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নের পর ফার্স্ট রানার্সআপ সেকেন্ড রানার্সআপ থাকে। সেরার পর দ্বিতীয় সেরা, তৃতীয় সেরা। পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা জীব কারা? মানুষই বা কোন প্রেক্ষিতে সৃষ্টির সেরা জীব?
প্রত্যেক মানুষেরই ব্যক্তিগত কিছু অপ্রাপ্তি থেকে যায়। আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবীর চোখে তাকে যথেষ্ট সফল মনে হলেও প্রতিটা মানুষই মূলত ব্যর্থ মানুষ।
বৃষ্টির বেগ আরেকটু বাড়তেই মানুষটা হাঁটা ধরলেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। খানিক এগিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— লীলাবতীর মুখে বাবা ডাক না শুনেই অনন্ত নক্ষত্রবীথির পথে রওয়ানা দিয়েছি; এর কোনো মানে হয় ভাই সাহেব?
পিলে চমকে উঠল! এইইইই আপনি কে?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না//বুনোহাঁস