ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ : স্রষ্টা যখন নেমে আসেন পৃথিবীতে
আবরার শাহ্ ।। কৃষণ চন্দর উর্দু সাহিত্যের একজন বিখ্যাত গল্প লিখিয়ে এবং ঔপন্যাসিক। তাঁর লিখিত পেশোয়ার এক্সপ্রেস, গাদ্দার, আমি গাধা বলছি, পুরে চান্দ কি রাত, কাহানী কি কাহানী ইত্যাদি উপন্যাস উর্দু ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত। অধুনা উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীতেই কৃষণ চন্দর ব্যাপকভাবে চর্চিত প্রধানত তার গল্প বলার ঢং, বিচিত্র বিষয় নির্বাচন এবং মানবিক আখ্যান রচনার মুন্সিয়ানায়। বাংলাভাষী পাঠককুলের কাছেও কৃষণ চন্দর অচেনা নন। তবে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে তিনি সমধিক পরিচিত ‘অন্নদাতা’ নামে তৎকালীন বাংলা অঞ্চলে সংগঠিত পঞ্চাশের মন্বন্তর তথা তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের উপর লেখা সাড়া জাগানো উপন্যাসের জন্য।
তবে আজকের আলোচ্য উপন্যাসটি হলো ‘দাদর পুল কে বাচ্চে’ যার বাংলা অনুবাদে অনুবাদক মোস্তফা হারুন নাম রেখেছেন ‘ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ’। নামকরণের স্বার্থকতা যাচাই করতে গেলে নির্দ্বিধায় বলতে হয় মূল লেখক এবং অনুবাদক দু’জনই স্বার্থক। উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মূলত বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে, তারই একটি জায়গা হল দাদর পুল। এক নাগাড়ে দু’দিন উপোস করে অনাহারক্লিষ্ট জীবনের প্রতি ভীষণ ঘেন্না ধরে গিয়েছিল উপন্যাসের কথকের। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন খোলা ঘরে বসে পরনের ছেঁড়া লুঙ্গিটার আঁচলে কুড়িয়ে পাওয়া ক’টা যবের দানা চিবোনোর সময়ই ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকলো ভগবান! হুম, ঠিকই পড়েছেন, ভগবান (সৃষ্টিকর্তা)। দাদর পুলের এই ছোট্ট দীর্ণ বিদীর্ণ ঝুপড়ি ঘর থেকেই কাহিনী এগুবে বোম্বের বিভিন্ন গলি-ঘুপচি, রাজপথে। চলতি পথে ভগবানের সঙ্গী হবে সেই নিরালম্ব, ক্ষুধার জ্বালায় ক্লিষ্ট, জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে যাওয়া বালকটি।
বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা ভগবান হঠাৎ করেই একদিন নেমে আসেন মর্ত্যে। বোম্বে শহরে। বোম্বে শহরের ছেলে-পেলেদের দেখবেন এই তার সাধ। বহুকাল আগে তাঁর সৃষ্টি করা সেই সব পূত-পবিত্র ছেলে-পেলেদের দেখার আশায় মর্ত্যলোকে পা বাড়ান স্বয়ং ভগবান। নিরাকার ভগবান সাকার রূপ পরিগ্রহ করেন। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছেলেটিকে সঙ্গী করে দু’জনই শিশুর রূপ ধারণ করেন এবং ভগবানের ইপ্সিত মর্ত্যের পূত-পবিত্র শিশুদের দর্শনের আশায় বের হন। তবে পদে পদেই ভুল ভাঙ্গে ভগবানের। পায়ে পায়ে কিছু দূর যেতেই দেখেন শিশুরা ভিক্ষা করছে, আমড়া, লেইস-ফিতা বিক্রি করছে। শিশুসুলভ উজ্জ্বল চেহারার বদলে রুক্ষ, দারিদ্র্যক্লিষ্ট, দীন চেহারা, গায়ে শীর্ণ, ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়-চোপড় দেখে ভীষণ হতাশ হন ভগবান।
অলিগলিতে হাঁটতে হাঁটতে একদিন এসে পৌঁছান একটি গীর্জায়। সেই খ্রিস্টীয় উৎসবের দিন গীর্জাতে রঙ-বেরঙের জামা পড়া, হাতে মোম নিয়ে এদিক সেদিক বাবা-মায়ের হাত ধরে হাঁটা উজ্জ্বল চেহারার শিশুদের দেখে ভগবানের মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। সেই রেশ অবশ্য বেশিক্ষণ স্হায়ী হয় না। গীর্জা থেকে বেরুতেই ভগবান দেখেন ময়লা কাপড় পড়া একটা শিশু খুব করুণভাবে সবাইকে অনুনয় বিনয় করছে দুই আনা দিয়ে তিনটে মোমবাতি কেনার জন্য, সাথে এই বলে নিরন্তর হেঁকে চলেছে যে ওর বাবা-মা কেউ নেই। ভগবানের মনটা নিমেষেই দমে গেল, দয়াপরবশ হয়ে ভগবান দুই আনার মোম কিনলেন। চার্চ গেইট থেকে নাগরার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে ভাড়া মেটানোর সময়ই বুঝলেন ওনার মানিব্যাগ খোয়া গেছে। ভগবান খুব হতাশ হলেন। এভাবে সারা বোম্বে চষে বেড়াতে লাগলেন ভগবান, জুহু থেকে বান্দ্রা, চার্চ গেইট থেকে দাদর পুল কিছুই বাদ গেল না। কোথাও দেখলেন শিশুরা জুতা পলিশ করছে তো অন্য জায়গায় দেখলেন মদের চোরাকারবার, লটারির দালালি করছে। একদিকে দেহ ব্যবসার মেয়ে সাপ্লায়ারের কাজ করছে তো অন্যদিকে দু’চার টাকার লোভে আস্ত মানুষ খুন করছে। মালাবার হিলসের স্কুলে গিয়ে দেখলেন শিশুরা পড়াশোনা করছে, পাখির মত শিশুদের কিচিরমিচির উৎফুল্লতা দেখে ভগবান খুশি হলেন। তবে সেখানেও বৈষম্যে ভরা, কেবল লাখপতি বাবার শিশুরাই সেখানে পড়তে পারে, ধনী বাবার বাচ্চাগুলো আবার গরীব বাচ্চাদের ঘৃণা করে। স্বয়ং ভগবানকেই শিশুরা মারধর করে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয় বহিরাগত হয়েও নোংরা, দুর্গন্ধময়, ছেঁড়া পোশাক পরে স্কুল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার অপরাধে।
মূলত তৎকালীন বোম্বে শহরের বেকারত্ব, দারিদ্র্য, ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য এবং এ সবকিছুর নিদারুণ অভিঘাতে বোম্বে শহরের শিশুদের ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে নানা ধরণের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়া ও জীবনের ঊষালগ্নেই পাপ পঙ্কিলতায় জড়িয়ে পড়ার মত ভয়াবহ সংকট, কিশোর গ্যাং কালচার, ‘বড় দাদা’দের ছত্রছায়ায় এবং প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মত হৃদয়গ্রাহী আখ্যানকে নিখুঁত লেখনীর মাধ্যমে বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত করেছেন ঔপন্যাসিক।
অন্যদিকে ভগবানের সাথে দাদর পুলের জীর্ণ ঝুপড়িবাসী ঐ দীন বালকের কথোপকথনে উঠে আসে জীবনের গভীর দর্শন। মানুষের সাথে মানুষ রূপধারী সাকার ভগবানের গভীর জীবনভেদী ও গূঢ দার্শনিক সংলাপে এক কুহকী পরাবাস্তব পৃথিবীতেই যেন হারিয়ে যায় পাঠক।
অদ্ভুত ঘোরলাগা সময় কাটাতে চাইলে পড়ে ফেলুন কৃষণ চন্দরের অমর সৃষ্টি ‘ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ’।