খুনে পাকিস্তান: কন্যাশিশুর জন্ম যেখানে মৃত্যু
অভি বর্মন।। পাকিস্তানে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু নিখোঁজ হয় বা করাচীর রাস্তায় তাদের ফেলে দেওয়া হয়। কেউ কেউ রাস্তায় ভাঙা বোতল, স্যানিটারি বর্জ্য আর ঘরের আবর্জনার স্তূপের মাঝে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। পাকিস্তানে ‘পাপ’ থেকে জন্ম নেয়া এ বাচ্চাগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাদের জন্মদাতারাই মেরে ফেলে। নাইট লাইফের জন্য পরিচিত “লাইটের শহর” করাচীর ক্ষীণ আলো বা অন্ধকার অলিতে গলিতে এই রূঢ় বাস্তবতা প্রায় প্রতিদিন দেখতে পাওয়া যায়।
এসব অন্ধকার গলিতে সর্বমোট কত শিশু মারা গেছে সে সম্পর্কে কোনও চ্যারিটি বা কোনও সরকারী সংস্থার সাথে কথা বলে সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। নামকরণ কেন্দ্র যেখানে পরিত্যক্ত শিশু এবং গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয় দেওয়া হয় এমন এক সংস্থানের কর্ণধার রমজান চিপা নামের এক সমাজকর্মী বলেন, “আমরা নিশ্চিত নই; এটি কয়েকশ বা হাজারও হতে পারে।”
এধি ফাউন্ডেশন ২০১৭ সালে সারা পাকিস্তানে আবর্জনায় ফেলা রাখা ৩৫৫টি মৃত শিশুকে খুঁজে পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মেয়ে ছিল। চিপা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে আরেকটি এনজিও শুধু করাচীতেই ৯৩টি এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল যেখানে নবজাতক মেয়েদের হত্যা করা হয়েছিল। ইউনিসেফের কাছেও কোনও প্রামাণিক পরিসংখ্যান নেই আর এধি ফাউন্ডেশন বা চিপা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মতো সংস্থার আবর্জনা থেকে মৃত শিশুদের পাশাপাশি জীবিত উদ্ধারকৃত বাচ্চাদের সঠিক পরিসংখ্যান রেকর্ড করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
যদিও পুলিশ দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতাকে শিশু হত্যার মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে, তবে এধি ফাউন্ডেশনের আধিকারিকরা বলেন অন্য কথা। জনাব কাজমির মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়ার কারণে শিশুমৃত্যু ঘটে থাকে। উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে শিশু হত্যার অনুপাত বেশি; বিশেষত, মেয়েদের হত্যার প্রবণতা বাড়ছে পাকিস্তানে। অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট অফ পপুলেশন এজিংয়ের গত দুই দশক ধরে করা গবেষণা অনুসারে, কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানের আশায় অনেক মা বারবার বাচ্চা জন্ম দিতে থাকে। পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থায় কন্যা সন্তানদের চেয়ে পুত্র সন্তানকে বেশি পছন্দ করা হয়। বিবাহবন্ধনের বাইরে জন্মানো শিশুদের পাকিস্তানি সমাজে লজ্জার কারণ মনে করা হয় এবং এ জাতীয় শিশুদের তাদের জন্ম দেয়া পরিবারের কাছে কোনও মূল্য নেই। তবে বাচ্চা ছেলে হলে পরিবার তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।
যারা শিশুদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় তারা থেকে যায় বিচারের বাইরে। করাচীর পুলিশ দাবি করেছে যে কেবল অভিযোগ পেলে এ জাতীয় অপরাধের তদন্ত করা যায় কিন্তু ২০১৭ সালে শিশু হত্যার বিষয়ে কেবল একটা অভিযোগ এসেছিল। এমনকি পাকিস্তানের রিয়ালিটি টিভি শোতেও দেখা গেছে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া শিশুকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক মা-বাবার হাতে তুলে দিতে। যেসব শিশু ভাগ্যবান তারা পায় একটি স্নেহশীল পরিবার।
পাকিস্তানের অনেক শহরে এধি ফাউন্ডেশন শিশুদের জন্য দোলনা স্থাপন করেছে যাতে জনগণ অযাচিত বাচ্চাদের হত্যার পরিবর্তে সেখানে ফেলে রাখে। স্থানীয়দের কাছে ‘ঝুলা’ নামে পরিচিত এমন দোলনার সংখ্যা সারা দেশে শত শত থাকলেও এই উদ্যোগটি খুব কম সাফল্য পেয়েছে। এই উদ্যোগে সাড়া না পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ধর্মীয় নেতৃত্বের ক্রোধ যারা মনে করে ঝুলা ‘অবৈধ’ সন্তানের জন্ম দেয়াকে উৎসাহিত করে।
পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা কমাতে পারলে অযাচিত গর্ভধারণ হ্রাস পাবে। তাই শিশুদের এসব অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পরিবার পরিকল্পনার উপর সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী। যেহেতু শিশুদের একটি আইনি শূন্যতায় হস্তান্তর করা হয় বাচ্চা দত্তক নেবার পরেও স্বচ্ছতার অভাব থেকে যায় রাষ্ট্র কর্তৃক দত্তক নেবার কোনও প্রবিধান না থাকায়। ইসলামী আইন দত্তক গ্রহণের অনুমতি দেয় না। তবে দম্পতিরা অযাচিত বাচ্চাদের আইনি অভিভাবক হওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করতে পারেন যেটা খুব অল্পসংখ্যক লোক করে।
অভি বর্মন: লেখক ও কার্টুনিস্ট