প্রযুক্তি এবং লিঙ্গ বৈষম্য
সানজিদা খানম।। গোটা বিশ্ব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আর এই যুদ্ধে আমাদের বন্ধু হিসেবে পাশে আছে টেকনোলজি, মানে প্রযুক্তি। আমি ভাবতে পারি না, করোনার মতন মহামারির সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তি না থাকলে আমাদের দশাটা কী হতো! করোনা প্রতিকারের প্রধান উপায়ই ছিলো বাসায় থাকা, জনসমাগম না করা। এই বাসায় থেকেও প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান, ওষুধ, চিকিৎসা সেবা নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সকল তথ্য আমাদের হাতের কাছে এনে দিতে সাহায্য করেছে প্রযুক্তি। শুধু তাই নয় দেশের অর্থনীতিও এখন প্রযুক্তি নির্ভর। অর্থ আদান-প্রদান তো আছেই সেই সাথে পছন্দের খাবার থেকে শুরু করে চাল ডাল কেনা এমনকি কুরবানীর হাটও এবার বসেছিল অনলাইনে। মার্কেটে আঘাত হেনেছে ডিজিটাল মার্কেটিং এর জোয়ার। করোনার আগেও প্রযুক্তির চল ছিল কিন্তু করোনার পরে যে ব্যাপকতা লাভ করেছে তা থেকেই বোঝা যায় যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও চলবে প্রযুক্তিরই রাজ্য কিন্তু এখন প্রশ্ন তথ্য ও প্রযুক্তির এ রাজ্যে নারীর সমাগম কতটুকু?
করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে বেড়েছে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা, দেশের চৌষট্টি জেলা থেকে নানান খাতে ব্যবসার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা এবং বাসায় বসে কাজ করার সুবিধা আছে বলে অনেকেই অনলাইন বিজনেসে আগ্রহী। কিন্তু এদিকে তাকিয়েই আমরা যদি বলি প্রযুক্তিতেও বেড়ে গেছে নারীর অংশগ্রহণ তবে সেটা হবে আমাদের মস্ত বড় ভুল।
GSMA এর “Connected women, The mobile gender gap report 2020” থেকে আমরা যে তথ্য পাই তা রীতিমতো আশংকাজনক। গবেষণার এই রিপোর্টে উঠে এসেছে শতকরা ৮৬ ভাগ পুরুষের মোবাইল ফোন আছে এবং এদের মধ্যে ৩৩ ভাগ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অপরদিকে ৬১ ভাগ নারীর নিজস্ব মোবাইল আছে এবং তাদের মধ্যে মাত্র ১৬ ভাগ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ব্যবধান আমাদের চোখের সামনেই। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে পরিসংখ্যান অনুযায়ী উগান্ডার নারীদের অবস্থান বাংলাদেশি নারীদের থেকে ভালো। নিজস্ব মোবাইল আছে সে হিসেবে যদি যাই তবে জেন্ডার গ্যাপ শতকরা ২৯ ভাগ কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করে, সেই হিসেব কষলে জেন্ডার গ্যাপ ঠেকে ৫২ ভাগে। গ্রামের দিকে তো অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়, অন্য আরেকটি রিপোর্টে উঠে আসে মাত্র ১০ শতাংশ তরুণী ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
GSMA এর রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে নারীদের ডিজাটাল লিটারেসি রেট কম যে কারণে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহারে নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং সেই সাথে নারীদের মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রয়েছে পরিবারের চরম অনীহা। এই জায়গায় আমার নিজস্ব একটা পর্যবেক্ষণ না বললেই নয়, পরিবারের বারো বছর বয়সী ছেলের হাতে বাবা মা নির্দ্বিধায় স্মার্ট ফোন তুলে দিলেও পরিবারের মেয়েটার জন্য আঠারোর আগে তা নিষিদ্ধ। অথচ উচিত ছিল দুজনের হাতেই স্মার্টফোন দেওয়া সাথে “ডিজিটাল লিটারেসি”র শিক্ষাটাও দেওয়া।
নারীদের কর্মক্ষেত্র বেছে দেওয়ার রীতি তো আমাদের সমাজে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। এই সময়ে এসেও পেশা হিসেবে প্রকৌশলী, গণমাধ্যম কর্মী, সিনেমা নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা এমনকি গবেষণার মতোন কাজেও মেয়েদের নিরুৎসাহিত করে আসছে আমাদের সমাজ। তারা মেয়েদের সেবামূলক খাতগুলোতে বেশি দেখতে চায়। কিন্তু করোনার পরে আমরা যদি দেখি শিক্ষা খাতে কিংবা ব্যাংকিং সেবায় এমনকি চিকিৎসা খাতসহ সব জায়গায় নূন্যতম কিছু সফটওয়ারের ব্যবহার জানা জরুরি। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট, এক্সেল, গুগল শিট, এছাড়াও গুগল এর সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার, গুগল মিট, জুমের মতোন কিছু অ্যাপের ব্যবহার না জেনে রেহাই নেই। কিন্তু নারীরা কতটুকু সুযোগ পাচ্ছে এসবে নিজেকে দক্ষ করার?
সেদিন একটি নিউজ চ্যানেলে মন ভালো করে দেবার মতোন একটা সংবাদ দেখছিলাম। নূরীন সুহাইলা আসজাদ নামের একজন নারী বিজ্ঞানী তার উদ্ভাবনী কাজের কথা বলছিলেন। কীভাবে তার উদ্ভাবন চিকিৎসা খাতে জনসাধারণের ভোগান্তি কমাবে, ড্রাগস, অ্যাবিউজ কমাবে তা নিয়েই শুনছিলাম। কিন্তু এমন সুন্দর সংবাদের অপর পৃষ্ঠে আছে ভয়ানক কিছু তথ্য যেখানে নজর দেবার সময় আমাদের চলে এসেছে । সরকারি হিসেব মতাবেক তথ্য ও প্রযুক্তিতে কাজ করছেন মাত্র ১২ শতাংশ নারী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশুনা করছে মাত্র ২৫ শতাংশ নারী এবং নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে আছেন মাত্র ১ শতাংশ নারী!
আমাদের সমাজে যে জেন্ডার গ্যাপ আগে থেকেই আছে তা বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না কিন্তু প্রযুক্তির ছোঁয়া সে গ্যাপকে হু হু করে বাড়াচ্ছে। মহামারির পরবর্তী দুনিয়া হবে প্রযুক্তি নির্ভর। ইতোমধ্যেই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে গেছে। আমরা সকলেই তথ্য ও প্রযুক্তির এ জোয়ারকে সাদরে গ্রহণ করছি। সঠিক তথ্য পাওয়া এবং সেই তথ্য ব্যবহারের দক্ষতার ওপর এখন মানুষের ক্ষমতা, অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থান অনেকাংশেই নির্ভশীল হচ্ছে। নারীদের এই তথ্য ও প্রযুক্তির যুগান্তরকারী সময়টার সাথে তাল মেলাতে হবে। শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালেই চলবে না সেই সাথে নারীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে জায়গা করে নেওয়া এখন সময়ের দাবী। তথ্য ও প্রযুক্তির হাতে সেই ক্ষমতা আছে যা অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু এই পরিবর্তনের পথে নারীরা এখন থেকেই যদি তাল মেলাতে না পারে তবে তারা শুধু পিছিয়েই পড়বে না বরং বলা ভালো ছিটকে পড়বে।
বেগম রোকেয়া “জাগো গো ভগিনী” তে নারীদের পড়াশুনার ওপর জোর দিয়েছেন, ঘরের বাইরে কাজ করার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর কথা ছিলো স্ট্রেইটকাট, যদি পুরুষদের সমপরিমাণ অধিকার চাও তবে পুরুষ যদি ক্ষেতে কৃষি কাজ করে তবে তুমিও করবে, সে যদি অফিসে যায় তবে তুমিও যাবে। তিনি যে সকল কাজের কথা উল্লেখ করেছিলেন আসলে সেই সময়ে পাওয়ার প্র্যাকটিস হতো এসব কাজ দিয়ে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন ক্ষমতা চলে গেছে প্রযুক্তির হাতে তাই নারীদের এখন আরো শক্ত করে কোমড় বেঁধে নামতে হবে। পরিবার, সমাজেরও বোঝা জরুরি নারীদের প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো ছাড়া একটা সমগ্র দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। তবে সমাজ আর পরিবারের আশায় বসে থাকলে হবে না ভগিনীগণ, নিজেদের লড়াইয়ে নিজেদেরই নামতে হবে, সমাজকে এখন আঙ্গুল দিয়ে কিছু সত্য নিজেদেরই বোঝাতে হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]