ভুলে-অভুলে, নামে-অনামে
কিযী তাহনিন।। এই যে ঘটিবাটি, এই যে লাল নীল পাথরের রং, আর জোনাকি পোকার মতন দালান মোড়ানো মরিচবাতি, এই যে সানাইয়ের সুর বাজিয়ে এক প্রথাগত আবহ তৈরি, সবটুকুর সাথে জুড়ে আছে – নতুন।
এ বাড়ির বিয়ে। আয়োজনে ঘটা করে যেমন করে হয় এ শহরে, তেমন করে, বউ এসেছে, বাড়িতে। শহুরে আয়োজন। না আছে জটিলতা, না আছে খলনায়ক, নেই নিলজ্জ্ব দেনা পাওনা। সব পরিমিত, গোছানো, উল্লাসও।
সপ্রতিভ সকলে, এ বিয়ের আয়োজন জুড়ে। বর-বউ। কোথাও কোনো বাড়তি অনুভূতির বাড়াবাড়ি নেই। গল্প এখানে শুরু হলেও পারতো, কিংবা শেষ। গল্প আসলে শুরু না শেষ, অথবা ক্লাইম্যাক্সে ঠাসা মুহূর্তে পৌছালো, আগে থেকে কে তা বলতে পারে?
বিয়ে বাড়ির আমেজ থিতু হচ্ছে, কাছেপিঠের মানুষগুলো, বরের বাড়িতে ডালা-কুলার সাথে জড়িয়ে থাকা বাড়তি রঙিন ফিতার মতন ঝুলে আছে। পোস্ট-উৎসব আড্ডা চলছে। বিয়ে শেষের তৃতীয় দিন বিকেলে, যখন বসার ঘরে আড্ডা জমেছে, আর বরের মায়ের খালাতো বোন, যিনি বিয়েতে আসতে পারেননি, সিঙ্গাপুর ছিলেন বলে, আজ আসলেন। মেহমানের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা ও করতে হয়।
বরের মা তাই ডাকলেন, “পারভিন … শুনে যা …”
১৬ বছরের পারভিন, মূল গল্পে যে এক অপ্রোজনীয় চরিত্র, সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির কাজটাজ করবার মানুষ, সুধীজনেরা গৃহকর্মী বলে ডাকেন।
চা-নাস্তার কথা বলার আগেই নতুন বউ এক ছুটে সামনে এসে দাঁড়ালো, “মা ডাকছেন?”
-“না তোমাকে তো না, এই পারভিন কে ডাকছিলাম। “
“ওহ আমি তো পারভিন শুনে ছুটে আসলাম। অফিসে সবাই পারভিন ডাকে, অভ্যাস .,.. “
সিঙ্গাপুর ফেরত বরের খালা নড়েচড়ে বসে, “তোমার নাম তো সেগুফতা, তাই না বউ ?”
-“জ্বি খালা, ডাক নাম। ভালো নাম তো পারভিন।”
এমন করেই ঘটনা ঘটে। এমন করেই ঘটনা যে ঘটছে, তা আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর মতন সুধী মানুষ সংসারে আসে। এই যেমন সিঙ্গাপুর ফেরত খালা।
সেদিন রাতে বৈঠক বসে। বাড়ির দুই পারভিন বাদে অন্যরা। বৌয়ের নাম পারভিন, তবে কাজের মানুষ কেমন করে পারভিন হয়? প্রশ্ন ছুড়ে গেছেন বিদেশ ফেরা খালা।
অনেক ভেবে চিনতে, যাচাই বাছাই করে, ১৬ বছরের পারভিন, যে বাড়ির কাজ করে, তার একটা নতুন নামের ব্যবস্থা হলো, জমিলা, শরিফা, জোহরা, আনিসা – সবগুলো নাম যত্ন করে বেছে জমিলা নির্ধারিত হলো। নিরাপদ, দোষমুক্ত।
১৬ বছরের পারভিন, যে এ বাড়ির ‘কাজের মেয়ে’, তাকে ডেকে বোঝানো হলো, জমিলা ডাকলে এখন থেকে সাড়া দিতে হবে। বোঝানো হলোনা, কেন তার নিজের নাম, বদলে গেলো অন্যের ইচ্ছায়।
বার কয়েক রিহার্সাল করানো হলো সে রাতে এবং জমিলা ওরফে পারভিন পরীক্ষায় পাশ।
“যা অন্য ঘরে যা, জমিলা বলে ডাকলে এ ঘরে আসবি।”
কয়েকবার নাম ডাকের খেলা চললো। পাশের ঘর থেকে জমিলা ডাকলে, পারভিন এসে দাঁড়ায়। সবাই খুশি হয়ে ঘুমোতে যায়।
পারভিনও ঘুমিয়ে পরে। বেঁচে থাকার তাগিদে ক্লান্ত দিনের গাঢ় ঘুমে সে ভুলে যায় নাম পাল্টানোর খেলা।
তাই পরদিন থেকে জমিলা নামটা ভুলে যায় আবার কাজের মেয়েটি। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে আবার বোঝানো হয় তার নাম – জমিলা, পারভিন একদম নয়।
ভুল হয় তার ও। ভুল হয় বাড়ির মানুষের ও। পুরোনো অভ্যাস। মাঝে মাঝে “পারভিন পানি দে’ বলে জ্বিভ কেটে থুক্কু বলে আমার জমিলা বলে ডাক দেয় তারা।
এমন ভুলে-অভুলে চলছিল নামের খেলা। উদাস হতে কেমন লাগে, ১৬ বছরের পারভিন জানেনা। তার সময় কোথায়? সে কি জানে উদাস কেমন করে হয়? সে শুধু বোঝে কাজে মন বসেনা, কানে ও সমস্যা আজকাল – ডাক দিলে শুনতে পায়না। তার নিজের কি নাম ভুলে যায় বারবার।মনে পরে বাড়ির উঠানের গাছে জেগে ওঠা সবুজ কাঁচা সফেদা ফলের কথা । সে ভাবে তার অসুখ, শরীরে হয়তো জ্বর। কিন্তু কেন এমন হয়, কেন আজ ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসেনা, সে জানেনা। সে শুধু জানে বুকের ভেতর মাঝে মাঝে কেমন পিনপিন সুঁই ফোটে। সে জানেনা উদাস হওয়া কাকে বলে।
জানে এ বাড়ির বৌ, পারভিন। নিজের বিছানা আর হলুদ রঙের দেয়ালওয়ালা নিজের ঘর ফেলে নতুন বাড়িতে এসে, নানা রঙের মাঝখানে যখন পুরোনো টুকরো সময়ের কথা মনে হয়, মন তো একটু উদাস হয়ে ওঠে। তবে নতুন জীবনের রঙে সে উদাস পানসে ক্ষণ বেশি পাত্তা পায়না।
এ আধুনিক জীবনে, পুরানো আটপৌরে ধরণের সমস্যা এখন আর বাসা বাধেনা। ঘর-বাহির মিলিয়ে মিশিয়ে চলছে নতুন জীবন। নতুন বউ আধুনিক, নিজেরটা করে নিতে পারে। প্যানাপ্যানে ন্যাকা গোছের নয়, অনভ্যস্ত নির্ভরশীল নয়।
বিদেশ ফেরত খালা যখন সেদিন আড্ডায় বলছিলেন, আজকাল মেয়েদের একটু কর্মঠ হওয়া উচিত। সচেতন হওয়া উচিত, পৃথিবী দেখা উচিত, বাইরের দেশের মেয়েদের মতন, এ বাড়ির সবাই সহমত হলেন।
নতুন বউ পারভিন যে বিয়ের পর নিজের নাম বদলে স্বামীটি পদবি লাগবেনা, এতে পারভিনের স্বামী খুশি, খুশি এ বাড়ির সবাই। কি দরকার, মা-বাবার দেয়া নামের পদবি তদবি বদলে ফেলা? এইগুলো থেকেই তো পরে মন কষাকষি হয়, হয় অশান্তি।
দিন আসলে এমন করেই কাটছিলো, এমন করেই কাটে। ভুলে-অভুলে। এ বাড়িতে নতুন আসা পারভিনের কিন্তু চোখ এড়ায়না এই বাড়িতে রয়ে যাওয়া পুরোনো ১৬ বছরের পারভিনকে, যার নাম এখন জমিলা।
জমিলা নাম ডাকের সাথে ১৬ বছরের পারভিনের চোখে যে বিষাদময় ছায়া ফেলে, তা নতুন পারভিন দেখতে পায়। বড় অপরাধী বোধ হয় তার। যে ছোট সাধারণ মানুষটি জানেনা কি তার অধিকার, তার থেকে এমন করে কি কেড়ে নেয়া যায় তার নাম?
দুই পারভিন মাঝে মাঝে গল্প করে। বিকেলে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে নতুন বউ যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের অপেক্ষা করে, জমিলা ওরফে পারভিন তখন লেবু চা বানিয়ে আনে। তখন তারা গল্প করে। নতুন বউ পারভিন বলে, “দেখো এইটা কি বসে আছে পাঁচিলের ওপর?”
জমিলা ওরফে পারভিন বলে, “এইটাতো কবুতর ভাবি।আপনে কবুতর চেনেন না?”
হাসে নতুন বউ। “ওহ তাই, আমি তো জানি এটাকে কাক বলে। এটা কবুতর নাকি ?”
হাসে জমিলা মানে ১৬ বছরের পারভিন, “ভাবি যে কি কয় কবুতররে কেউ কাক কয়?”
নতুন বউ পারভিন তাকায় ১৬ পারভিনের দিকে, “কেন কবুতরকে কাক বললে কি হয়?”
-“যার যেটা নাম ভাবি, সেই নামেই তো ডাকে … “
নতুন বউ তাকায়, ছোট পারভিনের চোখে, “তাই? এই যেমন তোমার নাম পারভিন, জমিলা না কিন্তু … তাইনা?”
এর পর বোধহয় কেউ আর কথা বলেনা কোনো। প্রয়োজনও পড়েনা। দুই অসমবয়সী দুই ক্ষেত্রে বাস করা দুজন আলাদা পারভিন সন্ধ্যের মুখে একে ওপরের চোখের দিকে তাকিয়েছিলো । সে তাকিয়ে দেখায় কোন আশ্বাসের ভাষা ছিল হয়তো, বা নিজেকে চিনে নেবার কোনো গল্প। কে জানে।
কিন্তু এর পর ১৬ বছরের পারভিন, জমিলা নামে আর সাড়া দেয়নি। কোনোদিনও না। সে গভীর সহজতা এবং দৃঢ়তার সাথে বলতে শিখেছে, তার নাম পারভিন। তার জীবন পারভিনের। অন্য কারো নয়।