November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

তালেবানের ক্ষমতা দখল ও আফগানী নারীর ভয়াবহ ভবিষ্যৎ

সাদিয়া মেহজাবিন ।। ইতিহাস তার লিখিত প্রত্যেক শব্দের পুনরাবৃত্তি করে কিনা জানা নেই তবে তালেবানের ক্ষমতা দখল আমাদেরকে অন্ধকার ভয়ানক পথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের ইসলামিক ছাত্র আন্দোলনভিত্তিক একটি দল তালেবান। এটির মূল ভিত্তি শরিয়া আইন। তালেবান এর আগেও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অব্দি আফগানিস্তান শাসন করেছে। গণভোটের আওতায় না গিয়ে আফগানিস্তানের মত গণতান্ত্রিক দেশকে কাবু করা আমাদের জন্যে লজ্জার। তালেবানের ক্ষমতা দখল নিয়ে আমরা আজ যেমন সোচ্চার কিন্তু দু দিন পর নাও থাকতে পারি, কিন্তু সূদুর প্রসারি পরিনতির কথা ভেবে প্রতিবাদ করা গুরুতর দায়িত্ব।

আফগানিস্তানের এমন দুর্দিন প্রত্যেকের কাছে ভয়াবহ কিন্তু যখনই মানবতা লঙ্ঘন হয়েছে তার প্রথম তীর লেগেছে সাধারণ নারীদের উপর। তালেবানরা বলছেন তারা শরিয়া আইন মেনে চলবে। এ কথা শত ভাগ খাঁটি কেননা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল অব্দি তালেবানের ক্ষমতায়নে চোখে পড়ে শরিয়া আইনের প্রসার। মূল প্রশ্ন হচ্ছে শরিয়া আইন কি নারীর পক্ষে ছিল? মনে পড়ে নারীদের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে শরিয়া আইনের ভিত্তিতে বোরকা পরানো, ঋতুস্রাব হলে স্কুলে না পাঠানো, নারীরা আইন ভাঙ্গলে মোরাল পুলিশিং এর নামে পাথর নিক্ষেপসহ তালেবানের করা মানবতাবিরোধী অনেক কাজ। শরিয়া আইন নারীদের পর্দার কথা বলে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলার নির্দেশ দেয়। সেখানে প্রত্যেক নারীকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। তালেবানের এই ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানে বেশিরভাগ দোকানে বোরখার বিক্রি বেড়েছে। নারীরা জীবন বাঁচাতে এখন বোরখার আশ্রয় নিতে চাচ্ছে। এই ঘটনায় বেশিরভাগ শিল্প সংস্কৃতির সাথে জড়িত নারীরা নিজেদের জীবন নিয়ে চিন্তিত এবং ভীত। এ ভয়ের অন্যতম কারণ এই শরিয়া আইন। শরিয়া আইন বলে নারীরা পরপুরুষের সামনে যেতে পারবে না। দূরের সফরের ক্ষেত্রে বাবা, ভাই, চাচা, দাদা, নানা, স্বামী ব্যতীত আর কারো সাথে সফর করতে পারবে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে নারীদের নিজের মতামত বলতে কিছু নেই। তাই তালেবানদের এই শরিয়া আইন সর্ব প্রথম নারীদের অস্তিত্ব সংকট ঘটাবে।

ধরুন তালেবান তাদের লক্ষ্যে সফল, সেক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা পুরুষেরা পেতে পারে কেননা শরিয়া আইন বলছে চার বিয়ের কথা, সাথে দিচ্ছে বাল্য বিবাহের বৈধতা। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করবে তা নিশ্চিত কিন্তু যেসব পুরুষ মুক্তচিন্তায় ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তারাও কম ভোগান্তির শিকার হবেন না। এখন একটা ব্যাপারে নজর দেওয়া জরুরি তা হলো ধর্ষণ। এর আগেও ইসলামিক দেশগুলোতে দেখা যায় তারা খুব উচ্চস্বরে বলে শরিয়া আইন মানলে ধর্ষণ কম হয় কেননা শরিয়া আইনের শাস্তি ভয়াবহ। মূলত দেখা যাবে আফগানিস্তানে কোনো ধর্ষণ হলে তালেবানরা ভিক্টিম ব্লেমিং করবেন এবং নারীদের উপর আরো কড়া আইন প্রয়োগ করবেন। ধর্ষণ ঠেকাতে তারা ফাঁসির মত ব্যবস্থা দিতে পারেন তবে নিশ্চিত দেখা যাবে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ভিক্টিমের মুখ বন্ধ রাখবেন। কেননা এর আগেও তালেবানের শাসনে ৯৫% নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা এর প্রতিবাদ না করলেও আমরাও আছি হুমকির মুখে। পাকিস্তানের নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশে বর্তমানে স্বাধীনতা থাকলেও একটা বিরাট অংশ ধর্মান্ধ মানুষের সুপ্ত বাসনা শরিয়া আইন। বহু মানুষ মৌলবাদী যার হদিস আমাদের জানা আছে। শাপলা চত্বরের ঘটনা কিংবা ব্লগার হত্যা, নারীদের উপর ক্ষমতার প্রয়োগসহ বিভিন্ন ঘটনা আমাদের জানা।

নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বিবেকের জানালা খুলে দিতে সহায়ক। আমি যখন ইন্টারে পড়ি তখন আমরা প্রাইভেট পড়তে এক শিক্ষকের কাছে যেতাম। আমার জানা ছিল তিনি মুক্তমনা এবং বেশ বৈজ্ঞানিক ভাবনার মানুষ। আমি ভেবে নিয়েছি সে প্রাইভেটে শিক্ষার্থীরা আর যাই হোক মুক্তমনা হবার পথে। আমাদের এক বন্ধু প্রথম দিকে আরিফ আজাদের প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ বইটা নিয়ে আসতো আর আহ্বান করত পড়ে দেখার। আমি বরাবরই এর পরিহাস করলে সে আমাকে আবেদন জানায় একবার অন্তত বইটি পড়ে মতামত দিতে। আমি পড়ে বুঝতে পারি খুব নিখুঁতভাবে আমাদের মৌলবাদের পথে নিয়ে যাবে এই পথ। এর কিছুদিন পর দেখলাম ব্যাচের প্রায় সবাই এটা নিয়ে মাতামাতি করছে এবং পড়ছে। আমি ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আর তাছাড়া তারা কী বিশ্বাস করবে তা তাদের ব্যাপার। কিন্তু তীব্র আতঙ্কিত হই যখন দেখি আমারই সহপাঠী আমার বন্ধু না থেকে একজন পুরুষ হয়ে যাচ্ছে এবং পোষাকের সমালোচনাসহ ব্যক্তিস্বাধীনতার বাইরে গিয়ে জোরপূর্বক আমাকে বিভিন্ন কথা শোনাচ্ছে। তখন আমরা আর আগের মত বন্ধু থাকতে পারিনি যা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। দেখি সে বন্ধু এখন প্রায়ই জিহাদের ডাক দেয়। আমি রীতিমত ভীত কেননা তার পক্ষের মানুষ অনেক। জিহাদের পক্ষে বেশিরভাগ বাঙ্গালী মুসলমান, যারা তালেবানের এই ঘটনার পর সোচ্চার হচ্ছে, যা আমাদেরকে অন্ধকার পথে ঠেলে দেবে। আফগানিস্তানসহ বাংলাদেশের অগ্রগতি না হয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব। মৌলবাদের আগ্রাসন কোনো জাতির জন্যেই সুফল ডেকে আনে না। প্রত্যক্ষ তীর দিয়ে ছিন্ন করে প্রধানত নারীর জীবনকে। তাই সোচ্চার হওয়া ছাড়া রেহাই নেই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]