শহীদ রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধারাই তারুণ্যের হিরো
তানিয়া কামরুন নাহার ।। “ কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না, চায় রক্ত-স্নাত শহীদ। ”
খালেদ মোশাররফের এ কথায় ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত হয়েছিল রুমী। শাফী ইমাম রুমী, ১৯/২০ বছরের এক তরুণ। “গ্রেনেডের মতো জানটাকেও হাতের মুঠোয় নিয়ে চলে ওরা।” – বলেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য রুমী ও সাথের অন্য মুক্তিযোদ্ধা, আলতাফ মাহমুদ, বদি, আবুল বারাক আলভী, আজাদ, বকর এবং আরো অনেকেই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা নিয়েই তাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এবং এক সময় মৃত্যু ঠিকই তাঁদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এসব ঘটনা পড়তে পড়তে মস্তিষ্কে আলোড়ন তোলে। মনে পড়ে যায় হলি আর্টিজানে হামলাকারী নিব্রাসদের কথা! এই জঙ্গীরাও তো জীবনবাজি রেখে তাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল হাতে! তাদেরকেও কেউ না কেউ এভাবেই মোটিভেট করেছিল। দুর্মূর্খেরা অবশ্য এরকমও বলে থাকে, মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী! তাহলে রুমী ও নিব্রাসদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
তারুণ্যের একটি আলাদা শক্তি রয়েছে। ঐ শক্তিতেই তারুণ্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। রুমীর মধ্যে এ আগুন ছিলো। অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও রুমী ঐ অল্প বয়সেই নানা রকম বই পড়তো। ঐটুকু বয়সেই মার্ক্স এঙ্গেলস আয়ত্ত করেছিল। ছিলো তুখোড় বিতার্কিক। ফলে যেকোনো বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে সে অনুসন্ধান করতে পারতো। রুমী এমনই এক সূর্যসন্তান, যে সম্ভাবনাময় সুন্দর ভবিষ্যতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বেছে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মা জাহানারা ইমামকে সে বলেওছিলো, “আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে, আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুড়ির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা? ”
যুদ্ধে যাবার জন্য রুমী ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু ঘর ছাড়ার আগে মায়ের অনুমতি নিয়েছে। যতদিন মা অনুমতি দেয় নি, নিজের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে ঘর ছাড়ে নি। নিজের স্বপ্ন, নিজের আদর্শের কথা মায়ের সাথে অকপটে শেয়ার করেছে। আর অন্যদিকে নিবরাসরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, তাদের মা-বাবারা জানতেন না। চোরের মতো ঘর থেকে পালিয়েছিল এই জঙ্গীরা। কারণ ন্যায় অন্যায়ের বিভেদ তারা জানতো না। জাহানারা ইমামের মতো একজন মা ছিলেন বলেই আমরা রুমির মতো এমন মেধাবী, সৎ সাহসী সন্তান পেয়েছি। এখনকার মায়েরা সন্তানদের বলেন, ঝামেলায় জড়াবি না। ফলে এখন আমরা পাই শুধু ভালো রেজাল্টধারী ইডিয়ট। গ্রীক ভাষায় ইডিয়ট শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে রাজনীতি বোঝে না। সত্যিই এমন ইডিয়ট প্রজন্মের জন্যই কি রুমিরা প্রাণ দিয়েছিল? যে রুমি এক সময় নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা না ভেবে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল, এখন সে দেশের ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাই ভাবে। দেশের কথা ভাবে না।
রুমীকে বিশ্লেষণ করে আমার দেখতে পাই, সে বর্তমানের মেধাবী আত্মকেন্দ্রিক, ক্যারিয়ারিস্ট তরুণদের মতো সে নয়। দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করে প্রাণ দেবার মতো সৎ সাহসী ছিল সে। এখন চলুন একটু ভেবে দেখি, রুমী কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল? এর জবাব হচ্ছে, পাকিস্থানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। এই পাক-বাহিনী কী করেছিল? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, নির্বিচারের নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে রাতের আঁধারে। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ কাউকে রেহাই দেয় নি। সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবন আতঙ্কে পূর্ণ করেছে। তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল পুরো বাঙ্গালী জাতিকে। রুমী ও তার বন্ধুরা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এইসব অস্ত্রধারী অত্যাচারী হায়নাদের বিরুদ্ধে। প্রাণ দিয়েছিল অন্যায়ের প্রতিবাদে।
অন্যদিকে নিবরাসরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, তবে কাদের বিরুদ্ধে? এর জবাবটাও সবার জানা – একেবারে নিরপরাধ, নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। নিবরাসদের তারুণ্যের শক্তিকে সম্পূর্ণ অপব্যবহার করেছে ক্ষমতালোভীরা। ইসলামী আদর্শের কথা বলে, ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এইসব তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে তারা। এসব যে অন্যায় তা ভেবে দেখার মতো চিন্তাশক্তিও নিবরাসদের ছিল না। একটা মোহের মধ্যে পড়েছিল নিবরাসরা। মৃত্যুর পরে বেহেস্তে যাবে, সেই লোভে। তারপর হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থে। দেশ বা জাতির সেবা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। রুমি কিংবা আজাদ কিন্তু ব্যক্তিগত সব স্বার্থে ভুলে গিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। দেশের মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে, সাধারণ মানুষের স্বাধীকারের জন্য প্রাণ দিয়েছিল। কী করছে, কেন করছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়েই রুমিরা গেরিলা হয়েছিল। কোন আলগা ফুটানির উদ্দেশ্যে নয়। তাদের মধ্যে অমন আত্মগরিমাই ছিল না কখনো। তেমন প্রমাণও আমরা পাই। গেরিলারা কখনো ছবি তোলে না, তাদেরকে কখনো দেখা যায় না, এমন আদর্শে রুমি নিজের ছবি তুলে রাখে নি। নিজেকে নিয়ে কোনো হিরোইজমে ভোগে নি। তারপরেও রুমিই আমাদের কাছে হিরো। আর অন্যদিকে নিবরাসদের মধ্যে নায়ক হবার গুণ থাকার পরেও শুধুমাত্র বিবেক বিবেচনাবোধের অভাবে বেছে নিয়েছিলো খলনায়কের জীবন।
সব দিক বিবেচনা করে দেখলে নিবরাসদের সাথে রুমিদের আত্মত্যাগের তুলনা করা মানায় না। তবুও পার্থক্যগুলো নিয়ে আমাদের চোখ খোলা দরকার। আমরা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের সাথে গুলিয়ে না ফেলি। ভালো মন্দের পার্থক্য যেন বুঝতে পারি, সেজন্যই এত কথা বলা। কোনো কোনো মৃত্যু জীবনের চেয়েও মহান হয়ে ওঠে।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, এমন এক ২৯ আগস্ট, রবিবারে, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য রুমি ও তার অন্যান্য সহযোগীদের পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ভয়ঙ্কর নির্যাতনের পরেও রুমি কিংবা আজাদেরা সেদিন মুখ খোলে নি। মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছিল। রক্তস্নাত সে সব শহীদদের আজও আমরা অশ্রুসজল চোখে স্মরণ করি। কোনোদিন দেখা না হলেও মনে হয় যেন খুব কাছের মানুষ, আত্মার আত্মীয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]