November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘‘কিছু মেয়েকে কি কখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো না?’’

লামিয়া ইসলাম ।। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটা মেয়েকে ছোট থেকে ভয় পেতে শেখায়। তাকে আস্তে কথা বলতে হবে – নিচু স্বরে, মাথা নত করে বাঁচতে হবে। মাথা নিচু করলেই যে মুক্তি তা নয় তবে তখন সে ভদ্র মেয়ে হিসেবে পরিচিত হবে এই দয়া দেখানো হয়। এই ভদ্র মেয়ে হিসেবে টিকে থাকাও কিন্তু এতো সহজ না, তাকে দিতে হয় পরীক্ষার পর পরীক্ষা। এই অভ্যাস শুরু হয় একেবারে ছোট থেকে। স্কুলে কোনো ছেলে তাকে আঘাত করলে তাকে মার খেয়ে ফিরতে হবে। পাল্টা আক্রমণ করলেই বলা হবে – ছেলেদের সাথে মারামারি করে কেমন মেয়েরে বাবা!

মেয়ে বাচ্চারা লক্ষী হয়, ভদ্র হয় ইত্যাদি সামাজিক চিন্তা যা মূল্যবোধ নামে পরিচিত, যা শুধু মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু উল্টোটা মানতে সমাজ প্রস্তুত না। কোনো ছেলে বাচ্চা যদি কোনো মেয়ে ক্লাসমেটের হাতে মার খেয়ে কাঁদে সেটা বিশাল হাসাহাসির বিষয়। টিপ্পনী কাটা হয় এই বলে কেন মেয়েদের হাতে মার খেয়ে কাঁদলো! সে কি মেয়ে?

এরপর খেলাধুলাতেও শেখানো হয় মেয়েরা বল খেলবেনা, দৌঁড়াবে না। একটা জায়গায় চুপচাপ বসে হাড়ি পাতিল খেলো, যাতে ভবিষ্যতে রান্নাবান্না করতে পারো। অর্থাৎ শৈশব থেকেই মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাকে চুপ করে থাকতে শেখানো হয়। এমনকি চুপ করিয়ে রাখা হয় সে মার খেলেও। আরেকটু বড় হলে যদি সে ইভটিজিং-এর শিকার হয়, আবারো বলা হয় মেয়ে তুমি তোমার নিজের দোষ খুঁজে বের করো। দোষ তোমার কাপড়ে? দোষ তোমার হাঁটায়? দোষ তোমার শরীরে? এসব শুনে মেয়েটা নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। মনে করে ছেলেদের ইভটিজিং যেন স্বাভাবিক। সব দায় তার। এতো দায় তাকে মাথায় নিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ সব সহ্য করতে হবে। এমনকি কান্নাটাও জোরে কাঁদা বারন। পাছে লোকে শুনতে পায়। শুনলে ত মেয়েটারই সম্মান যাবে। এরপর যদি নিকট আত্মীয় দ্বারা এবিউজড হয় আবার চুপ থাকতে হবে। ম্যাচিউর হতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো সম্পর্কে জড়ালে চুপ থাকতে হবে। ব্রেকাপ হলে চুপ থাকতে হবে, নাহলে তো এক্স তার ফ্রেন্ডসহ দুনিয়ায় প্রচার করে দেবে মেয়েটা আসলে ভদ্র না। বানানো হবে ‘বারোভাতারি’। মেয়ে তুমি ভালো গাও? ভালো নাচো? ভালো খেলো? কিন্তু তোমার তো জোরে হাঁটা, জোরে কথা বলা বারন। তবেই না হবে তুমি ভদ্র। প্রেমিক বলেছে, পাওয়ারফুল বস বলেছে তোমাকে ড্রিংক করতে, না করবে তুমি? সে কি! তুমি কি অভদ্র যে ছেলেদের সাথে তর্ক করবে? তোমার তো সৃষ্টিই হয়েছে তাদের আদেশ মানতে। ভদ্র মেয়ের মতো করে ফেলো ড্রিংক।

ওমা সে কি! এই কথা আবার সমাজে জানলে মেয়েকেই তো অভদ্র বলবে। বিয়ে হলে তো পারলে বোবাই হয়ে যাও। শশুড়বাড়ি, জামাই এরা যতই অন্যায় করুক। শাবানার মতো আদর্শ বউ হতে চুপ করে থাকতে হবে মেয়ে। হাসবেন্ড মারে? সে তো মারতেই পারে। কিন্তু স্বামীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব মেয়ের তাই চুপ করে থাকতে হবে মেয়েকেই। গরম আগুনের ছ্যাকা দিয়েও তাকে ভদ্র মেয়ের পরীক্ষায় উর্ত্তীন হতে চুপ করে থাকতে হবে। এতো কিছুর পরেও কানাঘুষা চলবে ভদ্র নাকি অভদ্র। কতটা ভদ্র। তবুও টু শব্দ করা যাবেনা। তাহলে জুজুর ভয় দেখানো হবে এই যেন গেল খসে ভদ্র মেয়ের তকমা। এ সমাজে পরীমণিরা উঁচু গলায় বলতে চাইলেই তার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা স্বাভাবিক হয়ে যায়। হয়েছেও।

অন্য সবাই যে যা ইচ্ছা খাক। রাতের রাজা হোক। বারের ক্লাবের মালিক হোক যেই হোক, তারা পুরুষ। কিন্তু নারী কেন পুরুষের অন্যায় নিয়ে সত্য বলবে? এতো সাহস যখন হয়েছেই তাহলে তার সাহসটা এবার একটু কমিয়ে দেওয়া যাক বরং। মামলা হলো, হেনস্তা হলো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখে পৈশাচিক আনন্দ। এই তো হয়েছে বেশ শায়েস্তা। বেশি ফটর ফটর? কমিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সেই মেয়ে যখন তাদের দেওয়া পুরুষতান্ত্রিক বন্দী কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে হাসতে হাসতে। মাথা নিচুর বদলে উঁচু করে। এবং হাত উঁচু করে বলে – ডোন্ট লাভ মি বিচ। তখন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পিলে চমকে যায়। আশ্চর্য হয়ে ভাবে কিছু মেয়েকে কি আমরা কখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো না? বানাতে পারবোনা আমাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা কোনো প্রভুভক্ত পশু যাকে লাথি দিলেও আমাদের পিছনে ঘুরবে? কিছু মেয়েরা কি এভাবেই চ্যালেঞ্জ করে যাবে পুরুষতন্ত্রকে? তারা কি মানবেনা দাসত্ব? পুরুষতন্ত্র এখানে মুখ থুবড়ে পড়ে, যখন মেয়ে তুমি সাহসী হতে শেখো, অন্যায়কে জোরে অন্যায় বলতে শেখো, তখনি তারা আর অপবাদ দিতে ভয় পায়, বুঝে যায় এসব জুজুর ভয় তারা পা দিয়ে মাড়িয়ে যায়। বরং তাদের প্রাপ্য সম্মানটা যেন তারা বুঝে নিতে চায়। মেয়ে তুমি সাহসী হতে শেখো। বলতে শেখো – আই ডোন্ট কেয়ার।

One thought on “‘‘কিছু মেয়েকে কি কখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো না?’’

  • লর্ড ক্লাইভ

    আপু মেয়েরা ড্রিংক্স করলে প্রব্লেম কি?? নারীদের কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে দেখার সুযোগ নেই। ছেলেদের হস্তমৈথুন করতে পারবে, মেয়েদের নিয়ে বললে, সে তো নিশ্চিত খারাফ। এরা ভাবে অর্গাজম ছেলেদেরি হয়, মেয়েদের না। মেয়েদের সতীপর্দা পরীক্ষার আগে, ছেলেদের ভার্জিনিটি চেক করা দরকার। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *