December 3, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

রফিকউদ্দিনের পাপ

ফারজানা নীলা ।। 

– বিলকিস দেখি টিভি টুভি দেখে না ইদানীং। তুমি কি ঝাড়ি দিছো?

রফিকউদ্দিন নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে তার স্ত্রী নুরজাহানকে।
নুরজাহান গরম গরম পরোটা  সেঁকে স্বামীর  পাতে দিচ্ছে। রফিকউদ্দিন মুরগির ঝোলে ডুবিয়ে খাচ্ছে।

– টিভি দেখে না তো কী দেখে? এখন মনে হয় পরীক্ষা টরিক্ষা কিছু দিছে।

রফিকউদ্দিন মুরগি রানের হাড্ডি চিবিয়ে পাতের মধ্যেই উচ্ছিষ্ট ফেলে।
বিরক্ত মুখ নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালো। নুরজাহানের ঘামে ভেজা শরীর, পুরানো মেক্সি সেই ঘামে জবুথুবু  হয়ে লেগে আছে। একহাতে বার বার কপালের ঘাম মুছে আরেক হাত দিয়ে পরোটা সেঁকছে।
স্ত্রীর এমন হাল দেখে রফিকের চোখ মুখ ঘেন্নায় কুঁচকে যায়।

সকাল সকাল আড়তে যাওয়ার অভ্যাস রফিকউদ্দিনের  বহু বছরের। এই লকডাউনের জন্য দেরি করে গেলেও হয়  তবু রফিকউদ্দিন সকাল সকাল পরিষ্কার সাদা লুঙ্গি শার্ট পরে রেডি হয়ে থাকে।

ভাদ্র মাসের বিশ্রী গরমে ঘামে ভেজা স্ত্রীকে দেখে বিরক্ত হয়ে  খাবার টেবিল থেকে উঠতে যাওয়ার সময় নুরজাহান পেছন থেকে ডেকে বলে, রান্না ঘরের ফ্যানটা ঠিক করে দেন না। কয়দিন হইছে নষ্ট হইছে। গরমে অসহ্য লাগে।

বলেই কপাল মুছল। রফিকউদ্দিন আরো বিরক্ত হলো। এক্সজস্ট ফ্যানটা নষ্ট হয়েছে আজ অনেক দিন। ঠিক করানোর কথা তার মনে থাকে না।
রফিকউদ্দিন ঘটঘট করে বের হয়ে মেয়ে বিলকিসের রুমে যায়।

মেয়ের রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
রফিক হালকা টোকা দেয়।

– মা, মা বিলকিস। উঠো নাই এখনো?
বিলকিসের  কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।
রফিকউদ্দিন আবার টোকা দেয়।
শব্দ না পেয়ে ফেরত যায়।

মেয়েটা সামনের বছর এসএসসি দেওয়ার কথা। এই করোনা টরোনার মধ্যে পরীক্ষা হবে কিনা কে জানে।
বড় আদরের মেয়ে রফিকউদ্দিনের।
সারাদিনই মেয়ে অস্থির। এক দণ্ড শান্ত থাকে না। রফিকউদ্দিন যতক্ষণ বাসায় থেকে দেখে মেয়ে নয় টিভি দেখে খলখল করছে, নয় ল্যাপটপ খুলে ক্লাস করছে, অথবা গান ছেড়ে নিজেও বেসুরা গলায় চিৎকার করে গাচ্ছে, বা বাবার কাছে রাজ্যের বায়না ধরছে।

রফিকউদ্দিন মেয়ের সব ইচ্ছেই পূরণ করে। নিজের মায়ের নামে নাম রেখেছে বিলকিস। বড্ড মায়াকাড়া চেহারা। দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে । ফ্রক ছেড়ে সেলোয়ার কামিজ ধরেছে। তবু দুষ্টুমি কমে না।

কিন্তু কয়দিন ধরে রফিকউদ্দিন খেয়াল করছে ঘরে মেয়ে আগের মত হইহুল্লোড়  করে না। বাসাটা কেমন যেন নীরব হয়ে থাকে।
ভাবতে ভাবতে রফিকউদ্দিন আড়তে যায়।

দুইটা চালের আড়তের মধ্যে একটাতেই নিয়মিত বসেন রফিকউদ্দিন। বসার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। সন্ধ্যা হতে হতে আড়তের সামনে দিয়ে একসাথে অনেক গার্মেন্টস কর্মী হেঁটে  যায়।
অনেক নারী হেটে  যায় বলা ভাল। রঙ বেরঙের সেলোয়ার কামিজ আর মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দলে দলে নারীরা যখন হেঁটে যায় আড়তের সামনে দিয়ে রফিকউদ্দিনের মনের ভেতর কেমন যেন করে। তার চোখগুলো সরু হয়ে যায় । শরীর আনচান করে নাকি বুঝতে পারে না। এই বুঝতে না পারার জন্য প্রতিদিন তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

মাঝে মাঝেই শুনতে পায় রফিকউদ্দিন আশপাশ থেকে ছোকরা পোলা মিলে অনেক কু শব্দ করে মেয়েগুলাকে দেখে। কিছু কিছু ইঙ্গিতও করে।
রফিকউদ্দিন এই বাজারের সবচেয়ে প্রভাবশালী আড়তদার। এক ধমক দিয়েই সব ঠান্ডা করে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি দেন না। তিনি দেখেন শুনেন, ভেতরে ভেতরে পুলকিত বোধ করেন।

তার নিজেরও ইচ্ছে করে কয়েকজনকে প্রাণভরে দেখতে। কিন্তু আফসোস! বয়সটা বাধা দেয়। এখানে তার একটা ভাব আছে। এই ভাব ধরে রাখতে গিয়ে ইচ্ছেমত অনেক কিছু করা হয় না।

সন্ধ্যা হচ্ছে। রফিকউদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে চেয়ার টেনে বসেন। যেন রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়।

রাতে খাওয়ার সময় রফিকউদ্দিন দেখলেন মেয়ে তার আজকেও চুপচাপ। খাচ্ছে না তেমন।

– মা খাও না কেন ঠিকঠাক? কলিজা আরও নাও। এত অল্প নিছো কেন? শরীর ঠিক আছে তো মা?
– ঠিক আছে আব্বা। বলতেও যেন বিলকিসের অনেক কষ্ট হচ্ছে।

রফিকউদ্দিন চিন্তিত হন। তার মেয়ে তো এভাবে কথা বলে না। এভাবে খায় না। এভাবে থাকে না।

আধাপেট খেয়ে শোয়ার কারনে রফিকউদ্দিনের ভাল ঘুম হলো না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো। পাশে স্ত্রী নুরজাহান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অল্প অল্প নাকও  ডাকছে।

বিরক্তির সীমা থাকে না রফিকউদ্দিনের। স্ত্রীর থলথলে শরীর নিয়ে মুখ খোলা রেখে ঘুমানোর ভঙ্গি দেখেই রফিকউদ্দিনের মেজাজ খারাপ হয়। ইচ্ছে করে এক ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিক নুরজাহানকে। ইচ্ছেটাকে খুব কষ্টে দমিয়ে উঠে ডাইনিং রুমে যান।

ফ্রিজে রসমালাই ছিল, বের করে খেতে শুরু করতেই শুনতে পায় বিলকিসের রুম থেকে কথার আওয়াজ।

এত রাতে বিলকিস কার সাথে কথা বলে?
ফোনে?

রফিকউদ্দিন উঁকি দেয় মেয়ের ঘরে। দরজা লাগানো। কিন্তু রাতের নীরবতা ভেঙে কথা দরজা ভেদ করে রফিকউদ্দিনের কানে আসে।
– আমি সব সময় ফিরোজ ভাইয়ের দোকানে যাই। সব কিছু উনার থেকে কিনি। ছোটবেলা থেকেই। আর উনি কেমনে এমন করলো আমার সাথে?

–  না না, আমি নরমালভাবেই তার কাছে খাতা কিনতে গেছি। আগেও কতবার গেছি। তুইও ছিলি না একদিন আমার সাথে?
– উনি কেমনে পারল আমাকে এভাবে ধরতে? আমি ভুলতে পারতেছি না রে। আমার অসহ্য লাগতেছে। এখনো বুকে ব্যথা লাগতেছে জানিস। এখনো মনে হচ্ছে হাতটা লেগে আছে বুকে। আমি ভুলতে পারতেছি না রে। আমার যে কেমন লাগতেছে কাউরে বুঝাইতে পারব না। মরে যাইতে ইচ্ছে  করছে।

মেয়ের কান্নার মিহি সুর রফিকউদ্দিনের কানকে ভোঁতা  করে দেয়।
রফিকউদ্দিন থ মেরে গেলেন। দরজা থেকে ছিটকে সরে গেলেন। তার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাণপনে চেষ্টা করছেন নিজের রুমে ফিরে যেতে। কিন্তু তার রুম মনে হচ্ছে শতকোটি মাইল দূরে।

তিনি খোঁড়া পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন যেন তিনি পঙ্গু। অথচ তিনি সুস্থ সবল নীরোগ  একজন মধ্যবয়সী পুরুষ।

এই পুরুষের সামনে ভেসে উঠে আজ থেকে বহু বছর আগের একটা ঝাপসা স্মৃতি। যখন তিনি পূর্ণ যুবক ছিলেন। যখন তিনিও ছিলেন মাত্র একটা দোকানের কর্মচারী। তিনিও একদিন এক সদ্য কিশোরীকে দোকানের ভেতর গোডাউনে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। জোর করে। শক্তিবলে। মেয়েটি উড়ে উড়ে আসত কোক কিনতে, পেনসিল-কলম কিনতে , চিপস কিনতে।

– ভাইয়া একটা চিপ্স দেন না!
বলত মেয়েটি।
রফিকউদ্দিন সেই মেয়েকে দেখে দেখে সুখ নিতেন। একদিন  সুযোগ বুঝে ঝাপটে ধরলেন।

মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। পাগলের মত হাত পা ছোড়াছুড়ি  করছিল।
কিন্তু রফিকউদ্দিন ছাড়ে নি। ইচ্ছেমত হাত দিয়ে যা যা পেরেছে করেছে।
মেয়েটি এরপর আর কোনোদিন  দোকানে আসে নি। মেয়েটিকে এরপর রফিকউদ্দিন আর দেখে নি।

চোখের সামনে সেইদিনের দৃশ্য জ্বলজ্বল করে ভেসে থাকল। রফিকউদ্দিন  চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তবুও সেই দৃশ্য জ্বলে রইল।

হামাগুড়ি দিয়ে রফিকউদ্দিন নিজ রুমে গেলেন। হাউমাউ করে নুরজাহানকে ডাকলেন।
নুরজাহান ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠলেন।
-কী হলো কী হলো। হ্যাঁ?  কী গো কী হলো?

-নুরজাহান নুরজাহান! রফিকউদ্দিনের বুকফাটা আকুতি।
নুরজাহান গিয়ে  স্বামীকে ধরলেন। বিছানায় বসালেন কোনোভাবে।।

– কী হয়ছে। কী হয়ছে আপনার? এমন করতাছেন কেন?
রফিকউদ্দিন কেঁদেই চললেন হাউমাউ করে।
– আমারে মাফ কইরা দাও। আমারে মাফ কইরা দাও তোমরা।
নুরজাহান বুঝতে পারলেন না কী বলছে তার স্বামী। কীসের মাফের কথা বলছে।

– কী কন এগুলা? কীসের মাফ? কী করছেন আপনে?
– আমারে মাফ কইরা দাও আমারে মাফ কইরা দাও!
রফিকউদ্দিন গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। উদভ্রান্তের মত বলতে থাকে, “আমারে মাফ কইরা দাও তোমরা সবাই। আমি পাপ করছি। পাপ। আমারে মাফ কইরা দাও”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *