November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মেয়েরা কি পাউরুটি, না কি পাকা আম?

ইশরাত বিনতে রউফ।। ছোটবেলায় বয়স্ক আত্মীয় স্বজনদের শুনতাম আম্মাকে পরামর্শ দিতেন  – “দুইটা মেয়ে, দেখে শুনে রাখবা, নষ্ট না হয়”! আমি এতোই ছোট্ট তখন যে এটার মানে জিজ্ঞেস ও করতে চাইনি।  এরপর দেখি অনেক বাংলা নাটক, সিনেমাতেই দেখানো হচ্ছে – নায়িকা ধর্ষণের শিকার হবার পর মূল নায়ক যখন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে তখন নায়িকা বলছে কেঁদে কেঁদে – ” না না না, আমাকে ওরা নষ্ট করেছে”। এরপর একদিন খবরের কাগজে একটা রিপোর্ট  দেখলাম যার সারমর্ম হচ্ছে বাংলাদেশের একটা গ্রামে এক গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন , এখন স্বামীও তাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। উনিশশ’ নিরানব্বই কিংবা দু’হাজার সালের ঘটনা, তাও আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই লোক তাকে বাসায় উঠবেনা কারণ – “সে এখন নষ্ট “। এরপর একটা গান বের হলো – এক যে ছিল সোনার কন্যা। এ গানের একটা লাইন “ও কন্যা ভুল করিস না, আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না”।  চিন্তা করলাম ভুল তো সব মানুষই করে, নারীর এ কেমন ভুল যেটা নিয়ে সবাই এত বিচলিত!

আমার আব্বাকে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসে বলেছিল “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া ভালো না, পেকে যাবে”। আমার বোন সবসময় মুখরা ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন “পেকে যাওয়াটা আবার কী?”

তার উত্তর আসলে ছিল সমগ্র পুরুষতান্ত্রিকতার উত্তর- “বেশি জানা মেয়েকে বিয়ে দাওয়া কঠিন, ছেলেরা কম জানা মেয়ে চায়”।

তার মানে হলো, পাকা মেয়ে = যার জাগতিক জ্ঞান আছে, শিক্ষা আছে, উঠতে বললে উঠে দাঁড়াবে আর বসতে বললেই বসবে না, তার বসতে ইচ্ছা হলে সে বসবে এমন একজন। যার উল্টা করলে সমাজ চায় “যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ”, নিয়ন্ত্রণই হলো মূল উদ্দেশ্য ও বিধেয়।

এইতো গেলো পাকা কাঁচার হিসাব l নষ্ট আবার  কীভাবে হয় মেয়ে?

মেয়েরা কি পাউরুটি বা পচনশীল খাদ্য যে নষ্ট হবে? তাহলে কি পুরুষ ফাঙ্গাস স্পোর ? উড়ে উড়ে এসে ছুঁলেই নারী  কিছুদিনের মধ্যে ফাঙ্গাস মোল্ডে পরিণত হয়? পরিষ্কারভাবেই সামাজিক মতবাদ অনুযায়ী এটা নারীর যৌন অধিকার ও স্বেচ্ছা/অনিচ্ছাকৃত যৌনাচারের ওপরই আবর্তিত। কমলা ভাসিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – “আমার যোনিতে সন্মান কে রেখেছে?”

খুবই মৌলিক প্রশ্ন এটা। নারীর সতীত্বের ওপর কেন দেয়াল গড়ে দেয়া ? মেয়েরা খাদ্যবস্তু  নয়  যে ফাঙ্গাস পরে নষ্ট হবে – কেউ খেতে পারবে না।  আম কাঁঠাল  নয়ও যে পেকে নষ্ট হয়ে যাবে!

এই প্রশ্নের ভেতরেই উত্তর আছে এবং নারীরই নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, উত্তর দিতে হবে ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সমাজ কী বলবে, লোক কী বলবে, নষ্ট হয়ে গেলাম, পেকে গেলাম, বাতিল হয়ে গেলাম – এসব হলো এক ধরণের মানসিক দেয়াল,  সামনের দিকে এক পা দিলেই পার হয়ে আসা যায়।

নষ্ট মেয়ে নাম দিয়ে মেয়ে ও তার আশেপাশের মানুষকে অবদমন এক পুরোনো কৌশল, যা ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এক জলজ্যান্ত উদাহরণ প্রভা, জীবনের ঘটনা দুর্ঘটনা তোয়াক্কা না করে দিব্বি তার কাজ ও জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। তার জায়গায় অনেকেই হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো, কারণ আমরা তো “ভুল করা কন্যা” আর “নষ্ট মেয়ে”তেই বিশ্বাসী l মেয়েগুলোকে দেয়াল এ পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছি।

আমার এক সহকর্মী ছিলেন, যার বোন কে তার স্বামী শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতেন ” ব্যাংকের মেয়েরা নষ্টা, পুরুষের সাথে বসে কাজ করে”। এগুলো গৃহবধূকেও শুনতে হয়, কোম্পানির মালিককেও শুনতে হয়, চিত্রনায়িকাকেও শুনতে হয়।

সুতরাং, নষ্ট মেয়ের তকমা গায়ে নিয়েও নিজ উদ্দেশ্যে চলতে হবে, কারণ ওই দিন আর নেই যে মেয়েরা নষ্ট হবার আর পেকে যাবার ভয় করবে। বরং আত্মস্থ করুন, বলুন –  “নষ্ট মেয়ে বলে রুখতে পারবা না “

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *