November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আদিবাসী নারীর প্রতি বাঙালি পুরুষের ফেটিশ: সব যৌনতা ভালবাসা না

নাবিলা ওরিয়ানা ।। কিছুদিন আগে সাদী শাশ্বত নামের একজন কবির লেখা ‘পাহাড়ে চলে যাবো’ নামক একটি কবিতা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে ফেসবুকে। সেখানে কবি চাকমা মেয়েকে বিয়ে করার বাসনার কথা জানিয়েছেন। আদিবাসীদের জীবনযাপন এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে তিনি কী কী শুনেছেন সেসব লিখেছেন এবং ‘উন্মুক্ত উপত্যকায় তাদের সঙ্গে উদাসীন সঙ্গমে মেতে থাকা’-র বাসনা প্রকাশ করেছেন।

এখানে অনেকেই তার বিপক্ষে, আবার অনেকে তার পক্ষেও কথা বলছেন। আমি পক্ষে নাকি বিপক্ষে সে কথায় যাবার আগে আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা শেয়ার করি।

ঘটনা ১: বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। তো সে আর আমি একদিন বাইরে খাওয়ার জন্যে একটি শপিং প্লাজা গোছের জায়গায় বসি। আমরা যেই ক্যাফেটেরিয়াতে বসে খাবার অর্ডার করি, তার ঠিক সামনেই ছিল একটা মেকানিকাল বুল রাইড। যখন আমরা বসে খাচ্ছিলাম, তখন সেখানে আমাদের সামনেই একটি আদিবাসী তরুণী ওঠে। এটা দেখে আমার প্রেমিক আমাকে বলে যে চাকমা মেয়েরা নাকি বিছানায় বেশ ভালো। কারণ পাহাড়ি হওয়ায় তাদের অনেক বেশি স্ট্যামিনা থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কীভাবে জানে সেটা? সে আমাকে বলল যে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে সে এসব শুনেছে।

ঘটনা ২: আমার একজন বেশ পুরোনো বন্ধুর সাথে দুবছর আগে একদিন আমার ফোন কলে আলাপ হয়। তখন সে কথা বলতে বলতে একসময় তার বন্ধুদের সাথে বান্দরবান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আমার সাথে।

শহর ছেড়ে সেখানে গিয়ে কীভাবে সে আর তার বন্ধুরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পেরেছে, সেখানকার দিনগুলো কীরকম স্বপ্নের মতো ছিল, সেসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে বলে, সেখানকার মেয়েরা নাকি বেশ আকর্ষণীয়। ওখানকার সুন্দরী মেয়েরা যেভাবে তাদের যত্নআত্তি করছিল, তাতে তার এবং তার বন্ধুদের নাকি ইচ্ছে করছিল বিয়ে করে সেখানে থেকে যেতে। শহরে এরকম পাহাড়ি মদ খাওয়া যায় না, এরকম স্বাধীনভাবে থাকা যায় না। তাই এখন নাকি তার ফ্যান্টাসি হয়ে গেছে, চাকমা মেয়ে বিয়ে করার।

ঘটনা ৩: এ বছরই কয়েক মাস আগে আমার আঠাশ বছর বয়সী একজন ফটো জার্নালিস্টের সাথে পরিচয় হয়। তার সাথে কথা বলে ভালো লাগায় আমি তার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট শো করি এবং সেও তাতে সাড়া দেয়। তার সাথে কথা বলতে বলতে সেও একসময় আমার ওই বন্ধুটির মতোই বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলের মুক্ত-স্বাধীন জীবন, শুকরের মাংস আর মহুয়া খাওয়া, এবং সেখানকার মেয়েদের সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করতে থাকে।

যাই হোক, কিছুদিন যাওয়ার পরই আমি বুঝতে পারি যে সে শুধুমাত্র আমার সাথে শয্যায় যেতে চায়, আর কিছুই নয়। তার আমাকে এসব ইন্টারেস্টিং গল্প শোনানো এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করে আমাকে ইমপ্রেস করার উদ্দেশ্যও সেটাই। এবং একই কাজ সে অনেক মেয়ের সাথেই করে। একদিন তার সাথে আমার কোনো এক কারণে ঝগড়া হয় এবং আমরা সব ধরণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর অনেকের কাছ থেকে এও জানতে পারি যে সে বেশ কয় বছর আগে পালিয়ে এক চাকমা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। এ কথা জানতে পেরে আমি বেশ অবাক হই, কারণ চাকমা মেয়েদের প্রতি তার আকর্ষণের কথা আমাকে বললেও সে কখনোই আমাকে তার বিয়ের কথা বলে নি। সেজন্য আমি ধরেই নেই যে মেয়েটির সাথে তার সেপারেশন অথবা ডিভোর্স হয়ে গেছে এবং সেটা নিয়ে আর তেমন মাথা ঘামাই না।

কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাকে একজন চাকমা মেয়ে মেসেজ দেয় এবং জানায় যে সে-ই ওই লোকের স্ত্রী। তাদের সেপারেশন অথবা ডিভোর্স কিছুই হয় নি, বরং তাদের দেড় বছর বয়সী একটি মেয়েও রয়েছে! একথা জানতে পেরে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। সে মেয়েটির সাথে প্রেম করলো এবং পালিয়ে বিয়েও করলো। একটি সন্তানও এখন আছে তাদের। এ অবস্থায় সে কী করে আমার সাথে এবং অন্য অনেক মেয়ের সাথে শয্যায় যেতে চায়?

সাদী শাশ্বতর কবিতা পড়ে অনেক আদিবাসীই বেশ চটেছেন, এবং তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও কারণও রয়েছে। এই তৃতীয় ঘটনার আগে পর্যন্ত আমি সবসময়ই মনে করতাম, যে আদিবাসীরা, মূলত চাকমা নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বাঙালি মুসলিমদের কোনো কারণ ছাড়াই ঘৃণা করে আসছে। তবে এ ঘটনার পর আমি বুঝতে পারলাম যে আসলে তারা ভুক্তভোগী। তাদেরকে যেভাবে বাঙালিরা অব্জেক্টিফাই করে আসছে, সেটা তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে শুধু। যেই মেয়েটির ওই ফটোজার্নালিস্টের সাথে একটি সন্তান রয়েছে, তার কথাই এখন ভেবে দেখুন একবার। এখন সে কোথায় যাবে? পালিয়ে বিয়ে করায় এখন নিশ্চয়ই সে তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারবে না? গেলেও তার এই সন্তানটির দায়িত্ব কে নেবে?

উপরের এই তিনটি ঘটনা হলো আমাদের দেশের বাঙালি পুরুষদের রেসিয়াল ফেটিশাইজেশন- এর কিছু নমুনা। ‘রেসিয়াল ফেটিশাইজেশন’ আসলে কী? রেসিয়াল প্রেফারেন্স এবং ফেটিশাইজেশন এক নয়। ফেটিশাইজ করা মানে একটি নির্দিষ্ট রেইস কিংবা গোত্রকে নিয়ে অব্জেক্টিফিকেশন, স্টেরিওটাইপিং ও জেনারালাইজেশন করা। ল্যাটিন মেয়েদের চামড়ার রঙ এক্সোটিক, এশিয়ান মেয়েরা হাইপারসেক্সুয়াল এবং সাবমিসিভ, চাকমা মেয়েরা বিছানায় ভালো ও তাদের স্ট্যামিনা অনেক – এগুলো সবই স্টেরিওটাইপিং ও জেনারালাইজেশনের নমুনা।

যেহেতু সেই তিন ঘটনার মাঝে তিনজন পুরুষই কোনো না কোনোভাবে আদিবাসী মেয়েদেরকে নিয়ে এর সবকটিই করেছে, সেহেতু নিশ্চয়ই সেটা আর তাদের ‘রেসিয়াল প্রেফারেন্স’-এর মাঝে পড়ে না। এখানে তারা কেউই একটি আদিবাসী মেয়ের প্রেমে পড়ে নি। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল যেকোনো আদিবাসী মেয়ের সাথে প্রেম করা অথবা তাদের বিছানায় নেয়া।

বাঙালি পুরুষদের উদ্দেশ্য যদি হতো কোনো পাহাড়ি মেয়েকে ভালোবাসা, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা ছিল না। তবে এখন পর্যন্ত আমি যত বাঙালি ছেলেকে দেখেছি পাহাড়ি মেয়েদের সাথে প্রেম বা বিয়ে করা নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করতে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুরোটাই সেক্সুয়াল। আদিবাসী মেয়েরা ‘বিছানায় ভালো’ এ কথা প্রচার করে, কিংবা পাহাড়ে তাদের স্বাধীন জীবন, মহুয়া খাওয়া দেখে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি এসব পুরুষেরা তাদেরকে শুধু ভোগ করতে চায়। এরপর এই ‘স্বাধীন জীবন’-এর স্বাদ নেয়ার উদ্দেশ্য হাসিল হবার পর, তাদের ‘ব্যবহার’ করা শেষ হবার পর ছুড়ে ফেলে দিতে চায়।

রাজনৈতিক সামাজিক কারণে চাকমা এবং বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেটি এক অধ্যায় ও এ নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক আছে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম পুরুষেরা যে আদিবাসী নারীদের ‘ভোগের বস্তু’ হিসেবে দেখতে অথবা চিন্তা করতে বেশ ভালোবাসে, সেটা যে মিথ্যা নয়, বরং বহুলাংশে সত্য, তা আমার নিজের অভিজ্ঞতায় পাওয়া সেই তিনটি ঘটনা থেকেই বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়।

শুধু আদিবাসী নয়, বাংলাদেশের হিন্দু মেয়েদেরও রেহাই নেই এদের থেকে। এ দেশের অনেক মুসলিম ছেলেদের কাছেই হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম করা তাদের একটি ‘ফ্যান্টাসি’। আমি একবার আমাকে পছন্দ করে এমন এক লোকের সাথে কথা বলবার সময় তাকে যখন জানাই, যে আমার হিন্দুধর্মের ব্যাপারে অনেক আগ্রহ রয়েছে, তখন সে বেশ হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বলে, “ভালোই হলো। আমার একটা হিন্দু গার্লফ্রেন্ডের শখ খুব।” তার এই কথা থেকে বেশ পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, হিন্দু মেয়েদের ‘টার্গেট করে’ তাদের সাথে প্রেম করার বাসনা রয়েছে তার মনে। এবং এ ধরণের সুপ্ত বাসনা এই দেশের মুসলিম বহু পুরুষের মাঝেই দেখা যায়।

আরও পড়ুন- বাঙালি পুরুষের ফ্যান্টাসি এবং যা কিছুর ভিতরে আমরা থাকি

এখানে আমি এটা বলছি না, যে ভিন্ন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক বা বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা খারাপ কিছু। আমার পরিচিত একটি ছেলের স্ত্রী আদিবাসী এবং তাদের একটি সন্তানও রয়েছে। ছেলেটির পরিবার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মেয়েটিকে মেনে নেয় নি। কিন্তু তবুও যত কষ্টই হোক, ছেলেটি তার স্ত্রী এবং সন্তানকে আগলে রেখেছে। কারণ মেয়েটিকে সে তার ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের কারণে ভালোবাসে নি। মেয়েটিকে নিছক ফ্যান্টাসির কোনো বস্তু হিসেবে দেখে নি সে।

তবে আর দশজন বাঙালি পুরুষ তো আর সেটা করবে না। এরা আদিবাসী মেয়েদের সাথে ‘উদাসীন সঙ্গমে মেতে ওঠা’ নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করবে, নিজেদের সম্প্রদায়ের নারীদের ধর্মের দোহাই দিয়ে বন্দী করে রাখতে চেয়ে আদিবাসীদের মাতৃসূত্রীয় সমাজকে প্রেইজ করবে, এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, আদিবাসীদের এদেশে নিজেদের মতো করে থাকতেও দেবে না, শুধু তাদের দেখবে নিজেদের ভোগ করার বস্তু হিসেবে।

আদিবাসীদের স্বাধীন, সুন্দর জীবন আর মাতৃসূত্রীয় সমাজ দেখে আমাদের পুরুষেরা তাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে; এরপর তাদেরকে বিয়ে করে এনে, তাদের গোষ্ঠীর থেকে আইসোলেটেড করে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এনে তাদের বন্দী এবং ‘সভ্য’ করার চেষ্টা করবে – এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সাদী শাশ্বতর এই পুরো কবিতা জুড়েই নানান স্টেরিওটাইপিং এবং ফ্যান্টাসির চিত্র দেখা যায়। বাঙালি পুরুষেরা আদিবাসীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাদের লাইফস্টাইল দেখে ঠিকই, কিন্তু পরে চায় তাদেরকে বদলে ফেলে নিজেদের সমাজে আনতে। ওদের সমাজের অংশ তারা কখনোই হতে চাইবে না। সুতরাং বাঙালি পুরুষদের এই ‘ফেটিশ’ আচরণ যে কোন কমপ্লিমেন্ট অথবা ভালোবাসার প্রকাশ নয়, সেটা বুঝুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

8 thoughts on “আদিবাসী নারীর প্রতি বাঙালি পুরুষের ফেটিশ: সব যৌনতা ভালবাসা না

  • ধৈর্য্য চাকমা

    গারোরা বাদে বাকি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ সবার পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।

    Reply
  • Abghout

    একজন বাঙালি মেয়ের বাহ্যিক চাহিদা কম থাকলে আদিবাসি পুরুষের সাথে সে সবচেয়ে সুখে জীবন কাটাতে পারবে,, এটা নিশ্চিত সে আপনাকে ঠকাবেনা, শারিরিক ও মেন্টালি টর্চার ও করবেনাম। যৌতুকের দাবিও করবেনা। যেখানে বাঙালি পুরুষ ৬০% একাধিক মেয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক রাখে, সেখানে আপনি ঠকবেন না তার নিশ্চয়তা কি??

    Reply
  • surupa chakma

    খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন ধন্যবাদ

    Reply
    • Tanimong Marma

      খুব সুন্দর উপস্থাপনা করেছেন আপু।

      Reply
  • surupa chakma

    সুন্দর ভাবে উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ

    Reply
  • রিমন ত্রিপুরা

    আপনি যা লিখেছেন সবই সঠিক। তবে আরোও লেখালেখি করার জন‍্যে আদিবাসীদের সম্পর্কে আপনাকে আরো জানতে হবে।
    আরেকটি বিষয়ে আপনাকে জানতে হবে গারো সম্প্রদায় ব‍্যতিত সকল সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা পিতৃতান্ত্রিক।

    Reply
  • Jibon chakma

    একটা কথাও ভুল নয়,একদম সঠিক কথা বললেন আপু,আপনার ৩ টি ঘটনা আমিও অনেকবার প্রমাণ পেয়েছি।

    Reply
  • Subhas Chakma

    আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো পাহাড়ি আদিবাসী মাতৃতান্ত্রিক নয়, তবে আমাদের সমাজে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে এইটা সঠিক।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *