যে পুরুষতন্ত্র থেকে সহজে মুক্তি নেই
ফুয়াদ হাসান ।। সাম্প্রতিক সময়ে একজন চিত্রনায়িকাকে নিয়ে যা ঘটলো তা নিয়ে বিশদ আলোচনায় আর যেতে চাই না। বিচার ব্যবস্থা, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়েও কিছু বলার নেই সেটা রাষ্ট্রযন্ত্রই ঠিক করে দেয় বা দেবে। সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডকেও যুক্তি, আইন ও গণতন্ত্রায়ণের নামে জায়েজ করা হয়েছিল। তাই ওদিকে আর যাচ্ছি না। নায়িকা পরীমণি অপরাধী না অপরাধী নয়, বা কতটুকু অপরাধী সেই মানদণ্ড তোলা থাকলো কিন্তু তার ওপর রাষ্ট্রের পুরুষতন্ত্র যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো – প্রশ্ন সেখানটায়! অথচ, প্রায় একই দোষে দুষ্ট পুরুষগুলো কী বীর দর্পে তথাকথিত সমাজের চোখে মুলা ঝুলিয়ে সম্মানিত বনে রইল। একে তাই স্রেফ বর্ণবাদে আবদ্ধ না-রেখে শ্রেণিবৈষম্যেরও উদাহরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সাক্ষ্যরূপে আসতে পারে নানা জায়গায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও আমজনতার বক্তব্য। বস্তুত আমরা কেমন বা কেমন সমাজ নির্মাণ করতে চাই তার ছায়াছবি স্পষ্টত প্রতীয়মান!
নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া প্রাসঙ্গিক আরও কিছু বিষয়ে বলার তাড়না অনুভব করছি। বিশেষ করে অল্প সময়ের ব্যবধানে নারীদের নিয়ে সংঘটিত এমন কিছু ঘটনা যা একজন পুরুষ কিংবা মানুষ হিসেবে আমাকে ভাবনার উদ্বেগ ঘটিয়েছে।
নারীদের নিয়ে আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া মন্তব্যগুলো দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের কথিত শিক্ষিতদের মননের আদ্যোপান্ত সহজেই অনুমেয় প্রকাশিত মতামতগুলো জানলে। এমন কি সুশীল বা প্রগতিশীল দাবি করা সুবিধাবাদীদেরও!
গুলশানের ফ্ল্যাটে কলেজ ছাত্রী মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ নিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’ মামলার পর আমাদের মিডিয়ার রহস্যময় নীরবতা এবং ঐ মৃত তরুণীকে নিয়ে বিভিন্ন রুচিহীন মন্তব্য যতটা না অবাক করেছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি ঘটনাটার পর জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ফেসবুক আইডিতে একটি স্ট্যাটাস। বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার চাকরি বাঁচাতে তাকে বলতে হয়েছে, “আমি গর্বিত যে আমি ১২ বছর ধরে কালের কণ্ঠে কাজ করি, ১০ বছর ধরে সম্পাদক”। এতো অর্থ-যশ-সম্মানের মালিক তাঁর মতো জনপ্রিয় ধারার এমন একজন বরেণ্য ঔপন্যাসিকের যেখানে চাকরি হারানোর এমন ভয় সেখানে সাধারণ সংবাদকর্মীদের কী আর দোষ দেবো! যেখানে অর্থের প্রলোভনে আমরা সকলেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছি; পুঁজিবাদী সমাজ বাস্তবতায় সেটা না-হয় স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে এ ধরনের কিছু ঘটলে প্রথমে আমরা সদলবলে ঐ নারীকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলি। দোষটা যেন একমাত্র তারই! দোষ না হয় হতে পারে, তাই বলে, বিষয়ের বাইরে গিয়ে নারীটিকে অপমান করে, গালি দিয়ে, চরিত্র বিষয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অশ্লীল গল্প নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে পারলেই যেন নিশ্চিত জয়। ঘটনাটা শুধু এ ক্ষেত্রে নয়; বেশ কিছু দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, যখনই কোন নারী কোনো বিষয়ে আলোচনায় আসছে তখনই একটি পক্ষ তার জীবনীকার হয়ে উঠছে। পাশাপাশি আমাদের মিডিয়ার দেউলিয়াপনার সুযোগে কিছু ভুঁইফোড় চ্যানেল নির্লজ্জভাবে যেকোনো নারীকে নিয়ে যা ইচ্ছে বলতে এবং গল্প বানিয়ে ফেলতে এক মুহূর্ত সময় নেয় না।
সবকিছুতে নারীকে অবদমনের চেষ্টা চোখে পড়ে।
নারীর এতো শিক্ষিত হওয়ার দরকার কী, ও এতো রাত পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকে কেন, সে গার্মেন্টসে চাকরি করে কেন, ওর মিডিয়ায় কাজ করার দরকার কী, ওদের পোশাক এমন কেন যদিও বোরখা পরেও রেহাই পাওয়া যায়নি!
এটা না হয় অর্থের কাছে আমাদের বিবেককে বিকিয়ে দেয়া বা দলকানা লোকদের একপেশে চিন্তার নিদর্শন কিন্ত নারীর প্রতি আমাদের কথিত শিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা তো এবারের মা-দিবসকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মায়ের ছবিসহ একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বেড়িয়ে এসেছে। ওসব তো আর অশিক্ষিত মূর্খের দল করেনি কারণ তারা অসাম্প্রদায়িকতার গল্প বলে মুখে ফেনা তোলা সুশীলদের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রীতিপ্রবণ, বহুগুণ মানবিক।
সেই তুলনায় আমরা কথিত শিক্ষিতরাই অধিক বিকারগ্রস্ত, কূপমণ্ডুক, মনমানসিকতায় মধ্যযুগীয়। মা জাতিকে তাই শাঁখা-সিঁদুর, বোরকা-নেকাবে চিহ্নিত করি! অর্থাৎ বাকি সবকিছু ছাপিয়ে মায়ের ধর্ম পরিচয়টা মূখ্য হয়ে ওঠে। জাতির পঞ্চাশবছর পূর্তিতে এও আমাদের এক বিরাট প্রাপ্তি বটে!
যতই আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই না কেন আমরা, ভাবি– আমরা তো সেই পূর্বপুরুষের প্রতিনিধিত্ব করছি, যারা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের পক্ষে ৯৮৭টি সইয়ের বিপরীতে ৩৬৭৬৩টি সই করেছিল।
এসবের পাশাপাশি ‘প্রথম আলো’র জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের প্রতি আমলাতন্ত্রের হামলায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার ধরন। সচিবালয়ের নারী কর্তৃক এই আঘাত, হেনস্তা নিছক একজন নারীকে মনে করলে চলবে না। এই আঘাত দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পুরুষতান্ত্রিক শাসকশ্রেণির। নারীকে একা পেয়ে অন্য ক্ষমতাধর নারীও কেমন সুযোগ বুঝে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে তার একটি জলন্ত উদাহরণ হতে পারে এটি। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে মোক্ষম প্রতিশোধ নেওয়ার এই রাজনীতি দেশকে কোন রসাতলে নিয়ে যাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। প্রকৃত পুকুরচুরির দল আড়ালেই থেকে যায় আর সে-সব রহস্য অন্ধকার থেকে আলোতে আনতে গেলেই বিপদ; ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রীয় নথি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার ও নির্যাতন।
সবশেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন নারী কথাসাহিত্যিক-অনুবাদকের অনূদিত বই নিয়ে আরেক পুরুষ কবি-অনুবাদকের একটি স্ট্যাটাস ও তার পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। লেখক শিবিরে এ ধরনের তর্ক-বিরোধ হরহামেশা লেগে থাকে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ও আপত্তিকর ঘটনা ঘটলো যখন দু-পক্ষের যুক্তি-পাল্টাযুক্তির মধ্যে অনুবাদকের পক্ষ নেওয়া অন্য একজন কবি-অনুবাদককে যখন ব্যক্তিগত আঘাত করে ‘রক্ষিতা’ বলেন, যুক্তিতে হেরে গিয়ে অথবা নারীকে ছোট করার জন্যে এভাবে একজন শিক্ষিত, চিন্তাশীল তথা কবির মতো অনুভূতিপ্রবণ মানুষ যখন এমন শব্দ ব্যবহার করেন তখন বুঝে নিতে হবে আমাদের অন্য কোথাও গলদ রয়েছে। সেটা ঠিক অর্থ দিয়ে, দেশ-বিদেশের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
আমাদের এই রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনন বুনে দিয়েছে, যা থেকে চাইলেও আমাদের সহসা মুক্তি নেই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]