নিপীড়ন ও বিচ্ছিন্নতা
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। বর্তমান কালে ধর্ষণ শব্দটির টিআরপি সবচেয়ে বেশি। রোজকার খবরের কাগজ থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা, সিরিয়াল, সিনেমা – প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এই ঘটনাটির আকর্ষণ ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা সর্বাধিক। ধর্ষণ শব্দটা আসলে মেয়েদের সাথেই অধিক সম্পর্কিত। বিকৃত কামনাবাসনা মেটানোর ও প্রতিশোধ নেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এই অস্ত্রে মেয়েরা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আসলে শুধু মেয়ে কেন, কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষই জবরদখলীকৃত আনন্দ নিতে পারে না। দুম করে কেউ যদি আপনাকে কাতুকুতুও দেয়, তাতেও বিরক্ত লাগে। ধর্ষণের প্রেক্ষিত যেমন অনেক বৃহত্তর তেমনি ধরণগুলিও। জীবনের অলক্ষ্যেই কখন যেন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ‘আরে এইতো সেই মেয়েটা বা ছেলেটা’, ‘চুপ চুপ, ও শুনতে পাবে’, ‘নিশ্চয় ওর-ও কোনো দোষ ছিল, কই আমাদেরতো কেউ ধর্ষণ করতে আসছে না?’, ‘এরকম পোশাক পরে রাস্তাঘাটে বেরোবার দরকার কী বাপু?’- ‘ছেলেদের আর দোষ কী বলো! আজকাল মেয়েদের বেলেল্লাপনা যে হারে বেড়েছে,’ ‘বেশি কথা বলবিনা, ঘরে লোক ঢুকিয়ে দেব’ ‘যাই বল, মেয়েরাও কিন্তু কম যায় না’- এই হলো আমাদের মা- মাসিদের গল্পের খোরাক ও পরিচিত মানসিকতা।
ছেলেদেরও ধর্ষণ হয়। বরং যৌন ধর্ষণ ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত ভাবে বেশি ঘটে। শিশু ছেলেরা ধর্ষকদের কাছে খুবই লোভনীয়। এক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক কম। তারা যে শুধুমাত্র পুরুষদের হাতেই নির্যাতিত হয় তা নয় বরং প্রাপ্তবয়স্ক, বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা উভয়ের হাতেই নির্যাতিত হয়। হ্যাঁ, ছেলেরাও জানে বিষয়টা কতটা অস্বস্তিকর ও লজ্জাজনক। বলতে পারেন কিশোর বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের ধর্ষণ বা যে কোনো প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা খবরের কাগজের পাতায় আসে না। যারা এই ধরণের নির্যাতনের শিকার হন তাদের কাছে এটা এক প্রকার পুরুষত্বহীনতা। কারণ পুরুষ হওয়ার কতকগুলো বিশেষ বিশেষত্ব আছে। সেখানে অযথা কান্নাকাটি মানায় না। তাছাড়া তাদের মানসিক ক্ষতি বা যা-ই হোক না কেন, গর্ভে অযাচিত সন্তানও চলে আসে না। তবুও কোথাও কোথাও মানসিক ক্ষতির পরিমান এতটাই বেশি হয়ে যায় যে বেচারা ছেলেটির সারাজীবন সেই ক্ষত শুকোয় না এবং কাউকে প্রকাশ পর্যন্ত করতে পারেনা। কারণ বিপরীতধর্মী খাদ্য খাদকের সম্পৰ্কটি এক্ষেত্রে পরিচিত গোত্রের নয়।
ছেলে বা মেয়ে যেই হোক, তারা সবচেয়ে কোথায় বেশি ধর্ষিত হয় নিশ্চয় জানেন? তার নিজ আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনের দ্বারা, এমনকি যিনি জন্ম দিয়েছেন তার দ্বারাও। যদিও অপরিচিতরাও সুযোগ নিতে সবসময় প্রস্তুত। অবশ্য আমরা কেউই কম যাই না। একটা মেয়ের পোশাকের আবৃত ও অনাবৃত অংশ নিয়ে যেমন রসালো আনন্দ লাভ করি তেমনি অনেকেই আছেন যারা নিজের ছেলে মেয়েকে পর্যন্ত রেহাই দেন না। লজ্জাজনক ঘটনার কথা প্রকাশ করলে তো তাকেই বেশি লজ্জিত হতে হয় অপরাধীর থেকে। সামান্য ঋতুচক্রের প্রকাশ যেখানে অপ্রীতিকর সেখানে এই ধরণের কাজকর্ম প্রকাশ যেন বিরাট অন্যায়। শিশুরা আজ সবদিক থেকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত মানুষ।
বিভিন্ন কিশোর হোম বা অনাথ আশ্রমগুলিতেও এই ধরণের ঘটনা খুবই ঘটে। দুর্বল, পরনির্ভর ছেলেরা মেনে নেয়, আবার কেউ কেউ পালিয়ে বেড়ায়। শুধু কি অনাথ ছেলে মেয়ে? সিসিটিভি বসানো স্কুলের শিক্ষক, স্কুল বাসের কাকু, কিন্ডার গার্টেন স্কুলের আয়া মাসী, ভার্চুয়াল বন্ধু- সকলেই যেন সুযোগের অপেক্ষায়। এ শতাব্দীর হায়না। আর যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা এই আক্রমণের শিকার হয়, তাদের ট্রমা কাটিয়ে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসাটা একটু হলেও সহজ হয় যদি আমরা এই ঘটনাগুলিকে অন্যান্য দুর্ঘটনার আঙ্গিকে বিচার করি, যাতে সে সহজে প্রকাশ করতে পারে। তবুও কোথাও যেন এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাথে পুরুষ হওয়ার শিক্ষা ছেলেটির আত্মশক্তির বিকাশ ঘটায়। কারণ পৌরুষ মানেই হলো সমাজের গড়ে দেয়া সেই আত্মশক্তি যা দুর্জয় দুর্ভাগ্যকেও জয় করতে শেখায়। কিন্তু শারীরিকভাবে ধর্ষিত মেয়েটিকে আমরা কতখানি শক্তি জোগাতে পারি, যেন সেই শক্তিতে সে তার আত্মশক্তি ফিরে পায়?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
এসিড সন্ত্রাসের অনেকটা লাঘব হয়েছে ; ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন দরকার ৷