November 2, 2024
কলামফিচার ৩

পুরুষ যৌনকর্মী ও নারীবাচক গালি

শাহাজাদী বেগম ।। পদে পদে অসমতা নারীকে বেশিরভাগ সময় তার অধঃস্তন অবস্থানকে ভবিতব্য কিংবা ভাগ্য হিসাবে ভাবতে শেখায়। ফলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে অবস্থা ও অবস্থানের নারী-পুরুষ অসমতা একজন নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে দেয় না। ‘জোর যার মুল্লুক তার, এই জোর সেই করতে পারে যার শক্তি বেশি’- বহুল প্রচলিত এমন ধারণার কারণে পুরুষ তার শক্তি প্রদর্শনে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকে। নারী সেটাকেই নিয়তি ধরে নিয়ে নিজের শক্তি খুঁজে দেখার প্রয়োজন মনে করে না।

সময়ের সাথে প্রেক্ষিত বদলায়, ধ্যান ধারনা বদলায়। ক্রমেই নারী নিজের ভিতরের শক্তি খুঁজতে শুরু করে। সেই শক্তির অস্তিত্ব একজন নারী খুঁজে পাওয়ার আগে থেকেই পুরুষ জানে। তাইতো আটঘাঁট বেঁধে পুরুষতন্ত্র ঘাঁটি গাড়ে, শক্ত-পোক্ত করে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব। শত শত বছর ধরে এই পুরুষতন্ত্রের শিকড়ে আটকে থাকা নারীরা যখন নিজের কথা ভাবতে শেখে, একটু মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, ঘরে-বাইরে থেকে আঘাতগুলো ঠিক তখনই আসে।

নিজের অস্তিত্ব নিয়ে একজন মাথা তুলে দাঁড়ানো নারীকে দমিয়ে রাখতে হলে সবচেয়ে  ধারালো অস্ত্র তার চরিত্রে আঘাত করা। কোনোভাবে তাকে চরিত্রহীন বা খারাপ বলতে পারলেই হল। প্রমাণ করারও দরকার হবে না, নারী মানসিকভাবে ভেঙ্গে  পড়বে। কাজেই নারীর সোজা ঘাড় ভেঙ্গে দিতে চাইলে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর নেই। চরিত্র হননের সবচেয়ে সহজ ও বহুল ব্যবহৃত কৌশল হচ্ছে নারীকে গালি দেওয়া। সেই গালির মধ্যেও আবার একেবারে নিম্ন স্তরের গালি হল নারীর যৌনতা বিক্রি। এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু শব্দ প্রচলিত আছে যেমন মাগী, বেশ্যা, পতিতা, খানকি  প্রভৃতি। যেগুলো শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। এসব শব্দের পুরুষবাচক শব্দ নেই ভেবে নারীরা যতই হা পিত্যেস করে, পুরুষেরা ততই  তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

এই যৌনতা বিক্রি পেশা হিসাবে নিতে যারা বাধ্য হয়েছে, আধুনিক সময়ে মানবাধিকার ও পেশার সম্মানের কথা মাথায় রেখে তাদেরকে ‘যৌনকর্মী’ বলা হয়। তাতে অবশ্য পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক নারী-পুরুষের কিছু এসে যায় না। তারা সময় বুঝে ঐসব গালিই ব্যবহার করে নিজের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য।

যদি প্রশ্ন করা হয় যৌনকর্মী কারা?

এক কথায় সমস্বরে উত্তর আসবে, নারীরা।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যৌনকর্মী নারী এবং পুরুষ উভয়েই। এই বাংলাদেশেই পুরুষরা ‘যৌনতা বিক্রি’ পেশা হিসাবে নিয়েছে অনেক বছর আগে। ক্রমাগত সেই সংখ্যা বাড়ছে। অন্তত তিন যুগের কথা এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচিতে কাজ করা মানুষগুলোই বলতে পারবে।

সরকারি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে পুরুষ যৌনকর্মীদেরকে এইচআইভি ও এইডস এবং যৌনস্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। ইংরেজীতে পুরুষ যৌনকর্মীদেরকে Male Sex Worker (MSW) বলা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস কর্মসূচীর ২০১৫ সালের  হিসাব অনুসারে দেশে পুরুষ যৌনকর্মীর আনুমানিক সংখ্যা ২৬২৩৭ জন। অনুমান করা হয় এদের প্রকৃত সংখ্যা ২২৬৯৮ থেকে ২৯৭৭৭  জনের মধ্যে হবে (source: Size Estimation 2015, National AIDS/STD Program, Directorate General of Health Services)। এই পুরুষ যৌনকর্মীরা অর্থের বিনিময়ে খদ্দেরের সাথে যৌনকাজ করে। একসময় বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কাস্টমার ধরত। এখন মোবাইল, ইন্টারনেট, বিভিন্ন সাইট ও দালালের মাধ্যমে খদ্দের যোগাড় করে। তবে আর্থ- সামাজিক অবস্থানে সুবিধাভোগী শ্রেণির পুরুষ যৌনকর্মীদের মাধ্যম ভিন্ন। কাজেই মাগী, বেশ্যা, পতিতা, খানকি ইত্যাদি অবনামনাকারী শব্দ একচেটিয়া নারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও এই শব্দগুলো সমানভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই  বিশেষ্য ও বিশেষনগুলোকে নারীবাচক হিসাবে ব্যবহার করার প্রচলন আসলে পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা। এগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ অভিধানে  না থাকলেও  এগুলোর আদতে কোন লিঙ্গ নেই।  অর্থ, উপহার বা বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে যারা যৌনতা বিক্রি করে, সে নারী বা পুরুষ যাই হোক না কেন, উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান অর্থ বহন করে। ব্যবহারের সুবিধার জন্য  খুব সহজেই এগুলোর সাথে পুরুষ শব্দটি বসিয়ে ব্যবহার করা যায় যেমনটি বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থা ব্যবহার করে। উদাহরন হিসাবে যেমন – নারী যৌনকর্মী, পুরুষ যৌনকর্মী, হিজড়া যৌনকর্মী ইত্যাদি। একইভাবে পুরুষ বেশ্যা, পুরুষ পতিতা, পুরুষ খানকি, পুরুষ মাগী  প্রভৃতি পুরুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহারযোগ্য শব্দ।

বাংলা অভিধানে না থাকলেও ‘পুরুষ যৌনকর্মী’ সরকারি জাতীয় কৌশলপত্র, গবেষনাপত্রসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে অনেক বছর ধরেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি  একটি ওয়ার্কিং টার্ম অর্থাৎ  কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য শব্দ। কাজেই এটি স্বীকৃত শব্দ। আর ‘পুরুষ বেশ্যা’ সাম্প্রতিক গল্প-উপন্যাসে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। গণহারে নারীকে এসব শব্দে গালাগালি করার যে প্রবণতা চলছে তাতে করে খুব শিঘ্রী একই শব্দ ব্যবহার করে পুরুষদের গালাগালি করাও অসম্ভব কিছু না।

গালি দেবার উদ্দেশ্য অপরপক্ষকে ছোট করা। গালি হিসাবে ব্যবহৃত এই  শব্দগুলো অবমাননাকর, একজন মানুষের সম্মান নষ্ট করে। তাই সেগুলো যে কারো ক্ষেত্রেই ব্যবহারে নিরুতসাহিত করা হয়। নারী-পুরুষের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সম্পর্ক  গালাগালির নয় বরং  সন্মানের ও  সমতার হওয়া জরুরি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *