নারীবাদের নাম কেন ‘‘নারীবাদ’’?
আফরোজ ন্যান্সি ।। জীবনে বহুবার আমি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি সেটি হলো, কেন “ফেমিনিজম” বা “নারীবাদের” নাম ফেমিনিন অর্থাৎ নারীবাচক শব্দ দিয়ে তৈরি হলো? অন্য শব্দও তো ব্যবহৃত হতে পারতো। জগতে এতো শব্দ থাকতে “নারী”বাদই কেন। তারা জানতে চান, যদি নারীবাদ সমতার কথা বলে, যদি লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে তাহলে এর নাম “নারীবাদ” না হয়ে মানববাদ কিংবা সাম্যবাদ কিংবা অন্যকিছু হলো না কেন? স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্নগুলি যারা করেন তাদের বেশিরভাগই পুরুষ। কিছু নারীও আছেন যারা “নারীবাদ” শব্দটিকে গ্রহণ করতে নারাজ। তাদের দাবি, তারা সাম্যে বিশ্বাস করে, মানুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে তাই আলাদা করে “নারীবাদী” তারা হতে চান না। যদিও তারা একটা উদারনৈতিক জায়গায় নিজেদের দেখাতে চান কিন্তু নারীবাদকে গালি দিয়ে দুটো কথা বলতে তারা ভোলেন না। তাদের যুক্তির পিঠে যুক্তি দেওয়ার আগে আমার সামান্য জ্ঞানে সাম্যবাদ এবং মানববাদ এই দুটি বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করি।
ফ্রান্সের সামাজিক এবং রাজনৈতিক রেভ্যুলেশনের এক পর্যায়ে দৃশ্যত প্রথম, Egalitarianism বা সাম্যবাদের সূচনা হয়েছিলো। ওই সময়ে বেশ কিছু ফরাসী দার্শনিক বিদ্যমান সকল বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এই আন্দোলনের মধ্যে নারী অধিকারের প্রসঙ্গটি উহ্য থেকেছে। তাদের শ্লোগান ছিলো, “Liberty, Equality, Brotherhood”। সাম্যের এই আন্দোলন ছিল মূলত ভাতৃত্বের আন্দোলন। এরই প্রেক্ষিতে প্রণীত ফ্রান্সের সংবিধান তাই (Right For Men) অর্থাৎ পুরুষের অধিকারের কথা বলে। যদিও ততদিনে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ এবং শিল্প বিপ্লবের উদ্ভবের ফলে নারীরাও শ্রমবাজারের অংশ হয়ে গেছে তবু সাম্যবাদের আলাপে কোথাও নারীদের কথা আসেনি। আজকের দিনেও ফ্রান্সের সংবিধানে উল্লেখ আছে “Declaration of the Rights of Man and of the Citizen”। এই সংবিধানের অফিশিয়াল মোটো আজো – “Liberty, Equality, Brotherhood” রয়ে গেছে। সাম্যবাদ হচ্ছে পুরুষের তৈরি সেই মতবাদ এবং শিল্প ও সম্পদকেন্দ্রীক বিপ্লব যা পুরুষের পুরুষালি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকে আরো শক্তিশালী করে এবং নারী শ্রমিকদের অধিকারের কথা উহ্য রেখে দেয়। আজো তাই পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে বেতনবৈষম্য প্রবলভাবে উপস্থিত।
অন্যদিকে, Humanism বা মানববাদ হচ্ছে সেই দর্শন যেটি, যেকোনো অলৌকিক অদৃশ্য সর্বশক্তিমানের কল্পনা করে নেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের জয়গান করে। একজন মানুষ হিসেবে কোনো অতিপ্রাকৃত বস্তুকে নয় বরং অন্য একজন মানুষের প্রতি উদারতা ও সম্মান প্রদর্শনই মানববাদের শিক্ষা। সোজা কথায়, কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার বিপরীতে মানুষের কৃতিত্বকেই প্রাধান্য দেয় মানববাদ। মানববাদীরা তাই ধর্মীয় মতবাদকে ফেলে বিজ্ঞানের দর্শনকেই গ্রহণ করে নেয়। মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য কোনো ধর্ম বা অদৃশ্য সত্তার উপর নির্ভর করার অপ্রাসঙ্গিকতার কথাই মানববাদের মূল আলোচ্য। ফরাসী বিপ্লবের পরপরই এই দর্শনটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানববাদের সাথে নারীবাদের দর্শনগত মিল সামান্যই। একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের প্রতি যে উদারতা, বদান্যতা, সহমর্মিতা প্রকাশের কথা বলা হচ্ছে সেটি ততক্ষন অব্দি নারীর জন্য প্রযোজ্য হবেনা যতক্ষন অব্দি নারীকে উনমানুষ ভাবা বন্ধ হচ্ছে। একজন মানববাদী ব্যক্তির মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক আচরণ থাকতে পারে যদি না তার মধ্যে নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবার, নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করার মানসিকতা তৈরি হয়। মানববাদ সেই প্রগতিশীল আদর্শ যা যুক্তি ও ন্যায়বিচারকে গ্রহণ করে এবং ধর্মীয় গোড়ামি ও অদৃশ্য শক্তির উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনে। মানববাদের চর্চা থাকলে নারীবাদের প্রয়োজনীয়তা নেই এটি একটি অপরিপক্ক ভাবনা।
আবার, কিছু সচেতন মানুষ Gender Equality বা লিঙ্গ সমতা র সাথে নারীবাদকে গুলিয়ে ফেলেন। তারা ক্রমাগত বলতে থাকেন, আজকের আধুনিক পৃথিবীতে নারীবাদের নাম বদলে লৈঙ্গিক সমতা নির্দেশক কোনো শব্দ বলা উচিৎ। লৈঙ্গিক সমতা আসলে এক বিশাল প্ল্যাটফর্ম। নারী, পুরুষ, শিখন্ডী, রূপান্তরিত, সমকামী এদের প্রত্যেকের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং যৌনতার অধিকারগুলিকে সমানভাবে নিশ্চিত করা জেন্ডার ইক্যুলিটির মূল আলাপ। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, একই ব্যক্তি একইসাথে নারীবাদী, মানববাদী, লৈঙ্গিক সমতাবাদী হতে পারবেন না। ঠিক যেভাবে একই বাগানে অনেক রঙের ফুল ফুটতে পারে তেমনি একজন নারীবাদী মানুষ একইভাবে লৈঙ্গিক সমতার পক্ষেও কাজ করতে পারেন, মানববাদেও বিশ্বাস করতে পারেন। তবে নারীবাদের কথা বলার ক্ষেত্রে নারীবাদ শব্দটি থাকাই জরুরি। কেননা একজন নারীকে যত বিস্তৃত পরিসরে অবদমনের চেষ্টা করা হয় তা কল্পনাতীত। কোথায় হয়না নারীর অবদমন? সন্তান হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে। নারী মোটা-চিকন-খাটো-লম্বা-ফর্সা-কালো, নারীর পোশাক, নারীর খাদ্যাভাস, নারীর ভাষা, নারীর সঙ্গী নির্বাচন, নারীর বয়স, নারীর বিয়ে করা না করা, নারীর ধর্মপালন করা না করা, নারীর পেশা নির্বাচন, নারীর যৌনজীবন, নারীর মাতৃত্ব নির্বাচন সমস্ত কিছু যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তা বলে শেষ করা যাবেনা। সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, প্রথা- প্রচলনের সমস্ত দায় যেভাবে নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয় তা আর কোনো কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। ধর্মের, দেশের এবং সমাজের সমস্ত প্রথা নারীকে যেভাবে ধারন, লালন ও পালন করে চলতে হয় তা আর কারুর জন্য প্রযোজ্য নয়। নারীকে শুধুমাত্র নারী হয়ে জন্মাবার কারণে ধর্ষণ করা হয়, অ্যাবিউজ করা হয়, নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সামান্যতম কারনে পেটানো হয়, হত্যা করা হয়, ডাইনি উপাধি দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়, এমনকি গর্ভের কন্যা ভ্রূণটি নষ্ট করে ফেলা হয়। হাজার বছর ধরে, হাজার রকমভাবে নারীকে নিপীড়নের যে প্রচলন তার বিলোপ চাওয়ার প্ল্যাটফর্মটির নাম “নারীবাদ” বৈ আর কী হতে পারতো! তাই ঘুরিয়ে পেচিয়ে মানববাদ কিংবা জেন্ডার ইক্যুলিটির মতবাদের সাথে নারী অধিকারের আলাপকে যুক্ত না করে দিয়ে একে “নারীবাদ” বলাই যৌক্তিক। স্পেডকে এখানে স্পেড বলাই সঙ্গত।
সত্যি বলতে, বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি বৈষম্যকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার কিংবা ঘুরিয়ে দেখার সুযোগ নেই। হাজার বছর ধরে যে বিশদ পরিসরে নারীকে তার লিঙ্গের কারণে নিপীড়ন করা হচ্ছে, এই অবস্থায় নারীর জন্য এমন একটি আন্দোলন খুবই জরুরি ছিল যা শুধুমাত্র নারী অধিকারের দিকেই দৃষ্টিনিবদ্ধ করবে। নারীবাদ লিঙ্গের সমতার কথা অবশ্যই বলে, তবে তার আগে নারীবাদ নারীর উপর আরোপ করা সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপড়ে ফেলে নারীকে সেই সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে চায় যা থেকে তাকে হাজার হাজার বছর ধরে বঞ্চিত করা হয়েছে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ ভোটাধিকারের আন্দোলনের সময়কালে সর্বপ্রথম “ফেমিনিজম” টার্মটি ব্যবহৃত হয়। কেননা ভোটাধিকার আন্দোলনটি সম্পূর্নরূপে নারীকেন্দ্রীক ছিলো। নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার এই আন্দোলনের নাম তাই নারীকেন্দ্রীক হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। উপরন্তু নারীর সাথে হয়ে আসা বৈষম্যগুলি, অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামটিকে মানুষ যেন আলাদা করে দেখতে পায় সেক্ষেত্রেও “নারীবাদ” শব্দের চাইতে উপযুক্ত আর কোনো শব্দ হতে পারতো না। এক সাইজের জুতো যেমন সবার পায়ে লাগবে না, তেমনি কোনো একটি মতবাদ দিয়ে সামগ্রিক বৈষম্যের লাঘব করা যাবেনা। তাই মানববাদের আওতায় নারীবাদকে ফেলে দিয়ে, নারীর প্রতি হয়ে আসা অন্যায়কে আপনি মুছে দেবেন এটি ভাবা ছেলেমানুষী।
আসলে যারা এই প্রশ্নগুলি তোলেন তাদের বেশিরভাগই জানার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন না। আপনি যতই যুক্তি দিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চান না কেন, তাদের ভেতরের বদ্ধমূল ধারণা থেকে তারা কখনোই বের হবেন না। নারীবাদকে নিয়ে মকারি করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আমার তো মনে হয়, “নারী” শব্দের উপস্থিতিই তাদের মাথা ব্যথার প্রধান কারণ। নিজেদের অবচেতনে লালন করা “সেক্সিস্ট” সত্তাটিকে তারা চিনতে শেখেননি, তারা কখনোই নিজেকে এই প্রশ্ন করে না যে, কেন কোনো ইজমের সাথে নারী শব্দটি যুক্ত হলেই তা গাত্রদাহের কারণ হবে, কেন দুই/তিনশ বছরের নারী আন্দোলনের সংগ্রামপূর্ন ইতিহাসকে সাম্যবাদ কিংবা মানববাদের মধ্যে বিলীন করে দেওয়ার ইচ্ছা তাদের মনে জাগে? পৃথিবীতে শুধুমাত্র নারীর জন্য কিছু থাকাটা কেন তারা ইতিবাচক ভাবতে পারে না!
তারা আসলে নারীবাদ শব্দটি পরিবর্তন করতে চায় কেননা তারা নারীদের দ্বারা পরিচালিত নারীদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনটিকে ভয় পায়। নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক শব্দের রাজনীতির প্রভাব খাটাতে চায় এখানেও। বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি হতে থাকা বৈষম্য ও নিপীড়নের চাইতে, নামকরণের প্রতিই তাদের কড়া নজর। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শিক্ষিত- অশিক্ষিত- শ্রেণি- পেশা নির্বিশেষে এই মনোভাবটি তারা চেতনে ও অবচেতনে লালন করেন। বাসে সেসব সিটের উপরে লেখা থাকে “নারী ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত” এটাকে তারা বাঁকা চোখে দেখে; “কেন বাসে মহিলা সিট থাকবে কিন্তু পুরুষ সিট থাকবে না,” “নারী-পুরুষ নাকি সমানাধিকার তাহলে নারীও দাঁড়িয়ে যাক পুরুষের মতোন” ইত্যাদি তুচ্ছ কথাবার্তা বলে তারা নারী অধিকারের সামগ্রিক প্রয়োজনীয়তার দিকগুলি এড়িয়ে যায়। ভাবখানা এমন যেন পৃথিবীতে নারীর প্রতি বৈষম্য বলে কিছু নেই। জগতের সকলরকম সুবিধা ভোগ করার পরেও, নারীর জন্য কোনো সুবিধা আলাদা করে তুলে রাখা হবে সেটি তারা গ্রহণ করতে পারেন না। সেখানেও অধিকার ফলানো চাই। তাই সব সিট ফাকা থাকার পরে ওই সংরক্ষিত সিটেই গায়ের জোরে তারা বসবেন। সব ইজমের চর্চা থাকার পরেও ফেমিনিজমকে অন্য ইজমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই তাদের আত্মার শান্তি।
দীর্ঘদিনের নারীবিদ্বেষ এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ, অন্যকে অধস্তন ভাবার মানসিকতা পুরুষের মধ্যে এতো গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে, সহজে সে তার “গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল” স্বভাবখানা ছাড়তে পারছে না। নারীর জন্য আলাদা কিছু দেখলেই তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তেড়ে আসেন।
একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, “নারীবাদ” একটি বিশেষায়িত মতবাদ যা নারীর প্রাপ্য অধিকারের পক্ষে কথা বলে, এর পাশাপাশি সকল প্রকার লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিলোপ চায়। যেহেতু নারীবাদ কোনো গ্রন্থ আকড়ে থাকা ধর্ম নয়, তাই নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শুরু হলেও পরবর্তীতে এটি লৈঙ্গিক সমতার পক্ষেও কথা বলে এসেছে। নারীবাদ, লৈঙ্গিক সমতা, মানবতাবাদ এই তিনের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকার পরেও এরা কেউ কারো বিরুদ্ধমত নয়। কিন্তু নারী অধিকারের কথা বলার জন্য “নারীবাদ” টার্মটি থাকা জরুরী। কেননা একদিকে, “নারীবাদ” টার্মটি আমার মতো আর সকল নারীকে প্রেরণা জোগায়, শক্তি দেয়। অন্যদিকে, এই মতবাদে বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানেন, মানেন এবং সচেতন থাকতে পারেন। এই ইজমে বিশ্বাসী প্রত্যেকেই জেন্ডার নির্বিশেষে “নারীবাদী”। কেউ যদি মানববাদী হতে চায় তাকে অভিনন্দন কিন্তু “নারীবাদ দরকার নেই, মানববাদ তো আছেই” টাইপ একপাক্ষিক কথা বলা সমস্যাজনক। কোনো অবস্থাতেই মানববাদের সাথে গুলিয়ে নারীবাদকে হালকা করে ফেলার সুযোগ নেই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]