বিয়ে ও বিচ্ছিন্নতা: ‘মানিয়ে নাও কিংবা মেনে নাও’
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বিবাহবিচ্ছিন্নতা মানেই এক প্রবল সামাজিক সংকট। বিচ্ছিন্নতার কারণ বহুবিধ। আমি সেইসব বিচ্ছিন্ন মানুষের কথা বলতে চাইছি, যাদের মধ্যে আত্মমর্যাদা বোধ আছে এবং প্রবল প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজনে অক্ষম হয়ে প্রাণের তাগিদে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ কথাটি উল্লেখ করলেও নারীদের নিয়েই বলব কারণ এরা এখনও নিজেদের অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেনি এবং বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে মান্যতা দেবার এবং অসহনীয় পরিস্থিতিকে সহনীয় করার দায় এদের উপরই বর্তায়। এই সামাজিক পরম্পরার স্বার্থেই মেয়েরা পরিবারে বা পরিবারের বাইরে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা যতই নির্যাতিতা হোক না কেন, পিতৃগৃহের কড়া নির্দেশ থাকে, ‘মানিয়ে নাও কিংবা মেনে নাও।’ মনের জোর বা টাকার জোর না থাকার কারণে দিনের পর দিন এই সহাবস্থান বেশিরভাগ মেয়েই মেনে নেয়। যেহেতু স্বামীদেবতাটির উপর মেয়েটির পরবর্তী জীবনের ভরণপোষণের ভার থাকে, তাই তার যাবতীয় কুকর্ম করার অধিকার জন্মায়। এটাই বোধহয় স্বাভাবিক – সে রাষ্ট্রীয় শাসকই হোক বা গৃহশাসক। প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ। কেউ কেউ বলতেই পারেন, ‘কই, আমি তো এমন নই’- এই কথাটা শুনলে মনে হয়, যেন এমনটা হবারই কথা ছিল – এমন না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
আর যেসব মেয়েরা মনের জোর অথবা টাকার জোরে স্বাধীনতা (বিচ্ছেদ) অর্জন করেছেন, পিতৃগৃহেও তাদের হেনস্থা ছাড়া কিছুই জোটেনা অথবা বাধ্য হন মেনে নিতে। কারো পাকা ধানে মই না দিয়েই বিভিন্ন সামাজিক লোলুপতার শিকার হতে হয়। বেশ কয়েক বছর আগে একটা গবেষণায় উঠে এসেছিল, শতকরা 8০ ভাগ মেয়ে এই ধরণের পারিবারিক হিংসার শিকার সেটা শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়িতে নয়, বাপের বাড়িতেও। শিশু ও নাবালিকাদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, এই সমপরিমাণ মেয়েই বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে আগ্রহী এবং মানসিক বিচ্ছিন্নতা তো আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজনই পড়ে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা রাজ্য কেরালাতে বিবাহ বিচ্ছেদ ও সেই সঙ্গে আত্মহত্যার সংখ্যা অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি। পারস্পরিক ইগোকেন্দ্রিক সংকট। সমতার ভারসাম্য বনাম অসমতার দূরত্ব।
যদিও ভারতের আইন মোতাবেক পিতামাতার সম্পত্তিতে মেয়েদেরও সমান ভাগ আছে, তথাপি মেয়েটিকে যৌতুক-মূল্যে এক রকম বেচে দেওয়ার পরিকল্পিত সুবন্দোবস্ত করা হয়। হ্যাঁ, বলা যেতে পারে তাদের কথা, যারা বিয়ের পরেও চাকরি করছে তাদের কী অবস্থা? খুব কম মেয়েই আছে, যাদের অর্জিত টাকায় তাদের বাবা মা ভাগ বসায়। মেয়ে যতই চাকরি করুক, তার বিয়ের পর তার একমাত্র আদর্শ, যেনতেন প্রকারেন স্বামীসোহাগিনী হয়ে ওঠা ও সন্তান জন্ম দেওয়া। না কেউই আমরা এর বিরোধী নই। প্রেম ভালোবাসা সবাই পেতে চায়, মেয়েরা তো আরো বেশিই চায়। বাপের বাড়িতে যতই আদর থাক না কেন, কোথাও যেন এই সুরটাই বাজতে থাকে, “আহা রে, ও তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে!” স্বনির্ভর হলেও এক অদ্ভুত পরনির্ভরতা।
তবে যেসব মেয়ের ভাই নেই বা যাদের পুত্র সন্তান নেই, তাদের অন্য এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা। বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক পাত্রপক্ষই রাজ্য ও রাজকন্যার খাতিরে অথবা ভালোবেসেই বিয়ে করে। কিন্তু তবুও মেয়েটির মা বাবাকে হয় নিঃসঙ্গভাবে বা আত্মীয়দের ছেলেদের করুনার উপরই ভরসা করতে হয়। কারণ শ্বশুরবাড়ির টাকার ভাগ নেওয়া সমাজে যতটাই সম্মানজনক, দায়িত্ব নেওয়া ব্যাপারটা ততটাই অসম্মানজনক। সমস্তটাই শাসকের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। জানি এই সমস্ত সমস্যার কথা বলতে বা শুনতে ভালো লাগবে না। অনেকেই বলেন, “এ আবার নতুন কথা কী?, ‘শাসক যখন তখন তো মেনে নিতেই হবে। সব মেয়েরাই তো যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে।” এই ভাবনাটা অমূলক কিছু নয়। ছোটবেলা থেকেই আমরা বাড়িতে এই অসাম্য দেখতে অভ্যস্ত। ছেলেদেরকে অতি মাত্রায় তোষণ। বয়স হলে কে দেখবে, এই ভেবে। সব কর্মের মূলেই থাকে প্রবল নিরাপত্তাহীনতা ও যুগযুগান্তরের প্রথিত সংস্কার যা কালক্রমে আসক্তিতে রূপান্তরিত ।
তবে প্রচুর মহিলা আছেন যাদেরকে একটি সামান্য মনোবাসনা পূরণ করার জন্য, সমাজ পরিবার সকলের কথা ভাবতে হয়, তাদের পাশে যে সমস্ত স্বামী, পুরুষ বা মহিলারা থাকেন, তাদেরকেও নানাভাবে বিদ্রুপ ও হেনস্থার শিকার হতে হয়। আর যারা সুস্থভাবে, যুক্তিসম্মতভাবে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সহাবস্থান করছে, তাদের কাছে পারস্পরিক স্বাধীনতারও যেমন মূল্য আছে তেমনি সহানুভূতি সমৃদ্ধ ভারসাম্য বজায় রাখার পারস্পরিক চেষ্টা ও তেষ্টা দুটোই আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সময় বদলাচ্ছে, বদলে যাওয়া মেয়ের সংখ্যাও বাড়ছে কিন্তু হেনস্থার ধরণগুলোও বদলাচ্ছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মুক্তমনা, বোদ্ধামনা, আইন প্রণয়ন যেমন সচেতনতা বাড়াতে ও অত্যাচার কমাতে সাহায্য করেছে, তেমনই নিজের জোর বা সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে আইনের সুবিধাও পাওয়া যায়না। যারা বিবাহিত বা বিচ্ছিন্ন হয়েও আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপন করে তাদের এই আত্মশক্তিই সবচেয়ে বড় মূলধন। কেরালা রাজ্যটির কথা আরেকবার উল্লেখ করতেই হয় কারণ ২০০৫ সালের গার্হস্থ্য হিংসা আইনের দ্বারস্থ হওয়া মেয়ের সংখ্যাও এই রাজ্যেই বেশি।
প্রত্যেক সম্পর্কের ভিতর একটা মাধুর্য থাকে। প্রণয়ের কামনাকেন্দ্রিক সম্পর্কেও মাধুর্য আসে যদি সেখানে প্রভুত্বের বদলে অন্তত কিছুটা সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা মিশে যায়। তার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার। যুক্তি দিয়ে অনুভূতিকে খণ্ডন করা যায় কি? আর যে সমস্ত পরিবারে, সমাজে ও ধর্মে বাঁধন যত শক্ত, সেখান থেকে বাঁধন ছেড়ার প্রবণতাও তত বেশি তা সে পুরুষই হোক বা নারী। মোটের উপর ভালোবাসা, ধর্ম ও সমাজ তো সকলকেই বেঁধে রাখার চেষ্টা করে, সংকট তখনই আসে যখন বাঁধনটি অতিমাত্রায় হয়ে যায় এবং মানুষ বাঁচার স্বার্থে সেই অসহনীয় বাঁধন আলগা করে বিচ্ছিন্ন হতে চায়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]