নীলা রায় হত্যাকাণ্ড এবং নারীবাদের প্রাসঙ্গিকতা
চেন রাখাইন ।। বেশ কিছুদিন আগে সাভারে অত্যন্ত নৃশংস একটি ঘটনা ঘটেছিল। গণমাধ্যমে ঘটনাটি প্রচার করা হলেও এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন কোনো আলোচনা-সমালোচনা না দেখে তখন আমি সত্যিই খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। আমি জানি না, এই ঘটনার ব্যাপারে সবাই আদৌ জানে কি না! যারা জানেন তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, আমি সাভারে ঘটে যাওয়া ‘নীলা রায় হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে কথা বলছি।
ঘটনাটা আমি যেদিন প্রথম গণমাধ্যমে দেখি, সেদিন আমি আক্ষরিক অর্থে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং যাদের সামান্যতমও মানবতাবোধ আছে তারাও খবরটা দেখে নিশ্চয় কয়েক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার কারণে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ফেলা হয়েছে! হ্যাঁ, ঘটনাটি এমনই নির্মম! এই নৃশংস ঘটনার মূল অভিযুক্ত হচ্ছে, মিজানুর নামের এক বখাটে। দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশে মেয়েদের সাথে এই ধরনের হিংস্র ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। মেয়েরা ঘর থেকে বের হলে রাস্তাঘাটে তাদের যেভাবে টিজ করা হয় সেটার কথা নতুন করে আর না-ই বললাম। শুধুমাত্র মেয়েদের টিজ করা হয় বলে ইংরেজি অভিধানে একটা নতুন শব্দ যোগ করা হয়েছে ‘ইভ-টিজিং’ নামে। এই ‘ইভ-টিজিং’ শব্দটা শুধুমাত্র মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। করোনাকালীন লকডাউনে নারীদের ওপর ডমেস্টিক ভায়োলেন্সও শতগুণে বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের ওপর হাত তোলা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এটাকে তো সমাজে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয় না। স্বামী হলে স্ত্রীর ওপর হাত তোলা সামাজের বৈবাহিক আইনে একেবারে বৈধ! তাই এগুলো নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। একজন মানুষের ওপর হাত তোলা যে তার আত্মসম্মানবোধে আঘাত করা, এটা অনেকে মনেই করে না।
ভারতীয় উপমহাদেশে মেয়েদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন অবশ্য নতুন কিছু না। অনেক আগে থেকেই এসব চলছে। এই উপমহাদেশে মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের দাবানলে পুড়ছে, লৈঙ্গিক বৈষম্যের জাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট হচ্ছে তাদের জীবন। আমার মনে হয়, ভারতীয় উপমহাদেশে নারীবাদী হওয়া খুব জরুরি। ‘নারীবাদী’– শব্দটা নিয়ে আমাদের অনেকের ভুল ধারণা ও অনেকের অযৌক্তিক চুলকানি আছে। ভুল ধারণার কারণ কিছু ভণ্ড নারীবাদীর অপকর্ম। কিন্তু কেউ যদি নারীবাদের মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানে তাহলে সে কখনো নিজেকে নারীবাদী দাবি করতে সংকোচবোধ করবে না। অনেককে দেখি– ‘আমি নারীবাদী না’ বলে ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে উঠতে! দেখে মনে হয় যেন, সে নিজেকে ‘আমি চোর না’ কিংবা ‘আমি ধর্ষক না’ বলে দাবি করছে! আবার ‘নারীবাদী’ বলতে অনেকে মনে করে পুরুষবিদ্বেষ! এই ধরনের ভুল ধারণার কারণ হচ্ছে ‘নারীবাদ’ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা।
মানব সভ্যতার শুরু থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যুগে যুগে শোষিত হয়ে আসছে। এই সমাজে তাদের স্বাধীন মানুষ হিসেবে মনে করা হয় না। পরিবার ও সমাজই তাদের শোষণের পথ তৈরি করে দেয়। স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় যদি তারা টিজিং এর শিকার হয়, পরিবার থেকে তাদের স্কুল-কলেজে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়; ধর্ষণের শিকার হলে সবাই ধর্ষকের দোষ না খুঁজে ধর্ষণের শিকার নারীকে বিভিন্নভাবে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করে। কোনো নারী তার সাথে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে আশেপাশের সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, তার প্রতিবাদ করা ঠিক হচ্ছে না। কিছু এমন মনোভাবের নারীও আছে সমাজে, যারা মনে করে মেয়েদের জন্মই হয়েছে সেবাদাসী হওয়ার জন্য। যারা একটু স্বাধীনচেতা ও প্রতিবাদী তাদের এরা নোংরা দৃষ্টিতে দেখে। তাদের ভাষায়— “তুমি মাইয়া মানুষ, চুপ কইরা থাকো। বেশি কথা বইলো না।”
এই যে সামাজিকভাবে একধরনের স্টেরিওটাইপিং করা হচ্ছে, যেহেতু তুমি একজন মেয়ে, তাই তোমাকে সব অন্যায় সহ্য করে চলতে হবে। এই রকম শিক্ষা নারীদের সত্যিকার অর্থে দুর্বল, অথর্ব, অবলা, নির্যাতিতা করে রাখে। নারীবাদের মূল কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে নারীদের সাথে যেসব অন্যায়-অত্যাচার-অপরাধ করা হয়, সেটার বিরুদ্ধে কথা বলা। একজন মানুষ হিসেবে পুরুষেরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, সেরকম একজন নারীও যেন ঠিক সেইসব সুযোগ-সুবিধা পায় এটাই নারীবাদের মূল কথা। যখন সমাজে নারীদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, নারীরা পুরুষের মতোই স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে, তখন আর নারীবাদের আলাদা কোনো গুরুত্ব থাকবে না। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করারই নামান্তর। কিন্তু আমরা পুরুষেরা নারীদের অধিকারের ব্যাপারে কথা বলতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। সমাজে নিজেরা প্রিভিলেইজড অবস্থায় থাকি বলে আমরা তাদের দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে পারি না। তাই পুরুষতন্ত্রের বিশেষ সুবিধাভোগী হিসেবে আরামসে চুপচাপ দিন কাটাই।
বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। এই যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুরুত্ব অনেক বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিক বিপ্লব পর্যন্ত করা সম্ভব এখন। ফেসবুকে কোনো বিষয় ভাইরাল হলে গণমাধ্যমগুলোও সেটা ফলাও করে প্রচার করে। তাই কোন অন্যায় ঘটনার প্রতিবাদে ফেসবুকে যখন সবাই সরব হয় তখন সেটা অন্যরকম গুরুত্ব পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সেটা নিয়ে তৎপর হয়ে যায়। আমরা এমন অনেক ঘটনা দেখেছি যেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তোলপাড় হওয়ার কারণে পুলিশ অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে বাধ্য হয়েছে; এমনকি আদালতও খুব দ্রুততার সাথে মামলার বিচারিক কাজ সম্পন্ন করেছে। আবার অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোড়ন তুলতে পারে নাই দেখে সেগুলো চাপা পড়ে হারিয়ে গেছে। সাভারে নীলা রায় হত্যা নিয়েও ফেসবুকে তেমন কোনো আলোচনা ছিল, প্রতিবাদের কোনো উত্তাপ ছিল না। চারপাশে এই বিষয়ে একেবারে নিরুত্তাপ ছিল। চারিদিকে চুপচাপ দেখে ভয় হয়! এটার সঠিক বিচার হবে তো! এক মা তার সন্তান হত্যার বিচার পাবে তো! সবকিছুই আপাতত আদালতের ওপর নির্ভর করছে। আদালতের ওপরই আস্থা রাখলাম।
টিভি অন করলেই নিউজ চ্যানেলগুলোতে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের খবর দেখি। মাঝে মধ্যে এসব খবর দেখতে দেখতে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলি। কী বলব, কী লিখব বুঝে উঠতে পারি না। দেশে কোনোদিন এসব ঘটনা বন্ধ হবে? নারীরা নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারবে কখনো? সমাজে পুরুষের যা অবদান নারীর অবদান তার চেয়ে সামান্যতমও কম না। নারীদের প্রতি আঘাতকে কোনও খোড়া যুক্তি দেখিয়ে বৈধতা দেওয়া যাবে না। এই আঘাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদেরই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, আমাদেরকেই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে; অন্যথায়, এই আঘাতে আমাদেরই ক্ষতবিক্ষত হতে হবে, এই আঘাতে অপমৃত্যু আমাদেরই হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]