November 2, 2024
মুক্তমত

শান্তির ধর্মের অনুসারী, তা কাজে প্রমাণ করুন

আরাফাত লিও তন্ময় ।। পবিত্র কাবা ঘরে এক সময় নিয়মিত মূর্তিপূজা হতো। সে সময় কাবা ঘরের দায়িত্বে ছিল মক্কার কুরাইশরা। স্পষ্ট করে বলতে গেলে গোত্র প্রধান আব্দুল মুত্তালিব। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে- সেই পরিবার, যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বয়ং নবী মোহাম্মদ (স), অর্থাৎ নবী করিমের সরাসরি পূর্ব পুরুষগণ কাবা ঘর রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূর্তিপূজা করে আসছিলেন। তখনও মক্কার সেই বালক মোহাম্মদের উপর কোরান নাজিল হয়নি, তিনিও হয়ে ওঠেননি সর্বশেষ কিংবা সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। বালক মোহাম্মদ নিজেও পাথর বয়ে এনেছিলেন তৎকালীন পূজো মণ্ডপ কিংবা বর্তমান পবিত্র কাবা শরিফের সংস্কারে। এরপর আমরা দেখতে পেলাম, মক্কার সেই বালক মোহাম্মদ পরিপূর্ণ বয়সে (চল্লিশ বছর বয়সে) নবুয়তপ্রাপ্ত হলেন। পাল্টে গেল তাঁর জন্মস্থান মক্কার দৃশ্যপট, কাবা ঘর থেকে সরে যেতে থাকল মাটির মূর্তি সব। ঈশ্বর বদলেছে, পূজারি বদলেছে, বদলে গেছে প্রার্থনার যাবতীয় নিয়ম-কানুন। বদলায়নি কেবল পূজোর মঞ্চ- পৃথিবীতে এটাই ধ্রুব সত্য। তবুও কেন মানুষ যুগে যুগে নিজেদের ঈশ্বর প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ধর্মযুদ্ধের নামে রক্তাক্ত করে হাত- নিজের মতোই রক্ত মাংসে গড়া মানুষেরই রক্তে?

মানুষ শব্দের মাহাত্ম্য বোঝেন?

“মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না,
মানুষ এত বড় যে,
আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি
একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে,
মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্যে।”

(আগ্রহী পাঠকরা ভাস্কর চৌধুরীর ‘আমার বন্ধু নিরঞ্জন’ কবিতাটি পড়তে পারেন)

যারা ধর্ম পালন করেন, তা যে ধর্মই হোক- প্রতিটা ধর্মই তার অনুসারীর কাছে পবিত্র ধর্ম। মসজিদ, আল কোরান, তাসবিহর মতো করে ত্রিপিটক, বাইবেল, গির্জা, মঠ, মন্দির, ক্রুশবিদ্ধ যিশু, শিবলিঙ্গ, কালী/দেবী/লক্ষ্মী/সরস্বতী কিংবা গণেশ/হনুমান মূর্তিও পবিত্র। কোরান পাঠ, নামায, রোজা পালনকারী যেমন ধার্মিক, তেমনই নিয়মিত পূজো আর্চাকারী, ত্রিপিটক, গীতা পাঠকারীও ধার্মিক। সকলে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালনকারী কিন্তু ধার্মিক। এখন আপনি সনাতন ধর্মের অনুসারী হয়ে নিজেকে বাদে বাকি সবাইকে বকধার্মিক ভাবতে পারেন না, সে অধিকার আপনার নেই। এবং অগ্রাহ্য করতে পারেন না ধর্মহীন কিংবা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী কোটি কোটি মানুষকেও। আপনার মনে রাখতে হবে এবং মানতে হবে পৃথিবীতে আপনি ছাড়া আরও প্রায় সাতশো কোটি মানুষ বসবাস করে। অর্থাৎ, সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের পৃথিবীতে একটা অংশ আপনার ধর্মের লোক ঠিক আছে কিন্তু বিশাল একটা অংশ আপনার ধর্মের প্রেক্ষিতে বিধর্মী এবং ধর্মহীন অথবা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী লোকের বসবাস। আমাদের ঈশ্বর থাকেন আমাদের মনে কিংবা মহা পবিত্র স্থানে যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। অতএব, বর্তমান মানুষের পৃথিবীতে মানুষ হয়ে শুধুমাত্র নিজের সহীহ ধর্মের কারণে মানুষের অস্তিত্ব বিনষ্টকারী মানুষ শুনুন- আপনি কিংবা আপনার ধর্মীয় ভাইয়েরা পৃথিবীতে কায়েম হয়ে আসেনি। দৃশ্যত, এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী ডায়নোসরের ফসিল আপনি প্রসিদ্ধ কোনো জাদুঘরে গেলে দেখতে পাবেন। আপনি ধার্মিক হোন কিংবা ধর্মহীন বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এটাই পরম সত্য যে- কয়েক কোটি বছর আগে যেমন পৃথিবীতে মানুষ নামক কোনো জীব ছিল না তেমনই কয়েক কোটি বছর পরও পৃথিবীতে মানুষ নামের কোনো জীব থাকবে না।

এই চলমান সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে কোনো ঈশ্বরের ক্ষতি হয়েছে? নোয়াখালীর চৌমুহনীতে সনাতনধর্মালম্বী দুই নারী ধর্ষণের ঘটনায়- ‘আমার ঈশ্বর’ই বড় কিংবা ‘আমিই পরম সত্যে’র অনুসারী প্রমাণিত হয়নি। এখানে সর্বোচ্চ ওই ধর্ষকদের পুরুষত্ব জাহির হয়েছে। বরং মনে হয়, আমাদের পুরুষতান্ত্রিকঈশ্বরের পৃথিবীর এই বিস্ময়কর বঙ্গীয় ব-দ্বীপে কোনো পুরুষ শুধুমাত্র শিশ্নের অধিকারী হওয়ার দোহাইতে নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করা শুরু করলে; সবিশেষ অবাক হবো না।

১৫ই অক্টোবর, ২০২১ খৃষ্টাব্দ- বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে? স্পষ্ট উত্তর, না। এদিন বাংলাদেশে আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের এক নগ্ন দৃষ্টান্ত। পৃথিবীতে হনুমানের মূর্তি পবিত্র নাকি তার অধিক পবিত্র কোরান- সেসব পরিমাপের কোনো যন্ত্র নেই। একজন ধার্মিক যে নিজে অদৃশ্য ঈশ্বরে বিশ্বাসী সে কীভাবে আরেক ধর্ম অনুসারীর পবিত্রতা-অপবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে? একজন ধার্মিক হিসেবে বড় অযোগ্যতা তো এখানেই- এখানে কে পবিত্র বা কম পবিত্র সেসব প্রমাণে রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কোনো প্রয়োজন নেই। যেহেতু প্রমাণ করা সম্ভবও নয়। তবে হ্যাঁ, কে কতটা ভালো ধার্মিক হয়ে উঠতে পেরেছে সেটার পরিমাপক হতে পারে- কে কতখানি উদার, কতখানি সহনশীল, সেই প্রেক্ষিতে। এই যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে ক্রমশ আর তার সঙ্গে পাল্লা বাড়ছে মানুষের অসহিঞ্চু আচরণ; দুটোই পৃথিবীকে বিপন্ন করে তুলতে যথেষ্ট। যারা আছেন, বৈশ্বিক বিপ্লবী- সশ্রদ্ধ সম্মানের সাথে অনুরোধ করছি, বৈশ্বিক উষ্ণতা রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি বর্তমান পৃথিবীর মানুষকে আরও সহনশীল করে তুলতেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

যারা মনে করেন, হনুমান মূর্তির সংস্পর্শে এসে অবমূল্যায়িত হয়েছে পবিত্র গ্রন্থ কোরান- যে গ্রন্থ নাজিল হয়েছে নবী মোহাম্মদ (স) এর উপর, যে গ্রন্থ হেফাযতের দায় স্বয়ং আল্লাহতা’লার সেই গ্রন্থের পবিত্রতা এতখানি ঠুনকো হতে পারে?

তবে হ্যাঁ, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের খেয়ালে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আযান দিয়ে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা যেমন ঘোরতর অপরাধ তেমনই ঘোরতর অপরাধ কুমিল্লার অস্থায়ী পূজা মণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে কোরান রাখা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছেন- আশা করি, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের খেয়ালে যারা পূজা মণ্ডপে কোরান এনে রেখেছে এবং সে ঘটনাকে পুঁজি করে, উস্কানি দিয়ে, নোংরা রাজনীতির চেষ্টা চালিয়ে নষ্ট করেছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি খুন করেছে, লুট করেছে, ধর্ষণ করেছে, নষ্ট করেছে সনাতনধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন, অস্থিতিশীল করে তুলেছে জনজীবন; প্রত্যেককে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত বিচারের দাবি জানাই। ধর্মনিরপেক্ষ সোনার বাংলায় এ যেন ইতিহাস হয়ে থাকে।

সবশেষে, যে কথা বলতে চাই- পৃথিবীর সকল ধর্মই শান্তির কথা বলে। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা ধার্মিককে হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। আমি শান্তির ধর্মের অনুসারী, এ কথা তো মুখে বললে হয় না; কাজে প্রমাণ করতে হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে বহু হতাহত, ধর্ষণের দৃষ্টান্ত তো হয়েছে এবার বরং ধর্মের দোহাই দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।
এবং পৃথিবীতে ধর্মীয় মাদকই একমাত্র নেশা, যে নেশায় তাল কেটে যায় না। বৃটিশরা ধর্মের মদ গিলিয়ে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে যে সন্ত্রাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছে উপমহাদেশে- সময় এসেছে সেই মদ উগড়ে ফেলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশকে সৌহার্দপূর্ণ করে তোলা। অবশ্য চিন্তা তো আরও এক জায়গায়, এখন ইউরোপ আমেরিকায় কে কোন ধর্ম কোনভাবে পালন করছে তার চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম- কার গায়ের রঙ কী? কালো না সাদা?

মনেপ্রাণে আমিও চাই; ভুল প্রমাণিত হোক কবি নজরুলের কবিতার সেই কথা-
‘‘আনোয়ার! আনোয়ার!
কোথা খোঁজো মুসলিম? -শুধু
বুনো জানোয়ার!
কোথা খোঁজো মুসলিম? -শুধু বুনো জানোয়ার’’

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *