November 2, 2024
কলামফিচার ৩

সাজ পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য নয়, নিজের জন্য

তানিয়া কামরুন নাহার ।। কলেজে ভর্তি হবার প্রথমদিনেই নিয়ম কানুন জানিয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের। সপ্তাহে দু’দিন নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম অবশ্যই পরে আসতে হবে। বাকি দিনগুলোতে নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরা যাবে। কিন্তু তারপরেও কিছু নিয়ম ছিল। খুব পশ ড্রেস পরা যাবে না। সাধারণ সেলোয়ার কামিজ আর ওরনা পরতে হবে। কানে লম্বা দুল পরা যাবে না। হাইহিল পরা যাবে না। খটর খটর বা খস খস শব্দ করে হাঁটা যাবে না। চুল খোলা রাখা যাবে না। মেকাপ/লিপস্টিপ দেয়া যাবে না।

তবে বিভিন্ন উৎসবে সেজে আসার অনুমতি ছিল। সেদিন ইচ্ছেমতো সাজগোজ করে কলেজে আসতাম আমরা। বিশেষ দিনগুলোর স্বাধীনতায় আমরা ফ্যাশন সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। সবার সাজগোজেরর মধ্যেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিত্ব বজার রাখার মনোভাব নিয়ে আমরা বেড়ে উঠতে থাকি। নিজের সম্পর্কে সচেতন হবার এ শিক্ষাটা কলেজ থেকেই পেয়েছিলাম।

তারপরেও কেউ কেউ সাধারণ দিনগুলোতেও হয়তো একটু স্টাইল করে ফেলতো। হয়তো সেদিন প্রেমিকের সাথে ডেট আছে কিংবা নতুন কোনো রঙিন ক্লিপ কিনেছে। সেজন্যই তার মধ্যে অমন প্রাক তারুণ্যের চপলতা।  সিস্টাররা এমন কিছু দেখতে পেলেই ঐ মেয়ের মাথা থেকে সব ক্লিপ খুলে নিজের জিম্মায় নিয়ে নিতেন। ওসব আর কখনো ফেরত পাওয়া যেতো না। চুল খোলা থাকলে তখনই বেঁধে ফেলতে হতো। আরো হাজারটা নিয়ম কানুন। প্রয়োজনে অভিভাবককে ডেকে আনানো তো ছিলই। এসব নিয়ম কানুন জেনেই ভর্তি হয়েছিলাম হলি ক্রস কলেজে। এটা এমন এক কলেজ, ছুটি হবার আগে থেকেই কলেজের সামনে নানান বয়সী ছেলেরা ভিড় করতে থাকে, মেধাবী ও সুন্দরী মেয়েদের দূর থেকে এক নজর দেখার জন্য।

এখন অবশ্য কলেজের আগের নিয়ম বদলে আরো কঠিন হয়েছে। সপ্তাহের সব দিনই নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরেই শিক্ষার্থীদের কলেজে যেতে হয়। আসলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই কিছু ড্রেসকোড থাকে। অন্তত স্কুল কলেজগুলোতে এমন নিয়ম কানুন থাকা মন্দ কিছু নয়। শৃঙ্খলা, সমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় তুলে ধরার জন্য মূলত এমন নিয়ম।

ক্লাসে একদিন সিস্টার শিখা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মেয়েরা এত সাজতে পছন্দ কেন করি? এত গয়নাই বা পরতে চাই কেন? ঐ বয়সে তার কথাগুলো মনে এত দাগ কেটেছিল!

সিস্টাররা জীবনের বিলাস বাসনা থেকে নিজেকে দূরে রেখে, সব রঙ ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন শুধুমাত্র সাদা রঙ আর খুব সাধারণ এক নিবেদিত জীবন। তাদের অমন নির্মোহ জীবন যাপনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতো। সিস্টার শিখা যখন বললেন, আমরা মেয়েরা সাজি শুধুমাত্র পুরুষদেরকে খুশি করার জন্য, নিজের কাছে কেমন যেন ছোট হয়ে যাচ্ছিলাম। অপমানিত বোধ করছিলাম। ছেলেদেরকে খুশি করা জন্য, তাদের মন জয় করার জন্য আমাকে কেন সাজতে হবে? ছেলেরা কি আমাদেরকে খুশি করার জন্য বিশেষ কিছু করে?

সেদিন তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের গয়নার ইতিহাসও বলেছিলেন। পায়ের নুপুর, হাতের চুরি, কানের দুল, নাকের নথ সবই আসলে এক ধরনের শেকল। নুপুরের শব্দে বোঝা যায়, মেয়েটি ঘরের বাইরে কতদূর গেল। অর্থাৎ শেকল। বেয়াড়া গরুর মুখে যেমন ঠুলি পরিয়ে রাখা হয়, তেমনি মেয়েদের নাকে পরানো হয় নথ। এ নথ আবার এ কথাও বলে দেয়, নারীটি কারো একজনের সম্পত্তি। হাতে চুরি পরা তো চিরকাল অপমানের প্রতীক হিসেবে বলা হয়েছে। নইলে পুরুষেরা পরাজিত হলে ‘হাতে চুরি পরা’র কথা বলে কেন? এমন কি কপালের টিকলিটাও আবিষ্কৃত হয়েছিলো, স্বামীর অত্যাচারের আঘাত ঢাকতে।  সিস্টারের কাছে এসব কথা শুনতে শুনতে মনের ভেতর দারুণ একটা আলোড়ন ঘটেছিল সেই বয়সে। এমনিতেও আমি তেমন সাজতাম না। কানের দুলও তেমন পরতে পারতাম না। শৈশবে কান ফোঁড়ানোর পরে দুলটা এমন ভুলভাবে পরানো হয়েছিলো, ওটা আর খোলাই সম্ভব হয় নি। দশ বছর ওভাবেই ছিলাম। কৈশোরে বান্ধবীরা নানা রকম কানে দুল পরতো। ওরাই প্রথম আমাকে পরামর্শ দিলো, কানে আটকে থাকা দুলটা খোলা দরকার। ওদের উদ্যোগেই হই হই করে সেই দুল খোলা হয়েছিল! প্রথম সেই পুরোনো দুলটা খোলার পর, নতুন নতুন কানের দুল পরা শুরু করলাম যেই, তখনই সিস্টার শিখার এমন বক্তব্য! তার কথায় মনের ভেতর এমন আলোড়ন হয় যে, সাজগোজ বর্জন করি। কানে দুল পরা আবারও একদম বাদ দিয়ে দিই। এতে করে দুল পরার জন্য কানের ছিদ্রটাও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

জীবনের পরবর্তী একটা পর্যায়ে বিষন্নতায় ভুগতে থাকলে কাউন্সেলরের পরামর্শ নিতে হয় আমাকে। তিনি আমাকে তখন রঙিন জামাকাপড় পরতে, সাজগোজ করতে বললেন। সুন্দর করে সেজে যাচ্ছি কিনা, তিনি খেয়াল করতেন। অত সাজতে পারি নি, কখনোই। তবু তিনি আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন। আমিও লক্ষ্য করলাম, সাজগোজ করলে মন ফুরফুরে হয়ে যায়। শুধু বিপরীত লিঙ্গের কাউকে খুশি করার জন্য নয়, আসলে একজন মানুষ তার নিজের জন্য, নিজের সৌন্দর্য, রুচিবোধ থেকেই সাজবে।

আসলে কলেজের সেই প্রাক তারুণ্যের সময়টাতে সাজগোজের চেয়েও নিজের পড়ালেখার প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। এজন্যই সিস্টার ওসব কথা বলেছিলেন। আমাদেরকে সাজগোজবিমুখী করার জন্য নয়। তিনি কিন্তু মেয়েদেরকে এ কথাও বলেছেন, “মেয়েরা, কখনো কেউ তোমাকে ধোঁকা দিলে, নিজেকে তৈরি করবে, জীবনে সফলতা অর্জন করবে, যেদিন কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারবে, সেদিন এক জোড়া হাই হিল আর একটা শাড়ি কিনবে। তারপর সেই জুতো আর শাড়ি পরে তার আঁচল ছেড়ে যে তোমাকে আঘাত করেছিল তার সামনে দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের মহিমায় হেঁটে যাবে। সেদিন সে তোমার সফলতা দেখে নিজেই অনুতপ্ত হবে।” সিস্টারের সাথে আরেকটু যুক্ত করে অবশ্য আমি বলতে চাই, শুধু ধোঁকা খেলেই কেন সাজবো? ব্যর্থতার সাথেও সাজ কিংবা সৌন্দর্যবোধের কোনো সংঘর্ষ নেই। আর সাজ মানেই হাইহিল বা সুন্দর শাড়ি নয়। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্ব থেকে সাজবে।

পুরুষরা তো মনে করেই, সাথে কিছু নারীবাদীও ভাবেন, মেয়েরা সাজে, প্রসাধন ব্যবহার করে শুধু পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য। এ ধরনের স্টেরিওটাইপ পুরোনো ঘ্যানঘ্যানানি অনেক তো হলো! আমাদের একটু নতুন ভাবে ভেবে দেখতে হবে।

যেকোনো মানুষই সাজে, একটু ফিটফাট থাকতে চায়, প্রথমত নিজের জন্যই। দেখবেন, একটু সাজলে আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে, আপনার মন ফ্রেস হয়ে যাবে নিজেকে দেখেই। বিষন্নতা, মুড সুইং বা প্রি মিন্সট্রুয়াল সিনড্রম  চলাকালীন সময়ে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ আপনার? কাঁদতে ইচ্ছে করছে? তাহলে  একটু সাজুন। মন অন্যদিকে একটু হলেও ঘুরবে।

আমাদের দেশে অল্পবয়সী মেয়েরা সাজে বেশি আর বয়স্ক নারীরা কম সাজে। পাশ্চাত্যে দেখবেন উল্টোটা। সেখানে মেনোপজের পরে নারীরা বেশি রঙীন পোশাক, রঙীন প্রসাধন ব্যবহার করে। এবং মনের উপর এর ভালো প্রভাবও আছে। বয়স বেড়ে গেলে কেন যে আমাদের দেশের নারীরা সাজা কমিয়ে দেন! অথচ আদিমকাল থেকেই মানুষ নিজেকে নিয়ে সচেতন। তাই কখনো সে রঙ দিয়ে শরীরকে সাজিয়েছে, কখনো উল্কি এঁকেছে। তাদের নিজস্ব প্রসাধন ও সৌন্দর্যবোধ থেকে তারা সাজতো। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো মানুষ নিজেকে নানাভাবে সাজায়।

সুতরাং নারী শুধু পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যই সাজবে, এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নারী সাজবে, তার নিজের জন্যই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *