ধর্ষণ: পুরুষতন্ত্রের ধর্মের দোহাই
তৌকির ইসলাম ।। বাংলাদেশে এ বছর দুর্গা পূজা শুরু হওয়ার পর থেকে যতগুলো ঘটনা বিবেককে নাড়া দিয়েছিল ধর্মীয় প্রতিহিংসাপরায়ণ ধর্ষণের ঘটনায় একজন মানুষ হিসেবে, একজন পুরুষ হিসেবে, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হিসেবে এবং সর্বোপরি এই প্ল্যাটফর্মের একজন ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে অনেক বেশি আহত হয়েছি। বিশেষ করে ধর্ষণের কারণে ১০-১২ বছরের মেয়েটির মৃত্যুর যে খবর শোনা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, সেটি মানতে অনেকটাই কষ্ট হয়েছে। এ ঘটনা যদি সত্য হয়, (এরকম ঘটনা এর আগেও বহু ঘটেছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলাকালে), তবে বলবো, এটি মৃত্যু নয়, এটি হত্যাকাণ্ড। হয়তো শিশু মেয়েটি দেবী দুর্গার মূল্যও বোঝে না, কুরআন হয়তো তার কাছে একটি ধর্মীয় গ্রন্থমাত্র। আসলে এই ধর্ষণের মূল নিমিত্ত কোনদিন ধর্ম হতে পারে না। কেননা এখন অব্দি কোন ধর্ম এহেন হীন কাজকে সমর্থন করে বলে শুনি নি। আসলে এটি কোন ধর্মীয় প্রতিশোধ নয় বরং সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের নিকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ।
আমরা যদি বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখে থাকব যে শত্রুতার জের ধরে পুরুষ পুরুষকে হত্যা করেছে, প্রহার করেছে, আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে। কিন্তু যখনই ঘটনাটিতে কোনো নারীর উপস্থিতি থাকে প্রথমেই তাকে ধর্ষণ করা হয়। এমন কি নারীকে হত্যা করা হলেও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এমন কি প্রতিহিংসার জের ধরে স্ত্রী, কন্যা এদেরকে ধর্ষণ করা হয় কিংবা ধর্মীয় প্রতিহিংসার জের ধরে অন্য ধর্মের নারীদের ধর্ষণ করা হয়। আসলে এর পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। প্রথমত, ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিকৃষ্টতম বাই প্রোডাক্ট। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেহেতু নারীকে ভোগ্য বস্তু ভাবা হয় তাই পুরুষ ধর্ষণকে ধরে নেয় নারীকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে। দ্বিতীয়ত, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভার্জিনিটিকে প্রধান ধরা হয় যার ফলে ধর্ষণকে পুরুষ মনে করে হাতিয়ার। তৃতীয়ত, উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীর ক্ষমতায়নের নামে এখনও পুরুষতান্ত্রিকতা চর্চা করে আসছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে তাহলে ধর্মীয় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই ধর্ষণের ঘটনা কেন পুরুষতন্ত্রকে ইঙ্গিত করে? এর কারণ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মকে পুরুষ ব্যবহার করেছে নারীকে বন্দী আর শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। আর তাই পুরুষ ভাবছে যে ধর্মের দোহাই দিয়ে এই ধর্ষণ করা বীরত্বের কাজ।
এটা যে শুধু আজকের এই কয়েকটি ধর্ষণ তার ক্ষেত্রে নয় বরং ভারতে বিগত বছরে মন্দির বা তার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের পেছনেও রয়েছে পুরুষের এই একই মনোভাব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ জিহাদ বলতেই বোঝে ঝাপিয়ে পড়াকে, রণাঙ্গন শুনলেই মনে করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করাকে। আর তখনই নারীর সাথে ধর্ষণ করাকে মনে করে নেয় এর একটি অংশ হিসেবে।
আসলে সমাজের মধ্যে যতদিন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থাকবে কোনো ধর্মই শান্তি বয়ে আনতে পারবে না। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজেই একটা অসম শোষণের যন্ত্র। আর যেখানে শোষণ থাকে সেখানে ধর্মের দোহাই দেওয়া মরুভূমিতে গ্যালন গ্যালন পানি ঢালার মত।
দুর্গার পায়ে কুরআন যে রেখেছিল, তার শাস্তি কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দিতে পারে নি। এমন কি যারা এই ঘটনার জের ধরে ধর্ষণ করলো, তাদের শাস্তিও এই সমাজ দিতে পারে নি। মাঝখান থেকে কয়েকটি জীবনকে শারীরিক, মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এটা কোন ধর্ম রক্ষার উপায় হতে পারে না।
যেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গোটা নারী সমাজকে সমতা দিতে অপারগ, তারা ঐশ্বরিক বস্তু রক্ষা করবে কীভাবে! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো নিজেকে মহান জ্ঞান করে নারীকে মানুষ জ্ঞান করতেই ভুলে গেছে। সমাজ থেকে এই অসংগতি দূর করতে সবার আগে পুরুষতন্ত্রকে বিদায় দিতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে। ভার্জিনিটির ধারণাকে সমাজ থেকে দূর করতে হবে। নারী ও পুরুষ একই মানুষ- তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো মনুষ্যগোষ্ঠীর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করে যে ধর্ম রক্ষা হয় না বরং এটি যে পরোক্ষভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিদর্শন, তা রাষ্ট্র ও সমাজের মনে রাখা উচিত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]