সামাজিকীকরণের ত্রুটি ও নারী
সুহেলী সায়লা আহমদ ।। নারী সমাজের শিল্প ও সংস্কৃতির অংশীদার। তারও আত্মপরিচয় আছে। কিন্তু এটাকে দমিত করে রাখে সমাজ। নারীর মেধাকে অস্বীকার করে সমাজ ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র কাঠামো তৈরি করে নিয়েছে। যে কাঠামোয় বিয়ের আগে পিতা ও ভাইয়ের কর্তৃত্ব আর বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির কর্তৃত্ব মেনে নেয়। আর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া হিসাবে পরিবারের মা ও অন্যান্য নারী সদস্যরা শিখিয়ে দেন শৈশব থেকেই মেয়ে শিশু হিসাবে কীভাবে তার কণ্ঠস্বর, ক্ষমতা, প্রভাব আর মেধাকে নমনীয় রাখবে। তবুও বর্তমান কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনেক ব্যস্ত হয়েছে এবং সফলও হয়েছে। আজকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিমানচালক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, উদ্যোক্তা হিসাবে নারীকে পাওয়া যায়। এই সব নারীদের সফলতার পিছনের ইতিহাস অনেকেরই অজানা। তবে তারাই পথ তৈরি করছেন আগামীর জন্য। কিন্তু পাশাপাশি বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা যা কিনা বাংলাদেশের নারীদের অর্জনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। কারণ ক্ষুদ্রঋণ, তৈরি পোশাক শিল্প বা অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় হলেও পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগে কতটা স্বাধীন তা নিশ্চিত নয়। তৃণমূল থেকে সংসদ পর্যন্ত আমাদের নারীদের অংশগ্রহণ বেশি হলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা। তাই গুটি কয়েক নারী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেই সেই সমাজে নারীর মূল্যায়ন হচ্ছে তা ভাবার অবকাশ নেই। পরিবর্তন আনতে হবে নারী প্রতি মানসিকতায়। নতুবা নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রীয় জীবনে উচ্চতর শিক্ষা ও দক্ষতা, মানসম্মত জীবিকার সুযোগ, আয় ও সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এইগুলোই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র। কিন্তু কখনোই আমরা ভেবে দেখি না এই ক্ষেত্রগুলোতে সফল হবার জন্য নারীকে উপযুক্ত পরিবেশ দিচ্ছি কি না, একজন পরিণত কর্মজীবী নারী পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হতে পারছে কি না। তার জন্য প্রথমেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াতে। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তার নিজেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল ধরণের মিথষ্কিয়ার জন্য প্রস্তুত করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সমাজ ও সমাজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। পরিবার হলো এর প্রাথমিক স্তর যেখান থেকে মানুষ ভবিষ্যতের বৃহত্তর পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। পরিবারে শিশু যে মনস্তত্ত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠে তারই সুনিপুণ প্রতিফলন ঘটায় বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশে। তার মানে এই নয় যে, কেবলমাত্র শিশুকালেই আমাদের মানসিক বিকাশ হয়। বরং সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশুকালে পরিবার ও পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে যদি সঠিক মনস্তত্ত্ব গড়ে না ওঠে তবে ভবিষ্যৎ জীবনের বৃহত্তর পরিবেশ থেকে আমরা নতুন কিছু শিখতে পারবো না। একই সাথে উপযুক্ত পরিবেশ ও সময়ে সঠিক আচরণও করতে পারবো না।
সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ত্রুটি সমাজে নারীকে মানুষ হিসাবে পরিচিত হতে দেয় না। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে নারীকে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় তার গোটাটাই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় মাসহ অন্যান্য নারী সদস্যরাও পরিবারে কন্যা শিশুটিকে সীমাবদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেন। আর ছেলে শিশুটিকে সুযোগ করে দেন সমাজের বৃহত্তর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। কন্যা শিশুকে শেখান গৃহস্থালির কাজ আর নিজেকে কতখানি অবদমন করে রাখা যায় তার প্রক্রিয়া। আর পুত্রকে শেখান কীভাবে সমাজে টিকে থাকা যায়, লড়াই করে কীভাবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ ধরণের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া নারীকে কখনো আত্মবিশ্বাসের সাথে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহস যোগাতে পারে না। তাই নারীকে ঘরের বাইরে অনাকািঙিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হয়।
আজকের বিশ্ব অনেক দূর এগিয়েছে। নারী এখন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, খেলোয়াড়। নারীর পেশাগত পরিচয় থাকুক আর নাই থাকুক তাদের মাঝে মৌলিক কিছু বিষয়ে মিল রয়েছে। প্রথমত নারীর পেশাগত পরিচয় থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ করার জন্য সমাজের ভ্রুকুটির সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয়ত কর্মজীবী হলেও সব নারী তার উপার্জিত অর্থের উপর অধিকার রাখতে পারে না। তৃতীয়ত মা হিসাবে নারীকে গৃহস্থালী কাজ এবং কর্মক্ষেত্র থেকে যে সাময়িক বিরতি নিতে হয় তাও সমাজ ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিতে দেখে। চতুর্থত কর্মজীবী হলেও সব নারীর পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান সুযোগ নেই।
এই সকল বিষয় নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর পদায়ন হচ্ছে কিন্তু ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। পদায়ন একটি প্রতীকি বিষয় কিন্তু ক্ষমতায়ন বাস্তব বিষয়। সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়ে নারীরা উচ্চ পর্যায়ে আসীন। এসব নারীর প্রতীকি ক্ষমতায়ন। এই প্রতীকি ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নারীকে গৃহেও বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার বদৌলতে। আমাদের বাবা-মাকে মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে। মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে সুপাত্র করার বাইরেও যে অন্য স্বপ্ন দেখা যায় ও বাস্তবায়ন করা যায় বাবা মাকে তা উপলব্ধি করতে হবে। এই উপলব্ধি করার ক্ষমতাই আমাদের প্রচলিত সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভিত্তি নাড়িয়ে দিতে পারে। পরিবার থেকেই যদি পুত্র ও কন্যা একইসাথে আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে তবে সে ভবিষ্যতেও সমাজ ও রাষ্ট্রকে আত্মবিশ্বাসের সাথে ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে। পাশাপাশি পুত্রশিশুও কন্যাশিশুকে বৈরী দৃষ্টিতে নয় বরং বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখতে শিখবে, যার সূদুরপ্রসারী প্রভাব পড়বে পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]