December 23, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

শোষণ ক্যান্সারের মতো, আমাদের অতি লোভ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে

গ্রেটা গার্ড একজন ইকোফেমিনিস্ট অ্যাকটিভিস্ট। কুইয়ার থিওরি, কুইয়ার ইকোলোজি, ভেগানিজম এবং প্রাণীমুক্তি নিয়ে তার কাজগুলো ইকোফেমিনিস্ট স্টাডিজে প্রথম এবং অন্যতম। তিনি উইসকন্সিন রিভের ফলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইংরেজির প্রভাষক, পড়ান মানুষ-প্রাণী বিদ্যা, পরিবেশগত ন্যায়বিচার এবং এলজিবিটিকিউ সাহিত্য। ভিগান রেইনবো প্রজেক্টের নেয়া এই সাক্ষাৎকারটিতে তিনি জানিয়েছেন কীভাবে ইকোফেমিনিস্ট আন্দোলনের সাথে নিজেকে জড়ালেন তা নিয়ে, কথা বলেছেন ইকোফেমিনিজম নিয়ে তার করা কাজগুলো নিয়ে, শুরুর দিকে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, জলবায়ু সংকট কেন একটি ফেমিনিস্ট ইস্যু এসব নিয়ে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন অর্চি সাহা।।

প্রশ্ন: আপনার অ্যাক্টিভিজমের যাত্রার শুরুটা যদি আমাদের বলতেন- কোত্থেকে শুরু করলেন, এখন কোথায় আছেন বলে মনে করেন?

উত্তর: ছোটবেলা থেকেই আমি অন্য প্রাণীদের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারতাম- এটাই আমার নারীবাদ, পরিবেশবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচার মূল্যবোধের ভিত্তি বলে মনে করি। ১১ বছর বয়সে যখন প্রথম অনুধাবন করতে পারলাম আমার খাবার আসলে অন্য প্রাণীদের মৃতদেহ, প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বাবা মার মুখোমুখি হই। তারা আমার এহেন প্রাণীপ্রীতিতে খুব খুশি হয়েছিলেন তা বলতে পারি না। মনে আছে আমার বাবার সাথে তর্ক করে বলেছিলাম, “আমি খিদে পেলে তোমার হাত ছিঁড়ে খাওয়া শুরু করব না, তেমনি একটা পাখিকেও না, কিংবা আমাদের কুকুরটাকেও না”। ঐ বয়সেই আমার মনে হয়েছিল সকল প্রাণীর জীবনবোধ- সুখ দুঃখ, বেড়ে ওঠা, তাদের সংগ্রাম স্বতন্ত্র, কিন্তু কারোটাই নগণ্য নয়।

এছাড়া ছেলেবেলা থেকেই আমি গাছ, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ অত্যন্ত ভালবাসি, এসবই ছিল আমার প্রিয় খেলার সাথী। গাছেদের সঙ্গ, তাদের অবিচল শক্তি, গন্ধ আমাকে বরাবর আকর্ষণ করত। আমার এই ভালবাসা, প্রাণীদের সাথে একাত্মতাবোধ অনুভব করতে পারাটা ভাষায় কীভাবে প্রকাশ করা যায় তা জানতে আমাকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। এই পথচলা সহজ ছিল না, নারী বলে আমি অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছি, আর এই সময়েই আমার নারীবাদে হাতেখড়ি হয় বলতে পারেন। এখনও মনে পড়ে যেদিন আভিভা ক্যান্টরের “দি ক্লাব, দি ইয়ক, দি লিশ” পড়ি; সেক্সিসম, বর্ণবাদ, প্রজাতিবাদের পার্থক্যগুলো পড়ে রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। আমি এতদিন যা ভাবছিলাম তাই সত্যি- এই প্রতিটা বৈষম্য অত্যন্ত গূঢ় পরিকল্পিত ও একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমার ছাত্রাজীবনের সামান্য উপার্জিত অর্থ দিয়ে লেখাটার অনেকগুলো কপি আমার ফেমিনিস্ট স্টাডির ক্লাসে বিলি করে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি এই ভেবে, এমন চাঞ্চল্যকর সত্য সবার চিন্তাকে নাড়িয়ে দিতে বাধ্য। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কারো সাড়া পেলাম না। এই নির্লিপ্ততা আমাকে শেখাল, এই বৈষম্যগুলো নিয়ে লিখে ফেলা তো সহজ কিন্তু এই বঞ্চনার বোধটা মানুষের ভেতর জাগ্রত করতে সারা জীবন লেগে যেতে পারে।

প্রশ্ন: ইকোফেমিনিজমে আপনি একজন সর্বজ্ঞ, এই বিষয়ে কীভাবে আগ্রহী হলেন?

উত্তর: সেক্সিজম/বর্ণবাদ/প্রজাতিবাদ এর সামঞ্জস্যগুলো বুঝতে পারার পর আমি “নারীবাদী, প্রাণী ও পরিবেশ: ইকোফেমিনিসেমের যাত্রা” নামে একটা লেখা লিখি ১৯৮৯ এ ন্যাশনাল ওমেন স্টাডি অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সের জন্য। আমার ধারণা আমিই প্রথম “ইকো” শব্দটা প্রাণী এবং পরিবেশের সাথে যুক্ত করে নতুন শব্দ গঠন করি যেমন করে যুক্ত করি ফেমিনিজমের সাথে; সেক্সিসম ও বর্ণবাদের স্পষ্টতা  বোঝাতে এর চেয়ে মোক্ষম শব্দ আর হয় না বলে মনে করি। ঐ কনফারেন্সে আমার সাথে একই প্যানেলে ছিলেন মারটি খিল (ফেমিনিসট ফর এনিমেল রাইটস এর সহপ্রতিষ্ঠাতা) এবং এরিয়েল সালেহ (অস্ট্রেলিয়ান সোশালিস্ট ইকোফেমিনিসট); সেশন শুরুর আগে যখন রুমে ঢুকতে যাব দেখি রুমের বাইরেও মানুষ গিজগিজ করছে। এটা একটা যুগান্তকারী মুহূর্ত ছিল, প্রত্যেক নারী ভাবছিলেন “ইকোফেমিনিজম” শব্দটি তাদের আবিষ্কার, কারণ তারা এর মর্ম অনুভব করতে পারছিলেন।

সেশনের পর প্রায় ৫০ জন নিয়ে আমরা এনডব্লিওএসএ ইকোফেমিনিস্ট টাস্ক ফোর্স গঠন করি যার সম্পাদক ছিলেন নোয়েল স্টারজন। তারপর আমার কাছে টেম্পল এর সম্পাদক আসেন ইকোফেমিনিজমের ওপর একটা বই লেখার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আমার মনে হল বইটা অনেকের লেখা নিয়ে সম্পাদিত হলে ভাল হয়, কারণ এটা একটা আন্দোলন, কোনো একজন ব্যক্তির আবিষ্কৃত থিওরি নয়। তিনি রাজি হলেন, এভাবেই আমি লেখা সংগ্রহ করতে শুরু করি যা আমার প্রথম বই “ইকোফেমিনিসম: নারী, প্রাণী ও প্রকৃতি” তে স্থান পায়।

প্রশ্ন: ইকোফেমিনিজমকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর: ইকোফেমিনিজমকে আপনি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, এটা নারীবাদের একটা শাখা, পরিবেশ বিদ্যার অংশ, আবার পরিবেশবাদী রাজনীতিও ইকোফেমিনিজমের মধ্যে প্রকাশ পায়। লিঙ্গ বৈষম্য, প্রাণী বৈষম্য, পরিবেশ সংরক্ষন, খাদ্য ও জলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা, স্থানীয় সম্পদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসব আন্দোলনের সাথেও ইকোফেমিনিসট আন্দোলন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা আসলে একটা আত্মউপলব্ধি- মানুষ, বৈচিত্র্যময় প্রাণী জগত, গাছপালা, জলাশয়, ভূমি, বাতাস, শিলা, আগুন এসবই একে অপরের সাথে সংযুক্ত। ইকোফেমিনিসটদের আগ্রহ আর কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন হতে পারে কিন্তু প্রত্যেকেই একটা ব্যাপারে একমত, তাদের পথ আলাদা হলেও একে অপরকে জড়িয়ে আছে।

প্রশ্ন: আপনার শিক্ষকতার বিষয় নিয়ে একটু বলুন। আপনি কোন বিষয়গুলোতে জোর দেন? আপনার ছাত্রছাত্রীদের প্রতিক্রিয়াও জানতে চাই।

উত্তর: এটা আসলে বিশাল একটা জগত, খুব কম কথায় বলাটা কঠিন। আমি বরং উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করি। এগ্রিকালচারাল কাম্পাসে আমি মানুষ-প্রাণীবিদ্যা কোর্সটা চালু করেছিলাম, দুঃখের বিষয় তা এখন আর নেই। যাই হোক, কোর্সটা পড়াবার সময় আমি ছাত্রদের মাইন্ডফুলনেসের মাধ্যমে তাদের শেখাবার চেষ্টা করতাম অন্য প্রাণীদের প্রতি আমরা কীভাবে সহানুভূতিশীল হতে পারি। বলা বাহুল্য, তাদের সহানুভূতি মুহূর্তেই উবে যেত যেই না আমরা প্রাণী খাদ্য ইস্যুটা আলোচনা করতাম। তখন তাদের প্রতিক্রিয়া আর বর্ণবাদীদের আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য অন্যকে বঞ্চিত করার পক্ষে তারা ঠিক যুক্তি দাঁড় করিয়ে নেয়। কিছু ক্ষেত্রে এদের প্রতিক্রিয়া এতই প্রবল যে আমি মাইন্ড ফুলনেসের মাধ্যমে কীভাবে নিপীড়নবিরোধী মনোভাব তৈরি করা যায় তা গবেষণা শুরু করেছি। এখন এটাই আমার কাজের মূল বিষয়। গত বছর এ বিষয়ে একটা থিংক ট্যাঙ্ক চালু করার জন্য আমি বৃত্তি পেয়েছি, যা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন অনুষদের মানুষকে জড়ো করে এ বিষয়টা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। মানুষের খাদ্য হতে গিয়ে প্রাণীদের যে অমানবিক কষ্ট পেতে হয় তা নিয়ে তথ্যের অভাব নেই, অথচ তারপরও এদের বোধোদয় নেই। কেন? আমার শিক্ষকতার জীবনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজে যাচ্ছি এখনও।

প্রশ্ন: আপনার একটা লেখায় উল্লেখ করেছিলেন কীভাবে অতীতে ইকোফেমিনিজম নিয়ে সমালোচনা হয় যার ফলশ্রুতিতে এ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হারিয়ে যায়। এই পশ্চাৎপদতার কারণ কী বলে মনে করেন?

উত্তর: লেখাটায় দুই শ্রেণির সমালোচকের উল্লেখ করেছিলাম- এক দল সেক্স আর জেন্ডার এর সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নারীদের ভোগান্তি হেয় করার চেষ্টা করেছিল, আরেক দল নারীবাদের সাথে কেন অন্যান্য প্রাণী ও প্রকৃতি জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে ছিল। প্রথম দলটাকেই শুধু যুক্তি দিয়ে নিরস্ত করা গেছে।

মূলধারার নারীবাদীরা ও প্রাক্তন ইকোফেমিনিস্ট পণ্ডিতরাও ইকোফেমিনিজমের সমালোচনা করেন। কিছু পণ্ডিত সামাজিকভাবে উচ্চাসনে থাকা নারীবাদীদের দ্বারা অন্য নারীদের শোষণের দিকটাও সমালোচনা করেন যা নারীবাদীরা অস্বীকার করেন। আবার ইকোফেমিনিস্টরা একটা অস্বস্তিকর সত্য ধরিয়ে দেন- প্রকৃতি শুধু নারীকেই সন্তান ধারণের ক্ষমতা দিয়েছে যা নারীকে (মানুষ ও বন্য প্রাণী নির্বিশেষে) শোষণ করার সুযোগ করে দিয়েছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গরুর দুধ আর মুরগির ডিম উৎপাদনের কথা। ১৯৮০, ১৯৯০ ও নতুন শতাব্দিতেও ভেজিটেরিয়ান ইকোফেমিনিস্টরা ফেমিনিজম বলুন, উদ্ভিদ-জীব বিজ্ঞান বলুন, বা বর্ণ-শ্রেণি, লিঙ্গ বা জাতিই বলুন প্রতিটা ইস্যুতে প্রাণ আছে যার তাদেরই প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করেছে। সেজন্য প্রাণীদের উপর নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ন্যায্যতা, প্রাণীদের ইচ্ছাকৃত মরণের মত মিথ চালু, পৃথিবী মায়ের মত ইত্যাদি মানুষের মাথায় ঢুকান ধারণাগুলো ভাঙার কাজ করছে।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় ইকোফেমিনিজমবিরোধী আন্দোলনটা এখনও সক্রিয়?

উত্তর: আমার মনে হয় ইকোফেমিনিজম ও ইকোফেমিনিস্টদের চিন্তাধারা একটা শক্ত ভিত পাচ্ছে। কারণ তাদের আলোচনায় মানুষের সুযোগ সুবিধা ছাড়িয়ে অন্য প্রাণী ও পরিবেশের কথাও উঠে এসেছে। মাইজ ও শিভা’র ইকোফেমিনিসম (১৯৯৩, ২০১৪), অ্যাডামসের সেক্সুয়াল পলিটিক্স অফ মিট (১৯৯০,২০১০), প্লামউডের থিওরি ইন ক্রিটিকাল ইকোফেমিনিসম (গার্ড ২০১৭), শেরলিন ম্যাকগ্রেগরের রুটলেজ হ্যান্ডবুক অফ জেন্ডার এন্ড এনভায়রনমেন্ট (২০১৭) এই বইগুলো যদি বিবেচনা করেন তবে দেখতে পাবেন যে ইকোফেমিনিজম কতটা ভরবেগ পেয়েছে। ইকোফেমিনিস্টদের কাজ প্রাণীদের ন্যায়বিচার সংক্রান্ত আরও অনেক বিষয়ে আলোচনাকে বেগবান করেছে। অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক ও ক্রিটিকাল ইকোফেমিনিস্ট ভ্যাল প্লামউডের “গুডবাই গলি মাউনটেইন” (স্তেফেন ও স্প্রিংকেল ২০১৩) বইটিতে পোস্টকলোনিয়াল ইকোক্রিটিসিজম (হিউগান ও টিফিন ২০১০) ও কুইয়ার ইকোফেমিনিজমের ধারণা কুইয়ার ইকোলজি ও একে অপরের বিরুদ্ধে ইকো ইরোটিক  প্রতিরোধের বিষয়টার সূচনা করেছে। ম্যাটেরিয়াল ফেমিনিজমও (এলাইমো ও হেকমও ২০০৮) ফেমিনিস্ট এনভায়রনমেন্টাল হেলথ মুভমেন্ট ইকোসাইকোলজির শক্ত ভিতের ওপরই গড়ে উঠেছে। তাই হতে পারে ইকোফেমিনিজম নারীবাদেরই একটা থিওরি যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে, এটা কিন্তু সমসাময়িক অনেক সমস্যা নিয়েও কাজ করছে।

প্রশ্ন: আপনার আলোচিত বই “ইকোফেমিনিজম: নারী, প্রাণী, প্রকৃতি” এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন আপনারা এই বইটি লিখেছেন কারণ পরিবেশবাদ, প্রাণীস্বাধীনতা ও নারীবাদ নিয়ে যথেষ্ট কাজ নেই। বন্যপ্রাণী শোষণ ও প্রজাতিবাদ কেন ইকোফেমিনিজমের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন?

উত্তর: প্রজাতিবাদের ধারণাটা কিন্তু আমাদের পরিবেশগত সমস্যা থেকে জন্ম নিয়েছে, প্রথাগত কোন প্রাচীন ধারণা থেকে নয়। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব- এটা একটা পশ্চিমা ধারণা। শুধুমাত্র মানুষেরই মন বা অনুভুতি আছে এটাও একটা চাপিয়ে দেয়া বুলি মাত্র। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের এই ধারণাটাও দাঁড়িয়ে আছে মানুষ ও বন্য প্রাণীর সহাবস্থানে প্রাণী ও প্রকৃতির সুন্দর ভারসাম্যের ওপর। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব এই ধারণা থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে  না পারি জলবায়ু সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না। অন্যান্য প্রাণীদের মত মানুষও একটা প্রাণী, শ্রেষ্ঠ কিছু নয়, এই ধারণাটাই পারে আমাদের মধ্যে কিছুটা বিবেকবোধ তৈরি করতে। শোষণ অনেকটা ক্যান্সারের মত, আপনি যদি এই রোগের একটা কারণ নিয়ে পরে থাকেন তবে রোগ নির্মূল হবে না। তাই শোষণ যার সাথেই হোক না কেন জাতি, বর্ণ, গোত্র বা প্রাণী ভেদে তার বিচার করতে হবে, এতে অংশ নেয়া যাবে না। পরিশেষে আমাদের অতিরিক্ত লোভে দূষণের কারণে একে একে বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে, যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের উচিত বন্য প্রাণীদের রক্ষা করা, ধ্বংস করা নয়।

প্রশ্ন: আপনার কাজের বিশাল একটা অংশ নারী ও জলবায়ু সংকট নিয়ে। এ দুটো কেন প্রাসঙ্গিক বলবেন কি?

উত্তর: আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে জলবায়ু সমস্যার সমাধান বুঝি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দ্বারা সম্ভব। বাস্তবে যদি আধিপত্য, তোষণ ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পরিবর্তন না হয় এর সমাধান হবে না। এলজিবিটি কম্যুইনিটির স্কুলে বুলি হওয়া, ঘৃণা ছড়ানো, বিয়ে করার অধিকার, সুন্দর বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা এসবও জলবায়ু সংকটের কারণ হিসেবে আলোচিত হওয়া উচিত। ইকোফেমিনিজম এগুলোসহ অন্যান্য কাঠামোগত অসমতা নিয়েও আলোচনা করে যা উন্নত বিশ্বের অতিরিক্ত ভোগবাদী আচরণ থেকে উদ্ভূত। সবকিছুর অন্তর্ভুক্তিই পারে জনসংখ্যা সমস্যা, ইকোফোবিয়া, অভিবাসীবিরোধী আচরণসহ অনেক জটিলতার সমাধান দিতে।

প্রশ্ন: খুব সহজ ভাষায় বলবেন কি জলবায়ু সংকট কেন লিঙ্গ বৈষম্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত? পুরুষের চেয়ে নারীই বা কেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?

উত্তর: জলবায়ু পরিবর্তন বলুন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলুন, নারীরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ নারীর দুর্বলতা কিন্তু সহজাত নয়। এই দুর্বলতা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসা লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক অসমতা, বঞ্চনা, দরিদ্রতার ফল। আন্তর্জাতিক এনজিও কেয়ার এর তথ্য অনুযায়ী কর্মঘণ্টার দুই তৃতীয়াংশ কাজ করে নারী, পৃথিবীর অর্ধেক খাদ্যশস্য উৎপাদন করে নারী, অথচ উপার্জন করে মাত্র ১০ শতাংশ। পৃথিবীর ১ বিলিওন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা জনগনের ৭০ শতাংশ নারী। কঠোর পরিশ্রম আর উপার্জন যদি পরস্পর সমানুপাতিক হতো নারীই সর্বাধিক আয় করত। বাস্তবতা তা না। আমাদের সামাজিক কাঠামো নারী ও শিশুদের দুর্বল করে রেখেছে, তারাই পৃথিবীর দরিদ্রতম জনসংখ্যার অগ্রভাগে। পৃথিবী জুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য নারীর উন্নতি রহিত করছে। খাদ্য উৎপাদন, সন্তান পালন এই দায়িত্বগুলো দিয়ে নারীকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেয়া হয়, যার প্রভাব জলবায়ুসহ অন্যান্য অনেক ব্যাপারে প্রতিফলিত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্ভোগ নারীকে খুব বাজেভাবে ভোগ করতে হয়। খাবার পানি সংগ্রহ, পশুর খাদ্য যোগান দেয়া সেখানে নারীর কাজ। বাড়িতে খাদ্য সংকট হলে (যা জলবায়ু পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী ফল) নারীকেই নিজের খাবার বিসর্জন দিয়ে পুরুষ ও শিশুদের খাইয়ে রাখতে হয়। গ্রামে মরুকরণ, খাদ্য সংকটসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত জটিলতলার কারণে পুরুষরা বাধ্য হয় জীবিকার প্রয়োজনে শহরে আসতে, ফলশ্রুতিতে নারীরাই পড়ে থাকেন অর্থ বাদে অন্য হাজারটা সমস্যার সমাধানে। এতসব জটিলতা সামাল দেবার জন্য এদের সহায় নিতান্তই অপরিমিত। এছাড়াও লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে নারী ও শিশু মৃত্যুহার ১৪ গুন বেশি। ১৯৯১ সনে বাংলাদেশের বন্যার কথা ধরুন, ৯০ ভাগ ভুক্তভোগী নারী। এর কারণ বিবিধ। নারীদের সতর্কবার্তা জানাতে অবহেলা, নারীর গৃহবন্দীত্ব, সাঁতার না জানা, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি দায়িত্ব ইত্যাদি বহুবিধ কারণ নারীকে শুধু নিজের জীবন বাঁচানোর সুযোগ দেয় না, অথচ পুরুষরা কিন্তু শুধু নিজেরটাই চিন্তা করতে পেরেছেন। এছারাও যৌন সহিংসতা তো আছেই। একই ভাবে ২০০৪ এ আকেহ ও সুমাত্রার সুনামিতে মৃতের সংখ্যার ৭৫ ভাগ নারী। ২০০৮ এর মে’তে মিয়ানমারে যে সাইক্লোন নার্গিসে মৃত  অথবা হারিয়ে যাওয়া ১৩০,০০০ মানুষের ৬১ শতাংশ নারী। নারী মৃত্যুর হার শিশু মৃত্যুর হারও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও বাড়িয়ে দেয় নারীর বাল্য বিবাহ, নারীশিক্ষায় অবহেলা, যৌন সহিংসতা, পতিতাবৃত্তি। এসবও নারী মৃত্যু দ্বারা প্রভাবিত হয়। এমনকি ইউরোপের শিল্পন্নত দেশগুলোতেও ২০০৩ এর হিট ওয়েভে পুরুষের চেয়ে মৃত নারীর সংখ্যা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে হ্যারিকেন ক্যাটরিনাতেও দরিদ্রতম আফ্রিকান-আমেরিকান নারী গোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি প্রাণনাশের সংশয়ে পড়েন। এসব দুর্যোগ থেকে যেসব নারী বেঁচেও গেছেন তারা শিকার হয়েছেন ধর্ষণসহ অন্যান্য যৌন সহিংসতার। অথচ এসব সহিংসতা কমানো বলুন বা এর ন্যায় বিচার বলুন কোনটাই নারীর নাগালে নেই। এলজিবিটিকিউ সমাজের মানুষের প্রতি সহিংসতারও কোনো বিচার নেই। ২০১৮ তে প্রকাশিত পল হকেনের বই “ড্রডাউন”এ বর্ণনা করা ১০০টা বৈশ্বিক উষ্ণতা সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে, যার কার্যকারিতা গুরুত্বের ক্রমানুসারে আসেনি। বইটিতে দেখানো হয়েছে সমাধানগুলোর মধ্যে উদ্ভিদ সমৃদ্ধ ডায়েট ৪ নম্বর সমাধান, নারীশিক্ষা ৬ আর পরিবার পরিকল্পনা ৭ নম্বরে। বুঝুন! ইকোফেমিনিজমের আলোচ্য মূল বিষয় এটাই যে লিঙ্গ ও প্রজাতিভেদে সহিংসতার সমাধানই দিতে পারে একটা সুন্দর আর্থসামাজিক পৃথিবী।

প্রশ্ন: নারীবাদী কোন প্রজেক্ট, আন্দোলন বা কার আদর্শ আপনাকে সামনে চলার অনুপ্রেরণা যোগায়?

উত্তর: আন্তর্জাতিক নারীবাদী সংস্থাগুলো আমাকে আশান্বিত করে। যেমন উইমেন্স এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ডব্লিউ ই ডি ও) জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আইন নিয়ে কাজ করে; উইমেন্স আর্থ আলাইয়েন্স কাজ করে ভূমি আইন, বীজ সংরক্ষন, সাসটেইনেবল খামার নিয়ে; উইমেন্স ভয়েসেস ফর আর্থ  চুল ও নখের সেলুন দ্বারা পরিবেশ দূষণ কমানো, ঋতুস্রাব ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্য এবং রাসায়নিক উপকরণ নিয়ে কাজ করে। সবশেষে উইমেন্স এনভায়রনমেন্টাল ইন্সটিটিউট খাদ্যের সুষম বণ্টন ও জৈব কৃষি নিয়ে কাজ করে। স্ট্যান্ডিং রক পাইপলাইনে আদিবাসী নারীদের নেতৃত্ব অনেক তরুণ নারীকে উদ্বুদ্ধ করছে। এছাড়াও বের্ত্তা ক্যাসেরেস, মালালা ইউসুফজাই, গ্রেটা থানবের্গ, গ্রিন নিউ ডিল এর কর্মীরা, রিহানা গান-রাইট প্রত্যেকেই দারুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিত নারীর উন্নয়ন খুব সন্নিকটে না আসলে। আমি অনুরোধ করব পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী প্রত্যেক নারীবাদীকে ডেমোক্রেসি নাও, আল জাজিরা, উইমেন্স মিডিয়া সেন্টার, লন্ডনের গার্ডিয়ানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রচার মাধ্যমে এ বিষয়ে অবদান রাখতে। পরিশেষে বলব, প্যাটরিস জোন্সের জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ, যৌনতা ভেদে প্রত্যেক প্রাণীর মুক্তি আন্দোলন ও ভাইন স্যাঙ্কচুয়ারির আন্দোলনকারীরাও অসাধারণ কাজ করছেন। ছোট বড় স্থানীয় প্রত্যেকটা সংস্থার কাজই আসলে আমাদের মোক্ষ লাভে সহায়তা করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *