November 24, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মেয়ে হয়ে ‘ছেলে’ হতে চাও?

সাদিয়া মেহজাবিন ।। আমাদের দেশে এক অসুস্থ বুদ্ধির প্রতিযোগিতামূলক প্রহসন করা হয়, যাকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ নামক শব্দে চালিয়ে দিই। আমি আজন্ম এই দেশের নাগরিক, এখনো এই দেশের শিক্ষা কাঠামোর সাথে জড়িত; আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষা তাই আমিও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধের এখন একজন যোদ্ধা। এই নিম্নমানের শিক্ষা কাঠামো এবং ভর্তিযুদ্ধে তথাকথিত পড়াশোনার বাইরেও আমার নজর বিচিত্র বিষয়ে আটকে যায় বলে প্রথমেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা কোনো বিভাগে প্রথম হবার প্রতিযোগিতামূলক ইচ্ছাকে বাদ দিয়ে আমি কেবল একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদের দেশের মৌলবাদী কিছু মানুষরূপী পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ যারা কিনা শিক্ষক মুখোশধারী, তাদের আচরণে আমি রীতিমতো ক্ষুব্ধ এবং আতঙ্কিত।

অক্টোবর ৩০ তারিখ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত পরীক্ষা ছিল। আমি যথাসময়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কোনো সিট প্ল্যান চেয়ার টেবিলে দেয়নি ফলে শিক্ষকদের আদেশে আমরা যে যার যার মতই বসেছিলাম। সিট প্ল্যান ছিল না এবং পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগেই আমরা উপস্থিত ছিলাম, তাই আমার সামনে থাকা এক শিক্ষার্থী যে কিনা কিছু তথ্য আমার থেকে জানতে চাওয়ায় আমরা কিছুক্ষণ কথা বলেছিলাম। তবে সাক্ষর খাতা পাওয়ার পর আর কোনোরকম কথা বলিনি। কিন্তু উপস্থিত শিক্ষক হুট করে আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন, “এই মেয়ে, এই তুমি কি ঐ ছেলেকে আগে থেকে চেনো? এখানে এসে পাঁচ মিনিটের ভেতর এত কিসের খাই খাতির? ওঠো ঐখান থেকে আর একদম সামনে গিয়ে বসো”। খুব স্বাভাবিক, কথা বলতে দেখে আমাদেরকে কড়া নজরে রাখাটা, কিন্তু তিনি আমাকে একটা কড়া মন্তব্য করলেন। বললেন, “মেয়ে হয়ে ছেলে হতে চাও?” আমি তা স্পষ্ট শুনতে পাই এবং খুবই খারাপ এবং রাগ লাগে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিভাবে একটি পরীক্ষার হলে আমাকে এই মন্তব্য করেন। এরপর কিছুক্ষণ ভাবতেই বুঝতে পারলাম আমি সেদিন জিন্স প্যান্ট এবং টপ্স পরে যাই এবং আমার সামনের শিক্ষার্থী একজন ছেলে ছিল। কি অদ্ভুত! সমীকরণ মেলাতে একদম কষ্ট হয়নি। উনার করা পরবর্তী মন্তব্যে তা স্পষ্ট। “আজকাল মেয়ের সংখ্যা এত বেশি। আমাদের সময় ২০-২৫ জন মেয়ে ছিল এক ক্লাসে। এখন পরিক্ষার্থীর ৩০ হাজার জনই মেয়ে। আসলে তাই তো হবে, কেয়ামতের আগে মেয়ের সংখ্যা বেশি হবে। মেয়েরা ছেলেদের মত হতে চায়।” বিশ্বাস করুন তিনি এসব বলার সময় একবারো ভাবলেন না বাইরের বিভাগ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা কী ভাববে অথবা আমরা সবাই পরিক্ষার্থী এবং এভাবে বৈষম্য করা অন্যায়। মজার ব্যাপার হলো উনার সাথে সহ- পরিদর্শক একজন মধ্যবয়সী নারী যিনি কিনা আগাগোড়া বোরকা দিয়ে ঢাকা এবং তিনিও সুরে সুর মিলিয়ে বলছেন ,‘‘হ্যাঁ ঠিক বলেছেন। আজকাল মেয়েগুলো কি বেহায়া। আমাদের সময় আমরা কত কঠিন শাসনে বড় হয়েছি”।

আমি একদম অবাক হইনি, কেবল ভাবছি এতটা নারীবিদ্বেষী কেন এরা? কোথা থেকে আসে এসব?

যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং আমরা ওএমআর ফর্ম আর প্রশ্ন নিয়ে যুদ্ধ করছি। এর মাঝেই দেখি সে শিক্ষক সকলের উদ্দেশ্যে বাণী দিচ্ছেন। “আমি পিএইচডি করতে গিয়েও দেখি সেখানেও প্রচুর মেয়ে, কিন্তু তারা পাশ করেছিল, তোমরাও পাশ করবা। একবার দেখি এক ছেলে মেয়ে বিমানে মাত্রই পরিচিত হয়েছে এবং সেখানেই প্রেম, আসার পথে বিয়ে করে ফেলে, দেখো, তোমরা যেন এসব আবার না করো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে সুন্দর। বাইরের দেশের শিক্ষকদের ভিডিও করে দেখালে তারা বলে এই জায়গা কোথায় আমরা তো চিনি না, একদিন যাব। তোমরা আল্লাহ্‌র নাম নাও , যার যার রবকে স্মরণ করো”। আমি কেবল ভাবছি এই শিক্ষক যদি পিএইচডি করে থাকে এবং এত উচ্চশিক্ষিত নিজেকে দাবী করে, তারপরেও কেন উনি এত নারীবিদ্বেষী। পরে দেখলাম, না উনি কেবল নারীবিদ্বেষীই না, একজন রেসিস্টও। এবং উনি তীব্র মাত্রায় শ্রেণিবিদ্বেষী। রুমে থাকা পিয়নকে খুব অপমানের সুরে জিগ্যেস করলেন, “এই তুমি কি পার্মানেন্ট? তোমার স্যালারি কত?” পিয়নের কাছ থেকে স্যালারি জেনে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আবার বাণী দিলেন, “তোমরা আবার পিয়নের স্যালারি শুনে চাকরির জন্যে লাফাইয়ো না, শিক্ষকদের বেতন আরো বেশি, এসব পিয়ন ফিয়ন দেখো কত টাকা কামাচ্ছে, তোমরা পড়ে টিকে শিক্ষক হইয়ো!”

ভাবছেন একজন শিক্ষক কীভাবে এসব মন্তব্য করে? হ্যাঁ আমাদের দেশের উচ্চ বিদ্যাপীঠে এভাবেই নারীবিদ্বেষ, শ্রেণিবৈষম্য আর রেসিজম করা হয়। আমার ভাবতে অবশ্য অবাক লাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাও কেন চুপ ছিলেন! একজন শিক্ষক যিনি আমাদেরকে ন্যায়-সাম্য-ভাতৃত্ব- সম্প্রীতি শেখান সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষকরা স্বয়ং পরীক্ষা হলে এমন করছেন। শিক্ষাব্যবস্থার এবং বেহাল অবস্থা যেমন দায়ী তেমন আমাদের পরিবারও দায়ী। কিন্তু একটি প্রশ্ন- বিবেককে কি আটকে রাখা যায়? বিবেকের কি কোনো বন্দী ঘর আছে? তাহলে শিক্ষক হয়েও তিনি কেন এমন আচরণ করলেন? প্রশ্নের উত্তর আপনাদের জানা আছে কিন্তু এতদিনের এই ব্যাধি সারতে হলে আপনাদের বিবেকের পোকা আগে তুলতে হবে।

শিক্ষকের এমন অবস্থা দেখে সমসাময়িক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে নিজেকে আরো টেনে হিঁচড়ে শিরদাঁড়া উঁচু করে উঠাতে পেরেছি।

আমরা যে বিল্ডিং এ থাকি তার একটি ফ্ল্যাট মালিকের বৌ একদিন আমাদের বাসায় একটি কাজে আসেন। আমিও খুব মনখোলা করে আপ্যায়নে চায়ের প্রস্তাব দিই। ভাবী আমাকে বললেন তার বাসায় যেতে হবে কেননা মেয়েদেরকে নাস্তা বানিয়ে খাওয়াতে হবে, উনার দেরি হচ্ছে। আমি বয়সে ছোট এরপরেও মুখ ফসকে বলে ফেলি আপনার দুই মেয়ে তো বেশ বড় হয়েছে তাদেরকে এবার স্বাবলম্বী হতে শেখান। আপনি চা খেয়ে যান। উনি হুট করে বললেন “না আমার তো দুটোই মেয়ে। তাদেরকে দিয়ে কাজ করাই না, তাদের বাপের রাখা কাজের মেয়ে আমি আছি না!” আমি কিছু না ভেবে অত কথা বলে ফেললাম, তাছাড়া ছোটমুখে এত কথা কেন বললাম তা নিয়ে খারাপ লাগছিল, কিন্তু ভাবী আমাকে নাকি বাগে না পেয়ে আমার ভাই ভাবীর কাছে এসে খুব চিল্লায় বলে গেছে “ঐ বেয়াদব মেয়েকে বলবা আমার মেয়েদেরকে আমি ওদের মত করে মানুষ করিনি। যখন তখন বাইরে যাবে আসবে। রাত করে বাসায় ফিরবে। ওদের মত খেটে খেয়ে আমার মেয়েরা বড় হয়নি”। যেহেতু আমি ছিলাম না এবং সবার চেনা সে ঝগড়াটে ভাবীকে স্বয়ং আমার ভাইয়া ভাবী কোনো উত্তর দেয়নি দেখে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং  ভেবেছি গিয়ে উত্তর দিয়ে আসব। কিন্তু আমার ভাই খুব সুন্দর একটি কথা বলাতে পা আর বেশিদূর এগোয়নি। ভাইয়া বলেছেন, “উনি যেহেতু উনার মেয়েদেরকে মানুষ করেনি, তারা অমানুষরূপে মেয়ে হয়ে থাক। তোকে যেহেতু আম্মা মানুষই বানাতে চেয়েছেন, কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে যা।”

বাস্তবে তাই তো। আপনি যেখানেই যাবেন, এমন পুরুষতান্ত্রিক নারী পুরুষে সংসার পরিপূর্ণ। সাথে তাদের অনেক বাণী এবং পুঁথি। এসবের ভীড়ে নিজের কাজ করে যাওয়া যত কষ্টকর হোক না কেন, লড়াই চালিয়ে যাওয়া উত্তম। প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষক বা ভাবীকে কেন উপযুক্ত উত্তর দিলাম না? যদি দিতাম তাহলে কী হতো? তারা বদলে যেতো? তাদের ঘুনে খাওয়া মস্তিষ্ক সতেজ হতো? উল্টো সে শিক্ষক মহোদয় আমার খাতা বাতিল করে আমার মৌলিক অধিকার হরণ করতেন এবং ভাবীর সাথে ঝগড়াতে আমার মূল্যবান সময় অপচয় হতো।

একটি প্রশ্ন আমার আছে, সরকার বিবেককে তালা মারতে না পারুক, ভাবীর মুখ বন্ধ করতে না পারুক, ভাবনা পরিবর্তন করতে না পারুক কিন্তু আমি যৌক্তিক কথা বলাতে যদি শিক্ষক মহোদয় খাতা বাতিল করতেন তার উপযুক্ত বিচার কি সরকার করতেন? কিংবা রাতে নারীরা নিরাপত্তা, মানুষের মৌলিক বাকস্বাধীনতা রক্ষা, নারী পুরুষ সমতা, যৌন হয়রানির বিচার  কি সরকার দিতেন? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় এই লেখার কারণেও যদি আমাদের হেনস্থা করা হয়, তার প্রতিকার কি হবে? ধরুন একজনের মস্তিষ্ক কেন এত নোংরা অথবা কেন আমরা পুরুষতান্ত্রিকতার চরম মাত্রায়? কেন আমাদের কাছে শিক্ষার্থী কেবল শিক্ষার্থী নয়? কেন তারা হুট করে নারী পুরুষ হয়ে যায়? কেন মানুষেরা হিন্দু মুসলিম হয়ে যায়? কেন পেশায় একজন কর্মচারী একজন শোষক হয়ে যায়? এতসব উত্তর খুঁজতে হলে হয়তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে না, তাই চুপ করে মুখ বুঁজে একজন সফল মুসলিম প্রথম সারির ভদ্র মেয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার চেষ্টা করি। প্রহসনের নামে এসব দয়া করে বন্ধ করুন। বাঁচতে দিন।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *