September 20, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট: নিজের সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন যে নারীবাদী

পূরবী চৌধুরী ।।

“A mistaken education, a narrow, uncultivated mind, and many sexual prejudices, tend to make women more constant than men”– A vindication of the rights of woman [page 27]

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ছিলেন ইংরেজ লেখিকা ও দার্শনিক, যিনি নারীদের স্বাধীনতায় তাঁর ক্ষণস্থায়ী জীবনে অসাধারণ কাজ করে গেছেন। তিনি ব্রিটেনের প্রথম নারীবাদী হিসেবে খ্যাত এবং নারীবাদসহ দর্শন, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদি নিয়েও লেখালেখি করেছেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি “অ্যা ভিন্ডিকেশন অফ দ্যা রাইটস অফ ওম্যান (A vindication of the rights of women, সময়-১৭৯২)”- বইটি লেখেন যা তাঁর এক যুগান্তকারী সৃষ্টি, এটি এখনো নারীবাদ এবং নারীদের অধিকারের পদযাত্রাকে অনুরণিত করে। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন প্রাকৃতিকভাবে নারী পুরুষ অপেক্ষা হীন বা নীচে, এমনটি নয়। শিক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। তিনি প্রস্তাব করেন নারী এবং পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে যুক্তিবাদী সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং এর মাধ্যমেই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।

আমরা ২১ শতকের শুরুতে দাঁড়িয়ে আছি, নারীদের বর্তমান এই অবস্থাটুকুও হয়তো অর্জিত হতো না যদি ওলস্টোনক্রাফটের মতো সারা পৃথিবীর আরো নারী নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনে এগিয়ে না আসতেন।

ওলস্টোনক্রাফটের জীবনের পুরো পথটাই ছিল খুব কঠিন, যদি তাঁর লেখা বইটির প্রতিক্রিয়া দিয়েই শুরু করি – বইটির বিষয়ে খুব বিরূপ ধারণা ছিল সকলের, শুধুমাত্র তার চারপাশের উদারপন্থী বন্ধুবান্ধব তাঁকে সহায়তা করেছিলেন এবং অনুপ্রাণিত করেছিলেন বইটি লেখায়। হরেস ওয়ালপল (Horace Walpole) নামক একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক তাঁর এক চিঠিতে ওলস্টোনক্রাফটকে “হায়েনা ইন পেটিকোটস” নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে লড়াই করা ওলস্টোনক্র্যাফট প্রতিনিয়ত সমাজের নানা কটু মন্তব্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন। যখনই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নানা বিপর্যয় এসেছে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ তার দায় চাপিয়েছেন তাঁর নারীবাদী কর্মকাণ্ডের উপর। কারণ তিনি পুরাতন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙ্গে সাজাতে চেয়েছিলেন যেখানে নারীদের অবস্থান থাকবে সমান, একেবারে পুরুষদের মতো। নারীরা রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষেত্রে পাবে সমান অধিকার, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, যা তাদেরকে নিজের অবস্থানে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, যা ছিল তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

১৭৯০ সালে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডমান্ড বার্কের (Edmund Burke) “রিফ্লেশন অন দ্যা ফ্রেঞ্চ রেভুলেশন (Reflection on the French Revolution)” বইটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখলেন “অ্যা ভিন্ডিকেশন অফ দ্যা রাইটস অফ মেন”। কারণ বার্ক পুরাতন সমাজব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন যেখানে পুরুষদের অধিকারকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি মনে করতেন যে, ধর্মীয় ভাবনা এবং নাগরিক স্বাধীনতায় পুরুষদের জন্মগত অধিকার এবং এসব তখনকার পার্লামেন্টের পক্ষে ছিল। তবে বার্কের এই ভাবনাকে অনন্য হিসেবে নেয়নি কেউ। সেই সময় থমাস পাইন (Thomas Paine) তাঁর লেখা বই “রাইটস অফ ম্যান”, ১৭৯১ সালে প্রকাশ করলেন, এই বইটাও বার্কের বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু ওলস্টোনক্র্যাফট আরো এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন, কারণ তিনি যে বইটা লিখলেন যেখানেই আসলে প্রথম নারীদের অধিকারের কথা বলা হলো।

মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ১৭৫৭ সালের ২৭ এপ্রিল লন্ডনের স্পিটাফিল্ডসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন এডোয়ার্ড জন ওলস্টোনক্র্যাফট ও এলিজাবেথ ডিক্সনের সাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। পরিবারের নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলেন ওলস্টোনক্র্যাফট এবং ১৭৮০ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তাঁকে উপার্জনের পথে নামতে হয়েছিল। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারে জন্মালেও তাঁর বাবা তাদের জন্য অভিশাপ ছিলেন, কারণ মদ্যপ ও স্বেচ্ছাচারী বাবার হাতে প্রায়ই তাঁর মা এবং তাঁকে হেনস্তা হতে হতো। যখন তাঁর ভাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছিল সেখানে ওলস্টোনক্রাফট মাত্র কিছুদিন স্কুলে গিয়েছিলেন এবং শুধুমাত্র মেয়ে হবার কারণে সে এই অসমতা এবং বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন। ওলস্টোনক্রাফট এটা বুঝতে পেরে নিজের উদ্যোগে পড়া শুরু করলেন এবং স্বশিক্ষিত হলেন।

২৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর দুই বোন এবং বন্ধু ফ্যানি ব্লাডকে নিয়ে ছোট মেয়েদের জন্য স্কুল চালু করলেন। এটা একটা বেশ বড় আর্থিক চ্যালেঞ্জ ছিল। ওই সময় ওলস্টোনক্রাফটের বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনার ব্যাপ্তি ঘটেছিল, তিনি দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের সাথে উঠাবসা শুরু করেছিলেন সেখানে বহু আলোকিত চিন্তাবিদ পেলেন, যাদের কাছে তাঁর চিন্তাগুলোকে জানালেন এবং সেগুলোর আকার দেয়ার কাজ এগোতে লাগলেন।

১৭৮৬ সালে মেরির বন্ধু ফ্যানি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাবার পর তাঁদের দেয়া স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেল। কর্কে অবস্থিত এক আইরিশ অভিজাত লর্ডের বাড়িতে গভার্নেন্স হিসেবে কাজ শুরু করলেন ওলস্টোনক্র্যাফট। তবে তিনি যে বিষয়গুলো অপছন্দ করতেন সবই সেখানে পেয়েছিলেন, তার একটা হলো ফ্যাশনেবল ফেমিনিজম।এগুলো হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল তাঁকে এবং দ্রুতই চাকরিচ্যুত হয়ে মুক্তি পেলেন তিনি। ১৭৮৭ সালে শুরু হলো তাঁর লেখক জীবনের নতুন অধ্যায়। ওলস্টোনক্র্যাফট এর প্রথম বই “দ্যা ডিড্যাক্টিক থটস অন দ্যা এজুকেশন অফ ডটার”। প্রকাশক জোসেফ জনসনের সাহিত্য পত্রিকায় লেখা শুরু করলেন। সেখানে নিয়মিত আড্ডা হতো থমাস পাইন, এনা ব্যারবাল্ড এবং উইলিয়াম গডউইনদের মত চিন্তাবিদদের সাথে এবং প্রতিনিয়ত নিজে সমৃদ্ধ হতে লাগলেন।

ওলস্টোনক্র্যাফটের জীবনে দুইজন পুরুষ এসেছিলেন। প্রথমজন মার্কিন ঔপন্যাসিক ও ব্যবসায়ী গিলবার্ট এমল। তাঁরা বিয়ে না করলেও তাঁদের ফেনি এমল নামের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। দ্বিতীয় পুরুষটি হলেন উইলিয়াম গডউইন, যিনি একজন লেখক এবং দার্শনিক ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে ওলস্টোনক্র্যাফট ও গডউইন দুজনেই বিয়েবিরোধী ছিলেন। তাদের মধ্যে প্রেম ছিল তাই ওলস্টোনক্র্যাফট গর্ভধারণ করায় তাদের বিয়ে হয়। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে যিনি পৃথিবী বিখ্যাত গথিক উপন্যাস “ফ্রাংকেনস্টাইন”র লেখক, নাম মেরি গডউইন। এই সন্তানের জন্ম দিতে যেয়েই ওলস্টোনক্র্যাফট মারা যান, তাই গডউইন মেয়ের নাম রাখেন মেরি। ১৭৯৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সন্তান জন্মদানের ১১ দিন পর মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী “মেমোয়ার অফ দ্যা অথর অফ দ্যা ভিন্ডিকেশন অব দ্যা রাইটস অফ উওম্যান” (১৭৯৮) নামে একটি জীবনী প্রকাশ করেন। সেখানে ওলস্টোনক্র্যাফটের জীবনের নানা সত্য বিষয় উঠে আসে যেগুলো সকলের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। যার কারণে প্রায় এক শতক তাঁর কাজের মূল্যায়ন হয়নি। কিন্তু বিশ শতকে এসে নারীবাদী আন্দোলনগুলোর জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত ওলস্টোনক্র্যাফট ছোটবেলা থেকেই নারীবাদী ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো তাঁর কাজের চাইতেও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই বেশি চর্চা হয়েছে বিংশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত।

আঠারো শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার ঘটলেও নারীরা প্রাকৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পুরুষের নিচে এমনই ধারণা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবনা ছিল, আর তার পেছনে যে বিষয়টির অবদান রয়েছে তা হলো ধর্ম। এ সময়ে নারীকে ‘Weaker vessel’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হতো। শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হলো, যেখানে কাজের ক্ষেত্রেও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দেখা গেল। নারীরা ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালনে যুক্ত থাকবে আর রাজনীতি, রাষ্ট্রপরিচালনা, অর্থনীতি এসবের কাজে যুক্ত থাকবে পুরুষ, এমনই একটা সমাজনীতি গড়ে উঠছিল। ছাপাখানা আবিস্কারের সুবাদে কিছু শিক্ষিত নারী এ বিষয়ে লেখা শুরু করলো এবং সেই সময় থেকে পশ্চিমে নারীবাদ বিষয়টি চিন্তার একটা বড় ক্ষেত্র জুড়ে ছিল। ব্রিটেনে অবশ্য আর একটু আগেই নারীবাদ নিয়ে ভাবা শুরু হয়েছিল।

এক অসাধারণ জীবনের অধিকারী ছিলেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই চালিয়ে গেছেন। ছোটবেলা থেকে নারীদের অধিকারের যে ভাবনা মনে গেঁথেছিলেন তার বাস্তব রূপ দিতে পিছপা হয়নি।  আজ পর্যন্ত তাঁর মতামত শক্তিশালী একটা জায়গায় অধিষ্ঠিত এবং ব্রিটেনের প্রথম নারীবাদী হয়ে উঠেছিলেন। যৌন সমতা আনয়নেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশ শতকের বিশিষ্ট নারীবাদীরা গুরুত্বের সাথে তাঁকে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ভোটাধিকারবাদী নেতা মিলিসেন্ট ফসেট (Millicent Fawcett) এবং লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ (Virginia Woolf)। রাইটস অফ ওমেন এর দ্বিশতবর্ষী সংস্করণে মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটকে একজন নারীবাদী আইকন এবং অশ্লীলতা ও যৌন অবিচারের বিরুদ্ধে চলমান এক লড়াইয়ের স্থায়ী প্রতীক হিসেবে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়।

ওলস্টোনক্র্যাফটের ভাবনা সবসময় অনেক তাই এগিয়ে ছিল। যেমন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় তিনি সুপারিশ করেছিলেন মিক্সড সেক্স স্কুল অর্থাৎ ছেলেমেয়ে একসাথে স্কুলের শিক্ষায় অংশ নেবে। একই সাথে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার দেয়া যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। বইটিতে শুধু তিনি তাঁর বোধ বা ভাবনাই সবার কাছে পৌছাতে চান নি বরং বেশিরভাগ নারীর অসহায়ত্ব যা সমাজ কর্তৃক জোরপূর্বক করা, এটা  তাঁর মনে ক্ষোভ তৈরি করেছিল, তা প্রকাশ করেছিলেন সব জায়গায়।

তিনি তাঁর বইতে লিখেছিলেন, “I shall first consider women in the grand light of human creatures, who, in common with men, are placed on this earth to unfold their faculties …” (আমি মনে করি নারীরা মানব সৃষ্টির আলোকবর্তিকা, যারা পুরুষের মতোই একইরকম, এবং পৃথিবীতে প্রকাশ হবার অবস্থানে আছে…)

“I attribute [these problems] to a false system of education, gathered from the books written on this subject by men, who, considering females rather as women than human creatures, have been more anxious to make them alluring mistresses than affectionate wives and rational mothers … the civilized women of this present century, with a few exceptions, are only anxious to inspire love, when they ought to cherish a nobler ambition, and by their abilities and virtues exact respect”. (আমি এটার জন্য মিথ্যা শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করি, যা পুরুষদের দ্বারা তৈরি অর্থাৎ পুরুষদের  লেখা বই থেকে সংগৃহীত যেখানে নারীদের মানুষ হিসেবে না দেখে নারী হিসেবে দেখা হয়েছে এবং তাদের মূল অবস্থান স্নেহময়ী স্ত্রী বা যুক্তিবাদী মায়ের চাইতেও উপপত্নী হিসেবে বেশি। বর্তমানের এই সভ্য সমাজে কিছু অংশ ছাড়া নারীদের প্রেমে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, যখন তাদের লক্ষ্য, ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলীকে যথাযথ সম্মান দেয়া উচিত।)

নিজের শরীরের অধিকার বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন- “My own sex, I hope, will excuse me, if I treat them like rational creatures, instead of flattering their fascinating graces, and viewing them as if they were in a state of perpetual childhood, unable to stand alone”.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *