November 2, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

গ্লাস সিলিং: পুরুষ-আধিপত্য যখন নারীকে বঞ্চিত করে

কাজী নাজীফা লামিনূর ।। 


কর্মক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হবে এমনটাই তো স্বাভাবিক। এই পদোন্নতি কারো ক্ষেত্রে স্বপ্নপূরণ ও সফলতার প্রতীক। শুধু তাই নয়, উচ্চপদ অর্জন করতে মানুষকে কত ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের মুখোমুখি হতে হয়। অথচ যখন সফলতা অর্জনের সব নিয়ামক ছাপিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মানুষের লিঙ্গ পরিচয়, তখন একটি সভ্য জগতের জন্য তা খুবই হতাশাজনক।

পুরুষশাসিত সমাজের এমন একটি পরিস্থিতি হলো “গ্লাস সিলিং” (Glass ceiling) যেখানে নারী ও সংখ্যালঘুরা কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদ লাভে বিভিন্ন সমস্যা ও বাধার সম্মুখীন হয়। “গ্লাস সিলিং” একটি  রূপক নামকরণ যার  মাধ্যমে অদৃশ্য এক বাধা বা সীমাবদ্ধতাকে বোঝানো হয়। তবে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এটি পুরোপুরি লিঙ্গ বৈষম্যকে ইঙ্গিত করে। আসলে এই বৈষম্যের চর্চা এমনভাবে হয়ে আসছে যে একজন নারীও হয়তো এ বিষয়ে অবচেতন। আর এই বৈষম্যকে উস্কে দেয় সমাজে প্রচলিত কিছু নিয়ম আর দৃষ্টিভঙ্গী।

নারীর সাফল্যের পথে অদৃশ্য এক বাধার কথা উল্লেখ করে আমেরিকান লেখক মেরিলিন লোডেন (ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট এবং ডাইভারসিটি অ্যাডভোকেট) ১৯৭৮ সালে নিউইয়র্কে এক বক্তৃতায় “গ্লাস সিলিং” শব্দগুচ্ছটি তৈরি করেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে ঐতিহাসিকভাবেই নারীরা কর্তৃত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়েছে। শব্দটি ১৯৮৪ সালে  গে ব্রায়ান্ট একটি বই, “দ্য ওয়ার্কিং উইমেন রিপোর্ট”  এ ব্যবহার করেছিলেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে গ্লাস সিলিং ধারণাটি বেশ আলোচিত হয়। তখন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আর্টিকেলে নারীদের ক্যারিয়ার অগ্রসরে বাধাগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়। মূলত “গ্লাস সিলিং” ধারণাটি উদ্ভাবিত হয়েছিল  কর্পোরেশনের মত বড় অর্থনৈতিক সংস্থার বেলায়। তবে পরবর্তীকালে দেখা যায় এই অদৃশ্য সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রভাব সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও রয়েছে।

এক পর্যায়ে নারী ও সংখ্যালঘুদের উচ্চপদ অর্জনে বাধা সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা বাড়তে থাকে। যার ফলে ১৯৯১ সালে মার্কিন শ্রমবিভাগ গ্লাস সিলিং কমিশন চালু করে। এই কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলি চিহ্নিত করার জন্য।  কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং নির্বাহী স্তরে বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয়  নীতিমালা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তদারকির পর কমিশন রিপোর্ট দেয়  যে যোগ্য নারী এবং সংখ্যালঘুদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদে (উচ্চপদে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বা জয়ী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আরও দেখা গেছে যে কর্মচারী এবং নিয়োগকর্তা উভয়েই লিঙ্গসমতা বিষয়ে উদাসীন এবং তারা বিভিন্ন স্টেরিওটাইপগুলো ধারণ করে রেখেছে।  যার ফলে নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়।

২০২০-এর শেষের দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমশক্তির ৫৫.৯% নারী ছিল কিন্তু যখন প্রধান নির্বাহী পদের কথা আসে, তখন নারীরা এই ভূমিকার মাত্র ২৯.৯% এবং প্রধান নির্বাহীদের ৮৮% শ্বেতাঙ্গ হিসাবে চিহ্নিত।

যেসব ধারণা গ্লাস সিলিং উস্কে দেয়

১. নারীর স্বাধীনতা, নারীবাদ ও নাগরিক অধিকার আইন রয়েছে। সুতরাং ইতিমধ্যে নারী সমতা অর্জিত হয়েছে।

২. নারীদের নির্দিষ্ট কিছু কাজ করা উচিৎ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্ব দান তাদের কাজ নয়।

৩. সিনিয়র এক্সিকিউটিভ কাজের জন্য নারীদের সঠিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রস্তুতি নেই। নারীরা পরিবার ও সন্তান দেখাশুনার পাশাপাশি এত উচ্চপদে কাজ করতে পারবে না।

মার্কিন নারীবাদী সংগঠন ইন্ডিপেন্ডেন্ট উইমেন্স ফোরাম উল্লেখ করে যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালে কর্পোরেট বোর্ডগুলিতে কর্মরত ১১% ছিল এক বা একাধিক নারী, এবং ১৯৯৮ সালে, কর্পোরেট বোর্ডের ৭২%  একাধিক নারী সদস্য ছিল। কিন্তু সেখানে উচ্চপদে ক্ষমতাসীন ছিল পুরুষেরা ।

মার্কিন রাজনীতিবিদ ও লেখক এলিজাবেথ ডোল একবার বলেছিলেন, “শ্রমসচিব হিসাবে আমার উদ্দেশ্য গ্লাস সিলিং সন্ধান করা, যাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সহজ হয়।”

আমেরিকায় সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে নারীর সংখ্যা এখনও পুরুষদের তুলনায় কম। ২০০৮ সালের জরিপ (রয়টার্স, মার্চ ২০০৮) দেখিয়েছে যে, ৯৫% আমেরিকান শ্রমিকরা বিশ্বাস করেন যে নারীরা গত দশ বছরে কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছেন, কিন্তু ৮৬% বিশ্বাস করেন যে এখনো নারীরা কাজের ক্ষেত্রে বাধার মুখোমুখি হন।
গবেষণায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন গোষ্ঠী সমজাতীয়দের চেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সফল হয়।  সুতরাং যেসব  সংস্থাগুলো এখনো নারী ও সংখ্যালঘুদের পিছিয়ে রেখেছে, তারা তাদের আচরণে পরিবর্তন আনলে লাভবান হতে পারে।
গ্লাস সিলিং প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালে উচ্চপদে নারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার, ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজারে। তবে উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ও নীতিনির্ধারণী পদে পুরুষদের আধিপত্য অনেক বেশি। বিবিএসের ২০১৭ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও উচ্চ পদে কর্মরত পুরুষের সংখ্যা ৯৭ হাজার। অর্থাৎ ৮৭ শতাংশের বেশি উচ্চপদ দখল করে আছেন পুরুষেরা। সেখানে নারীর অংশ মাত্র ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। তাছাড়া বাংলাদেশের নারীরা একই কাজে পুরুষের সমান বেতন পান না এবং পুরুষের মতো সব কাজে নারীর প্রবেশাধিকারও নেই।  তবে এটা আশার কথা যে বর্তমানে উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নারীদের কর্মক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য বেশি। অধিকাংশ  ক্ষেত্রে উচ্চপদে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন নারীর চেয়ে পুরুষদেরই বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তার পেছনের কারণ আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা।

কীভাবে রোধ করা যায় এই গ্লাস সিলিং?

সবার আগে  লিঙ্গসমতা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, অগ্রগতিতে যে বাধাগুলি নারীর প্রবেশ রোধ করে তা অতিক্রম করতে হবে। এছাড়া গতানুগতিক বা নারীবিরোধী স্টেরিওটাইপগুলো ভেঙে নতুন নিয়মনীতি নির্ধারণ জরুরি। পুরুষরা এখনও কর্পোরেশন এবং ক্ষমতার অন্যান্য পদে বেশিরভাগ নির্বাহী পদ দখল করে আছে। বিষয়গুলো নজরে আসতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। যার ফলে এখনও কর্মক্ষেত্রে পুরুষ আধিপত্যই বেশি এবং নারীর যোগ্যতার প্রতি অবিচার ঘটেই চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *