‘মানবিক’ কিংবা ‘আসল পুরুষ’রা কি স্বাভাবিক পুরুষ নন?
তাসনিয়া আল সুলতানা ।। গত ১৯শে নভেম্বর পালিত হল বিশ্ব পুরুষ দিবস। প্রতিবছরই পালিত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম অনেকেই “মানবিক পুরুষদের” পুরুষ দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। আর এই “মানবিক পুরুষ” এর সংজ্ঞা হিসেবে দেখানো হয়েছে যেসব পুরুষ নারীকে তুচ্ছ হিসেবে গণ্য করে না, জীবনসঙ্গী হিসেবে নারীর ভূমিকাকে যথাযথ মর্যাদা দেয়, কর্মক্ষেত্রে নারীকে যথার্থ সম্মান দেয়, ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী না করে এর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারীর সাথে আওয়াজ তোলে, নারীর প্রতি লিপ্সু দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে না, তারাই সত্যিকার অর্থে মানবিক পুরুষ।
অথচ একজন মানুষ হিসেবে পুরুষের এই বৈশিষ্ট্যগুলোই তো স্বাভাবিক হওয়া উচিত। একটি স্বাভাবিক ও সাধারণ বিষয়কে অনন্যসাধারণ হিসেবে ধরে নিয়ে “মানবিক পুরুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর” – এই ধারণাকে সর্বগ্রহণযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার মানে কী দাঁড়ায়? মানে যা দাঁড়ায়, সেটি হল – পুরুষ মাত্রই শ্রেষ্ঠ, পুরুষ শক্তিশালী, পুরুষের আবেগ থাকতে নেই, পুরুষের কাঁদতে নেই, পুরুষ হবে ডোমিনেটিং চরিত্রের – এই সমস্ত ধারণাকে সবার কাছে অতি সাধারণ করে তোলা।
আমি প্রায় সময়ই অনেক মেয়েকে দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্ট বা সেই বিষয়ক একটি ছবি শেয়ার করতে, যেখানে লেখা থাকে- “ভাগ্যবতী তো সেই মেয়ে, যে নিজের বাবার মতোই কেয়ারিং একজন স্বামীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পায়।” অর্থাৎ বাবার মতো একজন কেয়ারিং পুরুষ স্বামী বা জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়াটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের। এটি আপাতদৃষ্টিতে একটি ইতিবাচক মন্তব্য মনে হলেও বাস্তবে এই ধারণার মাঝে খুব সুক্ষ্মভাবে পুরুষতন্ত্র লুকিয়ে আছে। আচ্ছা, সচরাচর একজন পুরুষ বাবা হিসেবে তার সন্তানের প্রতি যতখানি যত্নশীল থাকেন, একজন স্বামী হিসেবে তিনি কি তার স্ত্রীর প্রতি ঠিক ততখানি যত্নশীল? উত্তর একেবারেই সহজ, এককথায়, না। আমি ছোটবেলায় আমার নানীকে বলতে দেখেছি “তোর নানাভাই খুব খুঁতখুঁতে আর বদমেজাজী। রান্না আর ঘর গোছানোর কাজে একটু পান থেকে চুন খসলেই মুশকিল। ওমনি ভাঙ্গচুর শুরু”। আমি দেখেছি, আমার নানী একথা বলার সময় তার চোখেমুখে ভয়ের পরিবর্তে একধরণের আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠতো। কারণ তার ধারণা, বদমেজাজ ধারণ করা আর ভাঙ্গচুর করাই হল আসল পুরুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেকোনো কিছু মনমতো না হলেই ভাঙচুর, মারধর করা এ সবকিছুই যেন নিতান্তই স্বাভাবিক; আর একজন “আসল পুরুষকে” জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে তিনি যারপরনাই আনন্দিত ও গর্বিত।
এখন অনেকের মনে হতে পারে নানী-দাদী আমলের মহিলারা এমনই হয়ে থাকেন। সম্পূর্ণ ভুল। এই ধারণা বংশপরম্পরায় বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ পরিবারে আজও প্রতিষ্ঠিত। আমি ছোটবেলায় দেখেছি আমার মা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য রুটি বানানোর সময় আমার বাবা রান্নাঘরের বারান্দায় বসে হাঁড়িপাতিল মেজে দিতেন। মা ঘরের মেঝে মুছলে বাবাকে দেখেছি আসবাবপত্র পরিষ্কার করতে আর কাপড় ভাঁজ করতে। কিন্তু আমার মা যে বাবার এহেন সাহায্যকারী কর্মকাণ্ডে খুব খুশি হতেন, তা নয়। তিনি বরং লজ্জিত হতেন। আমার মা বাবাকে বলতেন যে এসব কাজ পুরুষের নয়। আমার বাবা, মাকে ঘরোয়া কাজে সাহায্য করতেন বলে আমি আমার নানীকে অনেকবার দেখেছি মাকে বকতে। কারণ নারী হয়েও যে পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ আমার নানী তার পরিবার থেকে পেয়েছেন, বংশপরম্পরায় সেটির বিস্তৃতি আমার মায়ের মাঝেও ঘটেছে, আর এজন্যই আমার মায়ের ঘরোয়া কাজে বাবার সাহায্য করার বিষয়টি মা সহজভাবে নিতে পারতেন না।
বাবা হিসেবে সন্তানকে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া যেমন একজন পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে সেই বাবার একজন স্বামী হিসেবে তার স্ত্রীর প্রতি স্বাভাবিক আচরন করাটাও প্রধান দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যখন একটি পরিবারের সন্তানরা দেখবে তাদের বাবা-মায়ের মাঝে একটি খুব সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান, তখন সেটি তাদের মাঝেও ভীষণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বাস্তবিক অর্থেই সুসম্পর্ক অর্থাৎ স্বাভাবিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব পরিবারের সন্তানরাই সুন্দর ও স্বাভাবিক একটি জীবনবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠে। তারা বুঝতে শেখে,নারী-পুরুষ সকলেই মানুষ। একজন মানুষের প্রতি অন্য একজন মানুষের দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা, সহনশীলতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আমি যে স্বাভাবিকতার কথা বলছি সেটি বড়জোর বাংলাদেশের দশ শতাংশ বা তারও কম পরিবারে দেখা যায়। কারণ কিন্তু আমি শুরুতেই বলেছি, যে বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক হওয়ার কথা, খুব সুক্ষ্ম এক পুরুষতন্ত্রের খেল দিয়ে সেই স্বাভাবিকতাকে আমরা দুর্লভ বা এক্সেপশনাল কেইস বানিয়ে ফেলেছি। এজন্যই বলতে শোনা যায় “কজন স্বামী বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করে?” অথবা “যেসব মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে নির্বিঘ্নে চাকরি করার সুযোগ পায় তারা আসলেই ভাগ্যবান।” কেন একটি মেয়েকে বিয়ের পর তার স্বামী কাছে চাকরি করার জন্য “সুযোগ” চাইতে হবে? আর সেই “সুযোগ” পেলে কেন সেই মেয়েকে “ভাগ্যবান” হিসেবে বিবেচনা করা হবে? সাধারণত এমনটিই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ইতিবাচকতার নাম দিয়ে যে নেতিবাচক শব্দগুচ্ছ আমরা ব্যবহার করছি, সেটিই আজ নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ।
যাই হোক, কথা হচ্ছিল পুরুষ দিবস নিয়ে। সত্য বলতে আমি যেকোনো দিবসের বিরোধী, সেটি নারী হোক কিংবা পুরুষ। কারণ আমি মনে করি এই পৃথিবীটা মানুষের। দৈহিক কিছু বিষয় ছাড়া নারী-পুরুষের মধ্যে খুব একটা তফাৎ কিন্তু নেই। এজন্য বিশেষ কিছু দিবস দিয়ে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য জুড়ে দেওয়ার কোন মানে আমি দেখি না। যদিও যেকোনো দিবস পালিত হওয়ার পেছনে ঐতিহাসিক কিছু প্রেক্ষাপট থাকে, এজন্য আমার সাথে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন। কিন্তু আমি যা মনে করি, সেটি হল, সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ মাত্রই মানবিক এবং সুন্দর চেতনাধারী হবে। এটিই হোক স্বাভাবিক, শাশ্বত এবং চিরন্তন।
সবাইকে পুরুষ দিবসের বিলম্বিত শুভেচ্ছা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]