রেহানা মরিয়ম নূর ও আমাদের বন্দিত্বের অনুভূতি
তানিয়া কামরুন নাহার ।। সিনেমা বা নাটকে ইসলামিক বেশভুষার চরিত্রগুলো সাধারণত খুব নেতিবাচক হিসেবে দেখানো হয়। হলিউডের সিনেমা তো বটেই বাংলাদেশের সিনেমাগুলোতেও এরকম চরিত্রগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খল রয়ে যায়। ব্যতিক্রম হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর নাটক বা সিনেমার চরিত্রগুলোতে সব সময়ই একটা ভারসাম্য থাকে। ফলে সাধারণ একটি চরিত্র নামাজ পড়ছে, আমাদের প্রতিদিনের বাস্তব একটি চিত্র খুব সাধারণভাবেই তাঁর নাটক সিনেমায় উঠে আসে। এর বাইরে অন্য সিনেমা বা নাটকে কোনো চরিত্রের নামাজ পড়া বা কোরান তেলাওয়াত করা দেখাই যায় না বলতে গেলে। যেন আমাদের জীবনের বাইরে গিয়ে অন্য কোন জীবন চিত্রায়িত হচ্ছে। রেহানা মরিয়ম নূর’র সার্থকতা এই যে, আমাদের জীবনের খুব সাধারণ যাপন, যার মধ্যে নামাজ পড়াও একটি অংশ, সেটিও বেশ উঠে এসেছে। তাই সাধারণ দর্শক রেহানাকে তাদের চেনা চরিত্র হিসেবে সহজে গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই রেহানাই যদি আর দশটা গতানুগতিক সিনেমার প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবে খুব আধুনিক পোশাকের কেউ হতো, দর্শকের মনে অত বেশি নাড়া দিতে পারতো না। এরকমটা তো সব সময় হয়েই থাকে। পরিচালক সাদ ঠিক এ জায়গাটিতেই একটা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন, খুব আলতোভাবে, কেউ কিছু টের পাবার আগেই।
সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বন্দিত্বের একটি অনুভূতি ঘুরেফিরে আসছে। সিনেমার শুরুতেই রেহানার রুম কীভাবে যেন লক হয়ে যায়। সিনেমা যত এগোতে থাকে, রেহানার সাথে সাথে দর্শকেরাও বন্দী হয়ে যেতে থাকেন একটা প্রচণ্ড ব্যস্ত জীবনের চাপে, সাংসারিক দায়িত্বের মাঝে, নিজের একাকিত্বের সাথে। সেই সাথে নিজের বিবেক আর ন্যায়নীতিবোধ বন্দী হয়ে যাচ্ছে রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা, প্রশাসনিক জটিলতা, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির সংস্কৃ্তিতে। রেহানা নিজেই যেখানে বন্দী, সেখান থেকে নিজের সন্তানকে কীভাবে সে মুক্তি দেবে? তাই নিজের বন্দিত্বটুকুও এক সময় সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয় সে। পরিচালক এভাবে দর্শকের হৃদয় ও মস্তিষ্কে একের পর এক আঘাত করতে থাকেন।
সিনেমায় আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে চরিত্রের পোশাক। রেহানার সাধারণ পোশাক, হিজাব বোরকা এগুলোকে সাধারণত প্রগতিশীলতার বাইরে ধরা হয়। কিন্তু পোশাক দিয়ে প্রগতিশীলতা মাপা সম্ভব নয়। যৌন নিগ্রহের শিকার মেয়েটিকে দেখতে শুনতে, পোশাকে, চুলের কাটে যথেষ্ট আধুনিকা ও প্রগতিশীল মনে হলেও আদৌ কি সে তা ছিল? ভেতরে ভেতরে পুরোনো রক্ষণশীলতার সেই সিন্দাবাদের ভূত পুরোদমে সেই তার ঘাড়ে করে বহন করে চলেছে। পরীক্ষার হলে তাকে বাইরে থেকে দেখে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ও সাহসী মনে হলেও সত্যিই যখন চরম একটি অন্যায় তার সাথে ঘটে গেল, সে একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে রইলো। এমন কি সে এতটাই ভীতু যে একটি অন্যায় সিদ্ধান্তের পক্ষেও জেনেশুনে সে মত দিলো। অন্যদিকে রেহানা ওড়না মাথায় দিয়েও প্রথম থেকেই ঐ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহসিকতা দেখিয়েছে। যদিও তার প্রতিবাদের ধরণে বুদ্ধিমত্তার অভাব ছিল, কখনো কৌশলগত দুর্বলতাও ছিল। তাই নষ্ট সিস্টেমের বেড়াজালে সে আটকে পড়লো একেবারে ভারতীয় সিরিয়ালের ন্যাকাবোকা নায়িকা চরিত্রের মতো। একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ বা বিচার চাইবার সময়েও কখনো কখনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই শুধু মাথা গরম করে একটা কাজে নেমে পড়লেই হয় না আসলে, বিশেষ করে যখন ভিকটিম নিজেই বেঁকে বসে। অতিরিক্ত রাগে ফোঁস ফোঁস করার কারণেই হয়ত রেহানার অনেক সময় মাথায় বুদ্ধি ঠিকমতো খেলে নি। তাই এমন বিশ্রীভাবে ফেঁসে গেল। সিনেমাতে পরিচালক রেহানাকে দিয়ে অ্যানি চরিত্রটিকে চপেটাঘাত করেন নি, করেছেন আসলে দর্শকদের। ছাত্রদের সব আন্দোলনই যে সব সময় নৈতিক কারণে হয় না, এটিই দেখাতে চেয়েছেন। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার মান কেমন তা নিয়ে কথা না বলাই ভালো। স্রেফ সার্টিফিকেট কেনাবেচার চক্করে পড়ে নীতিবান শিক্ষকেরা সেখানে এক প্রকার অসহায়। শিক্ষকদের সেই অসহায়ত্বটাও কিছুটা ধরা পড়লো এ সিনেমায়।
রেহানা মরিময় নূর সিনেমার বিরক্তিকর দিক হচ্ছে নীল স্ক্রিন। দিন বা রাত কিছুই বোঝা যায় না। এছাড়াও রেহানার অতিরিক্ত রাগ, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ, পানির অপচয়, যখন তখন ফোনের রিং বেজে ওঠা বিরক্তির কারণ ঘটায়। অবশ্য বাস্তব জীবনেরই অংশ এসব।
রেহানার প্যারেন্টিং নিয়ে একটু সমালোচনার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য প্যারেন্টিং খুব কঠিন কাজ তার উপর সিংগেল পেরেন্ট হিসেবে কাজটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। যেখানে তিনি শুধু পেরেন্টিংই করছেন না, চাকরি করছেন, সংসার সামলাচ্ছেন, আর্থিক দিকগুলোও তারই দায়িত্বে রয়েছে, নিজের আনন্দ বা দুঃখ কিছুই অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারছেন না। এত মানসিক টানাপোড়েনের মাঝে সিঙ্গেল পেরেন্টদের জীবন আসলেই অনেক বেশি স্ট্রাগলের। এত স্ট্রাগল, এত চাপের মধ্যে সন্তানের সব কথা হয়ত খেয়াল করে শোনাও হয় না। তাই রেহানাও খেয়াল করে নি, তার সন্তান স্কুলে বুলিয়িং এর শিকার হচ্ছে। স্কুলের প্যারেন্ট মিটিংগুলোতেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতে পারে নি। তবুও বুলিয়িং এর শিকার সন্তানকে সে জড়িয়ে মানসিক সমর্থন দেয়, যা সিনেমার একটি আবেগময় মুহূর্ত। ঐ সময়ে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের এক ঝলক চাহনি সত্যি অসাধারণ ছিল। তবে পরিচালক এইখানে একটি ভুল বার্তা দিয়ে ফেলছেন। বুলিয়িং এর প্রতিবাদে আরেকটি বুলিয়িং সমর্থন করেছেন। সিনেমায় রেহানার সন্তানটি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো, তাহলে এরকম বুলিয়িং দর্শকেরা কীভাবে নিতেন? অনেকেই হয়ত জানেন না, বুলিয়িং এর শিকার শিশুরা পরবর্তীতে প্রতিশোধপরায়ন ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এবং আমরা দেখেছি ইমু চরিত্রটি তার মায়ের হাত কামড়ে দিয়েছে, মুখে আঁচড় কাটছে। অথচ রেহানা এই জায়গাটিতে অতটা নির্দয় না হয়ে সন্তানকে সহজভাবে বুঝিয়ে বলতেও পারতেন, বুলিয়িং এর জবাবে বুলিয়িং না করে কীভাবে স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে থাকা যায়, বন্ধুত্ব করা যায় এই ব্যাপারটি। এটি নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতাও চাইতে পারতেন। কিন্তু এটা রেহানা কখনোই করে নি। উলটো প্রশ্ন তুলেছে, স্কুলের শিক্ষককে জানালেই বা কী করতেন? অথচ রেহানা নিজেও শিক্ষক।
একটি চরিত্রের মধ্যে এত স্বয়ংসম্পূর্ণতা আশা করাও ঠিক না, যেখানে আমরা নিজেরাও ত্রুটিযুক্ত। সিনেমার শেষ দৃশ্য দর্শককে একদমই স্বস্তি দেয় না। যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে আমরা সবাই রেহানার মতো বন্দী হয়ে পড়েছি, সেখান থেকে ইমু অর্থাৎ নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করে আনার একটি তাড়না দর্শককে অস্বস্তি দেয়, কাঁদায়।