ধর্ষণ নারীর ‘সম্ভ্রমহানি’ নয়, পুরুষের করা জঘন্য নির্যাতন
সুমাইয়া সেতু ।। বিজয়ের মাস। সামনেই বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি। যে দেশটি আমরা ১৯৭১ এ মুক্ত করেছিলাম হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সেই দেশে এখনো চূড়ান্ত মুক্তি আমরা পাই নি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটা সমতার রাষ্ট্র অসংখ্য না পাওয়ার মাঝে একটি। বরং আমরা এখনো দেখি নানাভাবে নারীকে অপমান করার দৃশ্য। সেই অপমানের অনেক ধরনের মধ্যে একটি বিশেষ শব্দ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বিজয়ের মাসে যে আলোচনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।আলোচনাটি এই জন্যেই করা উচিত যে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকেই সচেতন নই। আর সচেতন নই বলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই কাজটি আমরা করে থাকি। আবার ইচ্ছাকৃতভাবেই এটি তৈরি করা হয়েছে যেন খুব সহজে নারীকে দমন করা যায়।
আমাদের চারপাশে সভা-সমাবেশ, বক্তব্য বা আলোচনায় প্রায়ই আমরা বলে থাকি ‘মুক্তিযুদ্ধে দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা এই স্বাধীন দেশ পেয়েছি’। অর্থাৎ এই দুই লক্ষ মা-বোনের ‘ইজ্জত, সম্মান, শ্রদ্ধা’ সবকিছুই সেই হায়েনাদের শারীরিক নির্যাতনে শেষ হয়ে গেছে। অথচ আমরা লক্ষ্যই করি না যে এই শব্দের মাধ্যমে আমরা আসলে তাদের নির্যাতনের ইতিহাস, ত্যাগ স্বীকারকে করছি অপমানিত। যে নির্যাতন আমাদের নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ, আমাদের ইতিহাসের একটি অধ্যায়, যার ফলে আমরা এই মুক্ত দেশটি পেয়েছিলাম, সেই ইতিহাসের এই অংশটির সাথে ‘সম্ভ্রম’ শব্দটি দিয়ে জুড়ে আমরা আদতেই অপমান করলাম সেই নারীদের, তাদের নির্যাতন সহ্য করবার ত্যাগ’কে।
শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়। এই শব্দটি আমরা যেকোনো ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাই। আমাদের সমাজ নানা ভাবে চায় ধর্ষণের অপরাধী হিসেবে প্রমান করতে। তাই ধর্ষনের সাথে সম্ভ্রমকে গুলিয়ে ফেলার কারণটি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে সম্ভ্রম ও ধর্ষণ যেন এক ও অপরের পরিপূরক শব্দ। ‘সম্ভ্রম’ শব্দটির অর্থ গুগলে সার্চ করলে পাওয়া যায়- মান, মর্যাদা, সম্মান, গৌরব, সমাদর, ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা। তাই যখনই ধর্ষণের সাথে সম্ভ্রম শব্দটি আসে তখনই মনে প্রশ্ন জাগে- ধর্ষণে কি তাহলে আমার সম্মান শেষ হয়ে যায়? নাকি আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা মর্যাদা আমার শারীরিক যন্ত্রণার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে ধ্বংস করে দেয় আমার অস্তিত্ব?
শব্দের এই রাজনীতি নতুন কোনো বিষয় নয়, বহুকাল আগে থেকেই ‘ধর্ষণ’ ও ‘সম্ভ্রম’ এই শব্দ দুটিকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু কেন করা হচ্ছে তার উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাবো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই এর পেছনে দায়ী কোনো না কোনোভাবে। যেখানে ধর্ষণের মতো একটা জঘন্যতম অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িতকে ধর্ষক বলে পরিচিত করাই সমীচীন, সেখানে তা না করে উল্টো নারীকেই বলা হচ্ছে মর্যাদাহীন নষ্টা! শ্লীলতাহানি, সম্ভ্রমহানি ইত্যাদি নানা ইউফেমিজম শব্দ ব্যবহার করে ধর্ষণের শিকার নারীকে করা হচ্ছে অপমান। আর অন্য দিকে যে পুরুষ ধর্ষণ করলো তার ক্ষেত্রে নেই কোনো ধরনের নেতিবাচক শব্দ। ছোটবেলা থেকেই সমাজে সব মানুষের মুখে এসব শব্দ শুনে বড় হতে থাকি আমরা। পত্রপত্রিকা, টিভি, মিডিয়াতেও এই শব্দ দ্বারাই তুলে ধরা হয় ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে। কোনো কোনো হেডলাইন ভিকটিমকেই করে তোলে অপরাধী। এমনকি সচেতন প্রগতিশীল মহলেও হরহামেশা এই কথা শোনা যায়। আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থাটাই এমনভাবে সাজানো যেখানে ধর্ষণের শিকার মানুষটিকেই হতে হয় অপরাধী। এমনকি তাকে কয়েক দফা হয়রানি হতে হয় তদন্তের প্রশ্নে। ফলে এই শব্দগুলো তার জীবনকে করে তোলে আরো দুর্বিষহ।
মান, সন্মান, ইজ্জত এটি কখনোই কারো শরীরে থাকতে পারে না। কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি যে, আমাদের এই একটা শব্দচয়ন ধর্ষণের শিকার নারীকে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার দিকেও। ছোটবেলা থেকেই যাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে ধর্ষণ ঘটলে সম্ভ্রমহানী ঘটে, এই সমাজে ভিক্টিমের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না। সেই মানুষের সাথে ধর্ষণ হলে তখন তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে! এই সমাজ তাকে প্রতিনিয়ত বলে দিচ্ছে যে এই ধর্ষণের ফলে তার মান, সন্মান, গৌরব সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে আর এই ভাবনা তাকে ধাবিত করে আত্মহত্যার দিকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদি বেঁচেও থাকে তবুও বাইরের জগতের মুখোমুখি হওয়ার সাহস থাকে না সেই নারীর। একটা সময় শারীরিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে পারলেও মানসিকভাবে সে হয়ে পড়ে অসুস্থ। আর এই অসম্মানিত হওয়ার ভয়ে হাজারো ধর্ষণের ঘটনা চেপে যায় নারীরা। পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ নারীকে অবদমিত রাখার প্রয়াসে ধর্ষণের শিকার নারীকে নিষিদ্ধ মানুষে পরিণত করেছে। তাই এইসব শব্দ চয়নে আমাদের হতে হবে খুব সতর্ক, যাতে আমাদের এই ভুলের কারণে আর কোনো মানুষকে মাশুল গুণতে না হয়। যেদিন থেকে আমরা ধর্ষণকে শুধুমাত্র একটা ভয়ানক নির্যাতন হিসেবে দেখতে পারবো সেদিন থেকে ভুক্তভোগীও এই ঘটনায় নিজেকে আর দায়ী ভাববে না। জীবন দিয়ে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত সে আর নেবে না।
যখন কোনো মানুষরূপী অমানুষ অন্যায়ভাবে আমাকে আঘাত করে আমি তো লড়াই করি তার শাস্তির দাবিতে, আমার তাতে সন্মানহানি হয় না। তাই মান সন্মানের ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং লড়াই করে যেতে হবে নিজের সমস্তটা দিয়ে। আমার মান সম্মানের সাথে আমার শরীরের কোনো সম্পর্ক নেই, তাই তা ধর্ষণে শেষ হয় না। বরং ধ্বংস হয় ধর্ষকের সন্মান।
এই শব্দচয়নের অভ্যাস যেহেতু দীর্ঘ দিনের তাই হয়তো একদিনে বদলে দেয়া সম্ভব হবে না। তবে আমরা শুরুটা করতে পারি। নারীকে হাজারো প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয় এই সমাজে। সারাক্ষণ ভাবতে হয় তার শরীরের সুরক্ষা নিয়ে। হতে হয় নির্যাতিত, আবার সামাজিক পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে জীবন দিয়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে দিতে। এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাটা এখন সময়ের দাবি। তাই লড়াই চলুক ধর্ষকের বিরুদ্ধে। নারী জানুক, তার অসম্মানিত হওয়ার কিছু নেই, জীবন দেয়ারও কিছু নেই, ধর্ষণ শুধুই ধর্ষণ, একটি জঘন্য অমানবিক নির্যাতন। আর এই বিজয়ের মাস এভাবেই শুরু হোক এই শব্দের পরিবর্তন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]