এক নারীবাদীর সপক্ষে
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে। দিব্যি, রোজকার মতো অফিস গেলাম। গোটা সাতেক অল্পবয়সী মেয়ে একজায়গায় থাকলে কাজের ফাঁকে সাংসারিক, পারিবারিক ও সামাজিক কথা হয়েই থাকে। লাঞ্চ আওয়ারের পরেই স্যার সবাইকে জোর তলব করে বসলেন। আমাদের পুরো কাজটাই ছিল টিম ওয়ার্ক। ভাবলাম নিশ্চয় কোনো অ্যাসাইনমেন্ট আছে। কেউ কেউ আবার একটু স্তম্ভিতও হলাম। স্যারের ঘরে ঢুকে দেখি, তিনি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সবাইকে বাড়ি পাঠাতে উদ্যত। অফিসের প্রত্যেকটা গাড়ি এক একটা রুটে মেয়েদেরকে যার যার নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেবে – এই রকম একটা ব্যবস্থা করছেন। তখন মোবাইলের সুবিধা সর্বজনীন ছিল না। আমরা তাও অফিসের ফোন থেকেই বাড়িতে টিভির খবরে নজর রাখতে বললাম। যদিও তখনও গুজবটা খবর হয়ে ওঠেনি। সম্ভবত স্যার উপরমহল সূত্রেই জেনেছিলেন এবং যাতে কোনো প্যানিক তৈরি না হয় তার জন্য বিস্তারিতভাবে প্রকাশও করেন নি। শুধু এটুকুই বলেছিলেন, কলকাতায় দাঙ্গা হতে পারে। মেট্রোপলিটন বাইপাস ধরে ফিরছি। পার্ক সার্কাস কানেক্টরে এসে দেখলাম প্রচুর কালো ধোঁয়া ভেসে আসছে। ভাবলাম, কোথাও আগুন লেগেছে হয়তো। তারপর বাইকবাহিনী রে রে করে দিগবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে বিজয় উল্লাসে মত্ত। তসলিমা নাসরিনকে রাজ্য থেকে সরানো হয়েছে। আহা, কী আনন্দ!
‘দ্বিখণ্ডিত’ প্রকাশ হবার পর বহু জ্ঞানীগুনি মানুষের ঘুম ছুটে গেছিল। কারো কারো অপার ঔদার্য-মহিমাও চৈতন্য হারিয়েছিল। যদিও প্রবল নাকসিঁটকেও, নারীদের চেয়ে পুরুষরাই ওনার রসাস্বাদন করতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। উনি ‘মহিলা বেশ্যা’র তকমা পেয়েছিলেন। আর ওনার সাহিত্য – সাহিত্য গুণান্বিত হয়নি। আসলে সামান্য একজন অবলা যে এভাবে ভয় দেখাবে এটা ঠিক মেনে নেওয়া যায়নি। তাঁর নামে ফতোয়া জারি হয়েছিল। ফলস্বরূপ বাংলার আশ্রয়টিও চলে গিয়েছিল। পোস্টমর্টেম এখনও চলছে। কেউ বলে, উনি পন্ডিত মানুষদের পিন্ডি চটকে খ্যাতি লাভ করেছেন। অন্দরের কথা বন্দরে প্রকাশ করেছেন। খ্যাতিলাভের ও বিদেশে রাজার হালে বসবাসের যত উপায় আছে সবই ওনার নখদর্পনে। আবার নারীর স্বাধিকারের নামে পলিগামির ছাড়পত্রও চেয়ে বসেছিলেন। আর ওনার লেখা হল সাহিত্যের পর্ণোগ্রাফি।
বিষয়টা বিতর্কিত কারণ আমরা ঐতিহাসিক সত্যের পরিমার্জন পছন্দ করিনা। যা একবার প্রতিষ্ঠিত সেই সত্যকে সংস্কার করার মধ্যেও আমরা দ্রোহের গন্ধ পাই। যার জন্য বহু ধর্মের ভগবানদের ও বিজ্ঞান সাধকদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের সাহিত্যের গায়ে কন্ট্রাসেপ্টিভের আঁচড় লাগলে সাহিত্যের শ্লীলতাহানি হয় এবং সাহিত্যিককে বডিগার্ড নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হয়।
আমি স্ত্রীঅঙ্গের চোখের মণি থেকে যোনির বিপুল ঐশ্বর্যের মাহাত্ম্য কীর্তন করব বিবিধ অলংকার পরিয়ে – সেগুলো শোভনীয়। লুকিয়ে চুরিয়ে নারীদের অশোভন প্রস্তাব দেব, অনিচ্ছাকৃত পলিগামি অর্থাৎ ধর্ষণ করব সেসবও জায়েজ। কিন্তু উনি লিখবেন কেন? আবার উনি যেহেতু নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা বলছেন তাহলে উনি আমার সঙ্গেই বা শোবেন না কেন? স্থিতিশীল ব্যবস্থায় ঢিল মেরেছেনই বা কেন? এইরকম অজস্র কেন’র উত্তর আমার জানা সত্ত্বেও আমি তাঁকে ছেড়ে কথা বলব না কেন? সবটাই আমার অধিকার। সুতরাং তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত খুব যৌক্তিক। এবারের প্রশ্ন – আমিই বা তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে এলাম কেন?
আসতে চাইও নি। খুব ক্ষুদ্র মানুষ। যেটুকু বক্তব্য পেশ করি পুরোটাই মানুষের জীবন পড়ে। সাহিত্য বলতে স্বচ্ছতা বুঝি। একটা চালাক মুক্ত ইতিহাস বুঝি। খানিকটা ফরাসি সাহিত্যের মতো জলবৎ তরলং – মানুষকে যা ভাবায় এবং অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। সেই বেফাঁস সততা লেখকের লেখায় থাকা উচিত যাতে আমরা সেই সত্যেরও যাচাই শুরু করতে পারি। সাহিত্যে চাতুর্য প্রবেশ করিয়ে আমরা বোধহয় দিন দিন নীতিহীন পলিটিশিয়ান মার্কা লেখক হয়ে উঠছি।
নাসরিন যে তথ্যগুলি প্রকাশ করেছেন, সেখানে কোনো মেয়ে বলতে পারবে না যে সেই অনাকাঙিক্ষত ঘটনাগুলির কোনো একটির মধ্যে দিয়ে সে যাতায়াত করেনি। তসলিমা নাসরিন খারাপ না ভালো – সেই প্রশ্নের বিচার করতে গেলে যে সাহসিকতা নামক যোগ্যতা লাগে সেটি আমার অন্তত নেই। আর এ কথাও সত্য যে তাঁকে বিচার করতে যে পরিমান ঠগ ধরা পড়বে তাদের জন্য এত গারদও আমাদের দেশে নেই। কি রিয়েল লাইফ বা কি ভার্চুয়াল লাইফ – সর্বত্র এই দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য। নারী মানেই একটি মাংসসর্বস্ব শরীর এবং আমি যখনই ডাকব তখনই তাকে হাজিরা দিতে হবে – এই কথাগুলো তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা সে তসলিমা নাসরিন যেমন ভাবেই ব্যক্ত করুন না কেন। সেদিনের সেই উত্তপ্ত পরিবেশে আমি তিনজন পুরুষের পৌরুষের পরিচয় পেয়েছিলাম। এক আমার জন্মদাতা বাবা, দ্বিতীয় জন আমার স্বর্গীয় শ্বশুর মশায় ও আমার সেই স্যার, যিনিও পিতৃতুল্য। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, পিতা বা মাতা হবার জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়স বা জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটা একটা পরম নির্ভরতার জায়গা। এই তিনজনেই সেদিন এক সুরে বলেছিলেন- ‘যে পরিবার, যে সমাজ, যে দেশ নারীদের সম্মান করতে পারেনা, তাদের ধ্বংস অনিবার্য’। আমরা কোন পথে এগোচ্ছি বলতে পারেন?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]