November 21, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

নারীবাদের চারটি তরঙ্গ

ফাতেমা তুজ জোহরা ।।

নারী কি মানুষ? প্রশ্নটি ভীষণ বালখিল্য ধরনের হলেও উত্তরটি কিন্তু নিতান্ত সহজ নয়। হুমায়ূন আজাদ তাঁর “নারী” বইটি শুরুই করেছেন বোভোয়ার বিখ্যাত সেই উক্তি – “কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে” দিয়ে। কারণ আমাদের সমাজে এখনো নারী যতোটা না মানুষ, তারচেয়ে অনেক বেশি “ধারণা”, আর তাই নারী শব্দটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে নারীবাদ তত্ত্ব।

নারী এমন কী “জিনিস” যে তা নিয়ে আবার তত্ত্ব থাকতে হবে? নারী রানবে-বাড়বে, সন্তান জন্ম দেবে, ঘর গুছাবে, সেবা করবে, নরম-কোমল ফুল হয়ে রইবে, এইতো নারীর জীবন। সময়ের সাথে একটু আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে এখন নারী চাকরি করবে। আর কী চাই নারীর? সব অধিকারই তো “দেয়া” হচ্ছে। এর মাঝে এসব শক্ত খটোমটো কথা বার্তার দরকার কী?- এই কথাটি আমার নয়, আমাদের চারপাশে পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে থাকা প্রতিটি মানুষের।

নারীবাদ আসলে কী? পুরুষ বিদ্বেষ? নাকি নারীর বখে যাওয়া? এরকম নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে বিশ্বজুড়ে। অথচ নারীবাদের অর্থ কিন্তু অতো কঠিনও নয়। নারীবাদ এমন একটি তত্ত্ব যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রচলিত সমস্ত লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। অর্থাৎ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যতো ধরনের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনই নারীবাদ।

নারীবাদ আন্দোলন এবং তত্ত্ব একদিনে শুরু হয়নি। ধাপে ধাপে এই আন্দোলন এগিয়েছে। নারীর এক সময় পড়ালেখার অধিকার ছিল না, ছিল না ভোট দেবার অধিকার। সময়ের সাথে সাথে নারী একটু একটু করে এগিয়েছে, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। সেই সচেতন হবার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। ক্রমে নারীবাদ একেকটি ঢেউ পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে।

এখন পর্যন্ত মূলত নারীবাদ আন্দোলনে চারটি তরঙ্গ রয়েছে। আজ এই লেখায় আমরা নারীবাদ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে যে চারটি তরঙ্গের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রান্তিক নারীটির কাছে পৌঁছেছে, সেই গল্পই খুব সংক্ষেপে জানবো।

নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ

নারীবাদ আন্দোলনের প্রথম ঢেউ আসে উনিশ শতকের শেষের দিকে। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল নারীর ভোটের অধিকার। নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম ঢেউয়ে যদিও সুসান ব্রাউনমিলার ও এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টনের নামই প্রথমে আসে তবে ইডা বি ওয়েলস, এলেন ওয়াটকিন্স হার্পার এবং সোজার্নার ট্রুথসহ আরো অনেকেরই এ আন্দোলনে মূখ্য ভূমিকা রয়েছে।

নারীবাদের প্রথম তরঙ্গে আন্দোলন আসলে দু’রকম ছিল। এখানে শ্বেতাঙ্গ নারীরা লড়াই করছিলেন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সমান অধিকার পাবার লক্ষ্যে। ভোটের পাশাপাশি শিক্ষা, পেশা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে গর্ভপাতের অধিকার পর্যন্ত এ আন্দোলনের মূখ্য দাবি ছিল। অন্য দিকে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের লড়াই ছিলো বর্ণ বৈষম্য ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

তাই বলা যায়, নারীর ভোটাধিকারের পাশাপাশি নারী প্রতি বর্ণ বৈষম্য দূর করাও এ আন্দোলনের একটি দাবি ছিল।

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ

নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের স্থায়িত্বকাল ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত। এ পর্যায়ে আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো নারীর বেতন সমতা, যৌনতার অধিকার, প্রজনন অধিকার, বৈবাহিক ধর্ষণ এবং পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলা। নারীবাদ আন্দোলনের প্রথম ঢেউয়ে যেমন অনেক দাবিই আইন প্রণয়ন এবং আদালতের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়েছিল, দ্বিতীয় তরঙ্গের বেলাতেও অনেকটাই তাই। লৈঙ্গিক বৈষম্যের পাশাপাশি নারীর প্রতি জাতিগত ও বর্ণগত যে বৈষম্য ও বিভাজন ছিলো সে ব্যাপারেও আন্দোলন করা হয় এ পর্যায়ে। এর আগ পর্যন্ত নারী আন্দোলনে নারীর প্রতি শ্রেণি এবং জাতিগত বিভাজনকে গৌণ চোখে দেখা হতো। নারীবাদের প্রথম ঢেউয়ের পর শ্বেতাঙ্গ নারী ও পুরুষের মাঝের বৈষম্য কিছুটা কমলেও শ্বেতাঙ্গ নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ নারীতে বিভেদ রয়েই গিয়েছিল। শুধুমাত্র গায়ের রঙয়ের বৈষম্যের কারণে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা এমন অনেক সুবিধা বঞ্চিত ছিলেন যা শ্বেতাঙ্গ নারীরা উপভোগ করতেন।

নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গ

১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গের আবির্ভাব ঘটে। নারীকে নতুন আঙ্গিকে দেখা, নারীর ভিন্নতাকে মেনে নেয়া, চ্যালেঞ্জ করাই এই পর্যায়ে নারীবাদ আন্দোলনের ঢেউয়ের মূল বক্তব্য ছিলো। উত্তর আধুনিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তৃতীয় তরঙ্গের নারীবাদীরা নতুন করে নারীত্ব, সৌন্দর্য, যৌনতা, পুরুষত্ব ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করেন।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারীকে নতুন রূপে দেখা শুরু হয় এ সময়ে। এ সময়ের নারীবাদীরা পুরোনো অনেক স্টেরিওটাইপ নারীবাদী তত্ত্বকেও প্রত্যাখ্যান করেন। নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ থেকে তৃতীয় তরঙ্গের মূল পার্থক্য হলো এ সময়ে ইন্টারসেকশানল ফেমিনিজম বা আন্তঃবিভাজন নারীবাদ তত্ত্বের বিকাশ শুরু হয়। ইন্টারসেকশনালিটি শব্দটি আইনজীবী কিম্বার্লে ক্রেনশ চালু করেছিলেন যা নারীর অধিকার কীভাবে বর্ণ ধর্ম ও জাতিগত পার্থক্যের কারণে বিভাজিত হয় তা ব্যখ্যা করে।

নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ

নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গের আবির্ভাব ঘটে ২০১২ সালে। ধরে নিতে পারি নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ এখনো চলমান। সে কারণে এটাকে একদম টু দ্য পয়েন্ট সংজ্ঞায়িত করা একটু কঠিন। এক কথায় বলতে গেলে নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গের মূল হলো নারীর ক্ষমতায়ন।

এ পর্যায়ে রয়েছে নানামুখী আন্দোলন যেমন “মি টু” আন্দোলন। আগের প্রচলিত ধরা-বাঁধা নিয়ম নীতি ভেঙে আবার নতুন নিয়মের কথা বলা হচ্ছে এ পর্যায়ে। যে কোনো অপমান, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে নারীকে নিজের কথা নিজেকে প্রতিবাদের সুরে বলতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। পুরুষের আধিপত্য ভেঙে লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ তৈরির যে স্বপ্ন নারীবাদীরা দেখেন, চতুর্থ ঢেউয়ে সে স্বপ্নই নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেয়েছে। আর এই তরঙ্গের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো অনলাইনে নারীবাদী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়া, নারীবাদীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, সমর্থন, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন।

বিশেষত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বডিশেমিং থেকে শুরু করে যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদের উপর জোর দেয়াই নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্টেরিওটাইপ বিহেভিয়ার থেকেও মেয়েরা এখন বেরিয়ে আসছে।

একটা সময়ে নিজের মানসিক অনুভূতির কথা মেয়েরা প্রকাশ করতো না। ভালোবাসার প্রস্তাব যেন ছেলেদের কাছ থেকেই আসতে হবে, মেয়েরা শুধুমাত্র সাড়া দেয়ার জন্য ছিল। কিন্তু এখন এই ধারণা থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করছে। এরকম আরো বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন রকম হয়রানির বিরুদ্ধেও মেয়েরা মুখ খুলছে। মোট কথা, চতুর্থ তরঙ্গের নারীবাদী আন্দোলনে নারী নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।

সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে আন্তঃবিভাজন পরিলক্ষিত। যেমন শ্বেতাঙ্গ নারীরা এখন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করলেও প্রান্তিক নারীরা কিন্তু একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর সমান অধিকার ভোগ করছেন না। নারীবাদের বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সকল তর্ক-বিতর্কের উর্ধ্বে নারীবাদের উদ্দেশ্য একটাই, লিঙ্গ সমতা। আর লিঙ্গ সমতা তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন শুধু নারীর প্রতি অন্যায় নয় বরং সামাজিক সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *