November 24, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘‘এই শিশুর বাবা কে?”

ফাহিমা আহমেদ ।। কিছুদিন আগে অপু বিশ্বাস, পাশের দেশের নুসরাত জাহানকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশ। নতুন যুক্ত হয়েছে আমাদের পরীমনি। ঘটনা একই, তাদের মাতৃত্ব এবং বাচ্চার বাবা কে বা কীভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। মহান সমাজের চোখে এরা তিনজনই মিডিয়ায় নামা সো কল্ড সেকেন্ড ক্লাস মেয়ে যাদের নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও এসব পবিত্র বিচারকগনের চলতো। নুসরাত, পরীমনি বা অপু বিশ্বাস একটা বাচ্চাকে পরিপূর্ণভাবে জন্ম দেয়া এবং তাকে মানুষ হিসেবে বড় করে তুলতে সক্ষম হলেও, নামমাত্র বাবার পরিচয় প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় স্বীকৃতির। এরা তিনজনই চলচ্চিত্র জগতে স্বনামধন্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতাসম্পন্ন তবু তাদের সন্তানের জন্মকে প্রশ্ন করা হয়, নোংরা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়া হয়।

মাতৃত্ব বরাবরই ব্যাক্তিগত বিষয়, সমাজকে তা নিয়ে না ঘাটলেও চলে যেহেতু মা হবার শুরু থেকেই সমাজের সাথে মায়ের ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরিশ্রমের কোন সম্পৃক্ততা নেই। তবু পিতৃদেবের নাম পরিচয় ছাড়া একজন মানবশিশু হয়ে ওঠে না-মানুষ।
কেন? কারণ বায়োলজিক্যাল বাবারা এই সমাজে চাঁদ, তাদের ঢেকে রাখা যায়না।

বড় হবার পরই খুব চাইতাম অভিভাবকের নামের জায়গায় মায়ের নাম লিখতে। বাবার প্রতি বিরোধ নয় বরং মায়ের প্রতি সুবিচারটুকু হতো। অথবা ধরে নিলাম সুবিচারও বাদ, আমি স্রেফ জানাতে চাই আমি ঐ মানুষটার সন্তান। আমার শেকড় আমার মা, যার নাম এই, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে আমার আইডেন্টিটি শুধুই মায়ের নামের সাথে জোড়া লেগে থাক।
কিন্তু না, মায়ের নামের আগে আমাদের বাবার নাম লেখা বাধ্যতামূলক, মা দ্বিতীয় অপশন। এইখানে উত্তরাধিকার, সম্পত্তির বণ্টন ইত্যাদি প্রাগৈতিহাসিক ক্যাচালের আলাপ আনলাম না।

“বাবা কে?” এই কথা দুটি দিয়েই পরিচয় নিরূপণ হয় আমাদের, যা প্রচন্ড আপত্তিকর লাগে। সে কারণে গত হয়ে গেলে “মা নেই ” মানে মা মৃত আর “বাবা নেই” মানে এ কেমন কথা! এভাবে তো বলতে মানা, লোকে ‘বাস্টার্ড চাইল্ড’ ভাববে!

কাল্পনিক এক দৃশ্য ভাবলাম কাল সন্ধ্যায়। ধরা যাক আমার ভাই এক বছর নিরুদ্দেশ, হঠাৎ কোত্থেকে একটা নবজাতক শিশু নিয়ে বাড়িতে এলো। তাকে কী কী প্রশ্ন করা হবে এবং ইস্যুটা নিয়ে কত হালকা মাথাব্যথা হবে। আর ঠিক এই ঘটনাটা আমার ক্ষেত্রে হলে আমি আসলে বাড়ি ঢুকতেই পারবো কিনা এবং স্পেসিফিক কী কী প্রশ্ন করা হবে! এই শিশুটি আমার কিনা তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হবে – “এই শিশুর বাবা কে?”

জন্মের পর থেকে বাবার পরিচয় এতই বেশি জরুরি আমাদের সমাজে যে সেটা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ। আমরা পাই বাবার পরিচয়, মা পায় আমাদের পরিচয়। একটা সময় তো অমুক তমুকের মা-ই শেষ পরিচয় তাদের, নিজের নামটুকুও হারিয়ে যায়। মায়েদের আমরা ছাপোষা মা করেই রাখতে ভালোবাসি, তারা যে একাই বায়োলজিক্যাল এবং সোশ্যাল আইডেন্টিটি হোল্ডার হতে পারেন স্রেফ জন্মদানের দাবিতে তা মানতে হয়তো আরো কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে, ততদিন সিংগেল মাদার কথাটা মূলধারার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত না।

আরো গল্প আছে। মা বাবা দুটো শব্দই তো সামাজীকিকরণ থেকে জীবনের সব পর্যায়ে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে অসংখ্য স্বপ্ন বাবা দেখিয়েছেন, উড়তে বলেছেন। কিন্তু সেটার পেছনে লেগে থেকেছেন মা, অনুপ্রেরণা দিয়ে, সাহস দিয়ে, পাশে থেকে। অথচ সেই মাকেই সন্তানের কোনো অন্যায় বা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী করা হয় সবসময়। মায়ের প্রশ্রয়েই সব ক্রিমিনাল তৈরি হয়ে যায় যেন! আর বাজিমাৎ করলে বা সফল হলে অমুকের ছেলে, তমুকের মেয়ে, আর এসব অমুক তমুক হলেন রাজাধিরাজ পিতা। অমুক তমুক বংশও পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারী। কেননা আগাগোড়া পিতা স্বর্গ, পিতাই ধর্ম।

সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নারীর সন্তান যাও বা তার পরিচয়ে পরিচিত হয়, যারা এই শ্রেণির বাইরে তাদের হিসেবেই আনা যাবেনা এক্ষেত্রে। আমার চাচীর গল্প বলি, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চাচী এক সকালে তার চেম্বারের পাশে ডাস্টবিনে পেয়ে যান ফুটফুটে এক ফেলে রাখা বাচ্চা, খুব সম্ভবত বিয়েবহির্ভূত কোন ঘটনার ফল। ডক্টর দম্পতির ঘরে আর দুই সন্তানের সাথে সেও বড় হয়েছে সন্তান পরিচয়ে। নিশান তার নাম, চাচী গ্রামে বেড়াতে আসেন না কারণ নিশান আইন স্বীকৃত মা বাবা পেয়েছে, তবে আসল বাবাকে তো খুঁজে পায়নি লোকে! এই সমাজে নিশানের জন্য তার অস্বীকৃতি জানানো সেই কাপুরষ “আদি ও আসল এক নাম্বার খাঁটি” বাবার নিশানা সবার আগে জরুরি।

আমাদের গ্রামে রেশমা আকতার ছিলেন একজন। গার্মেন্টসে যখন কাজ করতেন ঢাকায়, ১০ বছর পর ৫ বছরের এক ছেলে নিয়ে ফিরেছিলেন, ডিভোর্সের কারণে বাবার চেহারা সুরত প্রেজেন্ট করতে পারেনি। লোকের অসুস্থ কথাবার্তার চাপে বেচারি আবার শহরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেজন্যই পৃথিবীর গনিকারা মা হতে চাননা, বিধবা নারী মা হবার কথা ভাবতেই পারেন না, সিঙ্গেল মাদারের প্রসঙ্গে না যাই আর। মাতা মেরির কথা সবাই জানি, তার পবিত্র মাতৃত্ব জাস্টিফাই করতেও তো বলা হয় জেসাস ঈশ্বরের পুত্র। যেহেতু ধর্ম এবং অলৌকিকতা পাশাপাশি চলে, জোর গলায় বলা যেতেই পারতো যিশুর জন্ম রহস্য গোপন। না, তাতে পবিত্র নবীর পরিচয়ে কালিমা লেপন হতো, লোকে তার কথা শুনতো না। বাবার সার্টিফিকেট ছাড়া জন্ম মিথ্যে কয়েকশো বছর আগে থেকেই।

নারীর শরীর নারীর সিদ্ধান্তে নিয়ন্ত্রিত হয়না, সেটা সমাজ-ধর্মের যৌথ সম্পত্তি, সে মাতা মেরিই হোক আর মেরিলিন মনরো হোক। বাবা সামনে না আসাটা গালির উদ্রেক করে, আর গালিটা কিন্তু অবশ্যই নারীকেন্দ্রিক, পুরুষের নাম গন্ধ নেই সেসবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *