November 21, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক ও কিছু কথা

লিখন চন্দ্র দত্ত ।। একটা পাইপ, ম্যাজিকওয়ালা পাইপ। দেখতে ছোট্ট কিন্তু কাজ করে। এর একদিকে নষ্ট-ভাঙা-নোংরা-ফেলনা যা কিছুই ঢোকানো হোক না কেন অপরদিক দিয়ে চমৎকার কিছু একটা বেরিয়ে আসবে। কিংবা এতে চোখ রাখলেই দেখা যাবে অদ্ভুত সব ছবি।

পাইপটা পড়েছিল রাস্তায়। হঠাৎ সেটা আলীর হাতে পড়ে। দাড়িওয়ালা, আধবুড়ো, পাগলাটে আলী। সে পাইপটা হাতে নিয়েই ম্যাজিকটা বুঝতে পারে। তারপর আর পায় কে! শিশুসুলভ কৌতুহলে অনেকক্ষণ ধরে এটা ওটা সেটা পাইপে ঢুকিয়ে আলী নানারকম সব জিনিস বের করতে থাকে। ভাঙা কাচ ঢোকালে বেরোচ্ছে সুন্দর রঙিন গ্লাস, ছেঁড়া কাগজ ঢোকালে বেরোচ্ছে চমৎকার দেখতে সব ছবি। এরম জিনিস কেউ দেখেছে কখনো না নাম শুনেছে? অনেকক্ষণ ধরে আলী বেশ মজেই ছিল খেলাটায়, হঠাৎ যেন কিসের একটা আওয়াজ শোনা গেল! হেলিকপ্টারে করে গোলাগুলির শব্দ। আলী ছুটে গিয়ে পাইপটা চোখে লাগিয়ে আওয়াজটার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে, এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, আর তখনই বোঝা গেল পাইপটাতে চোখ রাখলে শুধু মজার মজার ছবি নয় বরং অভূতপূর্ব এমন অনেক কিছুরই দেখা মেলে, স্বাভাবিক চোখে যা দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন কী দেখে ফেলল আলী যেটায় শেষ পর্যন্ত সে কান্নায় ভেঙে পড়ল?
আলীর এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে প্রতীকি রূপে উপস্থাপন করে আনোয়ার হোসেন পিন্টু পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক। সরল গল্প, সহজ থিম, ছোট্ট ছবি। ওপরে হয়ত ছবির পুরোটাই বলে দেয়া হলো অথবা কিছুই বলা হলো না। কেন? সেটা আরেকটু পরে বলছি।

ছবির নির্মাতা আনোয়ার হোসেন পিন্টু দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত। আশির দশকের গোড়া থেকে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা প্রথম চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন শুরু ও ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। আনোয়ার হোসেন দীর্ঘ তিন দশক যাবৎ দৈনিক পূর্বকোণে চাকরি করেছেন। সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীর বাইরে তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি একজন সত্যজিৎ গবেষক। ২০১৭ সালে তিনি ইতোমধ্যে সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়েছেন, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ১৪ লাইনের গল্প ‘উন্নতিশীল দেশগুলির সমস্যা’ পড়বার সাথে সাথে এ থেকে ছবি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

ছবির মূল চরিত্র ভবঘুরে আলী। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর হেঁটে হেঁটে কিংবা ডাস্টবিন ঘেঁটে কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল, রাবার, পলিথিন এসব সংগ্রহ করে নিজের ঝুলিতে ভরে। দিনশেষে এগুলো বিক্রি করেই সে তার পেট চালায়। ছবিতে প্রথম দর্শনেই আমরা আলীর সাথে একাত্ম হয়ে পড়ি। পাগলাটে দেখতে, হাসি-খুশি চেহারা, গায়ের ছেঁড়া টি-শার্টটার বুকে চ্যাপলিনের মুখ আকাঁ। পুরো ব্যাপারটা যেন আলী চরিত্রে চ্যাপলিনের প্রথম দিককার ছবিগুলোর tramp এর একটা ছায়া এনে দেয়।

আলীর এই বিশেষ অ্যাপিয়ারেন্সের পেছনে কিছুটা ইতিহাস আছে। পরিচালক তাঁর শৈশবস্মৃতি হাতড়ে পাওয়া বিশেষ এক চরিত্রের আদলে গড়েছেন আলীকে। পরিচালক পিন্টু একবার এক সাক্ষাৎকারে শুনিয়েছিলেন কাহিনীটা। ছোটোবেলায় তাঁদের পাড়ায় প্রতিদিন ঝাড়ু দিতে আসতো একটা লোক। লোকটার ভালো নাম কিছু একটা ছিল নিশ্চয়ই কিন্তু এখন আর সেটা মনে নেই। শুধু  মনে আছে লোকটাকে সবাই ডাকত কাউয়ার বাপ বলে! লোকটা দেখতে আধবুড়ো, ময়লাটে চেহারা, গায়ে ছেঁড়া টি-শার্ট, পায়ে ক্যানভাসার জুতো। তাঁর সেই ছেঁড়া টি-শার্টটার বুকে ছিল চ্যাপলিনের মুখ আঁকা। পিন্টু সাহেবের তখনও চলচ্চিত্রের সাথে পরিচয় ঘটেনি। কাজেই চ্যাপলিনকেও তখন চেনা ছিল না। তো প্রতিদিন বিকেলবেলা লোকটাকে দেখা যেত পাড়ায় ঝাড়ু দিচ্ছে আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার লোকটাকে দেখামাত্র রাজ্যের কাক সব যে যেখানে আছে একসাথে প্রচন্ড শব্দে ডানা ঝাপটে কা-কা কা-কা রবে লম্ফ ঝম্প করে সারা পাড়া মাথায় তুলত! যে কারণে পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে লোকটার পিতৃদত্ত নাম লুপ্ত হয়ে রটে গেল ‘কাউয়ার বাপ’! কাকেদের ঝটপটানিই জানান দিত কাউয়ার বাপ এসেছে ঝাড়ু দিতে।

ছবি জুড়ে বারবার ঘুরেফিরে এসেছেন চ্যাপলিন। প্রথমদিককার একটি দৃশ্যে আলী ডাস্টবিন ঘাটাঘাটির সময় একটা স্বর্ণের চুড়ি খুঁজে পায়। ক্লোজ আপে দেখা যায় সেটা পরিষ্কার করার জন্য বুকে ঘষে নিচ্ছে, আমরা দেখি সেটা আদতে ঘষা হচ্ছে বুকে চিত্রিত চ্যাপলিনের মুখে। সোনা, সাথে চ্যাপলিন। আমার মনে পড়ে যায় গোল্ড রাশের কথা। এই ছোট্ট সিকুয়েন্সটা দিয়ে পরিচালক গোল্ড রাশের অনুষঙ্গ টেনে এনেছেন কি? হতে পারে। পরের দিকেও দেখা যায় ম্যাজিকওয়ালা পাইপটা থেকে বেরিয়ে আসছে দ্য কিড ছবিতে চ্যাপলিনের একটা ফটোগ্রাফ। সেটা পেয়ে নিজের জামায় থাকা ছবির সাথে মিলিয়ে আলী হাসিতে ফেটে পড়ে।

শিল্পে সেই আদ্যিকাল থেকে একটা অলিখিত নিয়ম চলে আসছে। তা হলো নোংরা বা বিব্রতকর কিছুই দেখানো যাবে না। ময়লার পাহাড়ে শ্যুট করা, ছবিজুড়ে ময়লা, ডাস্টবিন এসব বারবার করে দেখানো হচ্ছে, এমন ছবি আবার কে দেখতে যাবে রে বাবা? শিল্পে দেখানো হবে সুন্দর; এতো সব বিচ্ছিরি, এখানে দেখার কী আছে? একটা সুন্দর জায়গায় গিয়ে শ্যুট করলেই তো পারতো! কিন্তু শিল্পীকেই আর কি করে দোষ দিই বলুন? ময়লা ফেলতে ফেলতে যখন পাহাড় হয়ে যায়, তখন তাঁকে তো সেই ময়লার পাহাড়েই ক্যামেরাটা তাক করতে হয়। অন্ধকার হলভর্তি দর্শককে বাধ্য করতে হয় সেইদিকে তাকাতে, হলের বাইরে যেসবের দিক থেকে তারা ঘেন্নাভরে মুখ ফিরিয়ে নেবেন! দর্শকের তবুও রক্ষে চলচ্চিত্র শুধুমাত্র দৃশ্য ও শ্রাব্যের মাধ্যম, এর রস আস্বাদনে ঘ্রাণেন্দ্রিয়টার কোনো সাহায্য নিতে হয় না। কিন্তু যারা ছবিটা তৈরির নেপথ্যে ছিলেন তাঁদের সেই সুবিধে নেই। ছবির প্রায় অর্ধেকটাই তোলা হয়েছে আক্ষরিক অর্থেই একটা ময়লার পাহাড়ে; পুরো চট্টগ্রাম শহরের সব বর্জ্য যেখানে নিয়ে জমা করা হয়। সেখানে পাঁচ মিনিট থাকলেই চরম দুর্গন্ধে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের পেট গুলিয়ে ভীষণ রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সেই বিরূপ এলাকায় ক্যামেরা-লোকজন নিয়ে শুটিং করে আসা কিন্তু কিছু কম কথা নয়! শুনেছি শুটিং চলাকালে তীব্র দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে ইউনিটের কয়েকজন তো অসুস্থই হয়ে পড়েছিলেন!

প্রথম দেখাতে মনে হতে পারে ছবিটা আলীর গল্প। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ছবিটা একইসাথে আলী যেখানে থাকে সেই জায়গাটারও গল্প, সেই ময়লার পাহাড়টারও গল্প। ময়লার স্তুপ জমে জমে পাহাড়ের রূপ নিয়েছে। নিত্যদিনকার ফেলে দেওয়া বর্জ্য থেকে এই পাহাড়গুলোর সৃষ্টি। এর আশপাশেই আলী থাকে। তার শরীর, পোশাক-আশাকও সেরকম নোংরা। কিন্তু তার মুখটা? সবসময় হাসিখুশি, ঝলমলে। আর মুখ তো মনেরই প্রতিবিম্ব। অন্যদিকে শহুরে লোকগুলোর আবাসস্থল বেশ পরিষ্কার, তাদের পোশাক-আশাকও মার্জিত। কিন্তু সেই কৃত্রিম জামার বুক পকেটের নিচে লুকিয়ে থাকা মনটি কেমন? সেই মনটা কি একটা অপরিচ্ছন্ন ও আপাতদৃষ্টিতে পাগলাটে লোককে তার কাছে পিঠে ঘেঁষতে দেয়? তার চোখের সামনে লোকটার খাওয়া কি সে সহ্য করতে পারে? যখন কি না লোকটা অন্য সকলের মতো খাবারের জন্য পয়সা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তাই বলে আলী না খেয়ে থাকে না। তার খাওয়া জোটে তারই মতো একটু নিচুস্থরের বাসিন্দা টঙের দোকানির কাছে। গরিব গরিব ভাই ভাই, মোদের মাঝে লাজ নাই। লাজ যে নাই সেটা খাওয়ার সময় আলীর মুখে ফুটে ওঠা হাসি থেকেই বোঝা যায়। তৃতীয় বিশ্বের নিত্যদিনকার চেহারা, মানুষের ভেতর-বাহিরের এই contrast সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে এ ছবিতে।

ছবির দুটো উল্লেখযোগ্য দিকের একটা হচ্ছে পুরো ছবিটাই তোলা হয়েছে অনলোকেশনে। চট্টগ্রাম শহরের পরিচিত রাস্তাঘাট, অলি-গলি, অফিসপাড়া, মার্কেট ছবির প্রথম দিকটায় ঘুরে ফিরে এসেছে। নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে দিনেরবেলা শুটিং করতে গিয়ে পরিচালককে যে কি পরিমাণ ঝক্কি পোহাতে হয়েছে তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। আরেকটু কম ব্যস্ত পরিবেশে বা নিরিবিলি সময়ে শুটিং করলে বোধহয় গল্পে তেমন একটা সমস্যা হতো না। কিন্তু ছবির authenticity রক্ষায় কম্প্রোমাইজ না করে পরিচালক তাঁর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দিকটা হলো ছবিতে ডায়লগের পরিমাণ অতি সামান্য; অল্প যা কিছু আছে তাও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। বিশেষত এ ভাষা ছবিতে অভিনয় করা অনভিনেতাদের সকলের কথ্যভাষা হওয়ায় তাদের দৈনন্দিন জীবনের charm ফুটিয়ে তুলতে আলাদা করে কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি। “ইবা হন আবার? ন ত সিনিলাম”, মোনালিসার ছবি দেখে মুচকি হাসতে হাসতে আলীর এ জাতীয় কথাবার্তার humor একমাত্র এ অঞ্চলের লোকেরাই ধরতে পারবেন।

গল্প অনুযায়ী আলী একটা পবিত্র আত্মার অধিকারী। শহুরে লোকগুলো নানারকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে সে স্বভাবস্বরূপ ক্ষেপে ওঠে ঠিক, কিন্তু অতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া (স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে যতটা দেখানো স্বাভাবিক) দেখায় না। তাঁর অতীত-ভবিষ্যত বলে কিছু নেই, সে বাস করে বর্তমানে। কাজেই তার কাছে এসব নিত্যদিনের ব্যাপার-স্যাপার গায়ে মাখার কোনো অর্থ নেই। আলী চরিত্রটি ও তার প্রতিক্রিয়া বুঝতে আমাদের কিছুটা পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি পরিচালক রবার্ট ব্রেসোঁর ছবি Mouchette। মুশ্যেৎ ছবির গল্প একটা ১৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে যার কাছে পৃথিবীটা নরক হয়ে উঠেছে। সবদিক দিয়ে অত্যাচার নেমে এলেও আমাদের আলীর মতো সে স্বভাবসুলভ তেজ দেখায় বটে কিন্তু তেমন কোনো প্রতিবাদ করে না। ছবিতে ব্রেসোঁ তাকে একজন সন্ত ধরে নিয়ে খ্রিস্টীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইলেন জগতের নানারকম অশুভ ও অমঙ্গলের সাথে সাক্ষাৎ ও তাদের দ্বারা অত্যাচারিত হবার পর শেষ পর্যন্ত মুশ্যেৎ এর প্রতিক্রিয়া কীরকম হয়। ছবিতে মুশ্যেৎ এর একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী তার মায়ের মৃত্যু হয়, সে যাকে ভালোবাসত, ধর্ষিত হয় তার দ্বারাই, পিতা ও ভাই হয়ে ওঠে চরম নিষ্ঠুর, পাড়াপ্রতিবেশি ও সহপাঠীদের কাছে হয় লাঞ্ছিত, ধর্ম তাকে করে পরিত্যাগ; অর্থাৎ তার চারপাশটা ঈশ্বরবিহীন একটা জগতে পরিণত হয়েছে বলা যায়। শেষ পর্যন্ত ব্রেসোঁর অদ্ভুত বিষন্ন-সুন্দর একটা সিকোয়েন্সে মুশ্যেৎ সুইসাইড করে। এখানে Mouchette ছবি নিয়ে বার্গম্যানের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। “She’s a saint and she takes everything upon herself, inside her, everything that happens around her. That makes such an enormous difference that such people live among us. I Don’t believe in another life, but I do think that some people are more holy than others and make life a bit easier to endure, more bearable. And she is one, a very, very simple one, and when she has assumed the difficulties of other human beings, she drowns herself in a stream.”

তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক ছবিতে আলী ম্যাজিকওয়ালা পাইপটা পাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ আমোদে কাটায়। ছোট্ট শিশুর কাছে সদ্য কেনা খেলনা যেমন বিস্ময়কর কৌতুহলোদ্দীপক আনন্দদায়ক; আলীকেও তেমনি ভুলিয়ে রাখে ম্যাজিকওয়ালা ছোট্ট পাইপ। এর মধ্যে সে বসে বসে হাতের কাছে যা পাচ্ছে ঢুকিয়ে পাইপ থেকে বের করছে অনন্য সব বস্তু। হঠাৎ করে সেই নিরিবিলি পরিবেশে তীব্র গোলাগুলির কর্কশ শব্দে কান ঝালাপালা হবার অবস্থা হয়। ছুটে গিয়ে পাইপটা চোখে লাগিয়ে আলী এদিক ওদিক ফিরে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু পাইপটা তো চারপাশের আর দশটা পাইপের মতো নয়! এর মধ্যে চোখ রেখে আলী দেখে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মৃত্যু, গণহত্যা, যুদ্ধ, শিশুদের আহাজারি। অতীত এবং ভবিষ্যত এক হয়ে ধরা দেয় পাইপের মধ্য দিয়ে। আলীর চোখে দৃশ্যমান হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক মায়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত করার মত ঘটনা। গীতার একাদশ অধ্যায়ে যেমন অর্জুন প্রত্যক্ষ করেন ঈশ্বরের বিশ্বরূপ দর্শন; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে যেখানে ঈশ্বর তাঁর সমগ্র রূপ দেখাতে রাজি হন অর্জুনকে। তখন অর্জুন দেখেন সেই অলৌকিক দৃশ্য, ঈশ্বর ধারণ করেছেন এক বিশাল মূর্তির রূপ, দানবীয় সেই আকারে মূর্ত হয়ে রয়েছে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড। তাঁর একদিকে শ’য়ে শ’য়ে জীব ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে, অপরদিকে ঘটছে নবজীবনের সূচনা। চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সমগ্র সৃষ্টি লীন হয়ে আছে ঈশ্বরে, আর ঈশ্বর – সমগ্র সৃষ্টিতে। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, লৌকিক-অলৌকিক, স্বর্গ-নরক, পাপ-পবিত্র সব মিশে গিয়ে রূপ নিয়েছে এক বিশ্ব প্রতিমার। তাঁর মুখের ভেতর দেখা যাচ্ছে সমস্ত নক্ষত্ররাজি। ঈশ্বরের সেই রূপ সহ্য করার শক্তি ছিল না অর্জুনের; চোখ ঝলসে যেতে থাকে তাঁর। তিনি ঈশ্বরকে অনুরোধ করেন ঈশ্বর যেন এই রূপ পরিগ্রহ করে পুনরায় স্বাভাবিক মনুষ্যরূপে (শ্রীকৃষ্ণ) ফিরে আসেন। পাইপে চোখ রেখে আলীরও সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কি? অতীব সুন্দর কোনো নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে কিংবা সংগীতের মূর্ছনায় মানুষ যেমন একটা পর্যায়ে চলে যায়, যেখানে সে ও তার অনুভূতিতে আর কোনো পার্থক্য থাকে না; আমরা বলি লোকটা আত্মহারা হয়ে গেছে। হতে পারে আনন্দে আত্মহারা, কিংবা বেদনায় কিংবা সুরে কিংবা কোনো অলৌকিক দৃশ্যে। আলী কিংবা মূশ্যেৎ এর এই ‘আত্মহারা’তে উচ্ছাস নেই। আছে বেদনা। মূশ্যেৎ এই পর্যায়ে পৌছে আত্মাকে উন্মুক্ত করে দেয় দেহের বন্দিত্ব থেকে। আর আলী? আলী ভেঙে পড়ে কান্নায়, বীভৎস কান্নায়!
এখানে লক্ষনীয় ছবির শেষের অংশে আলীর কান্নার পুরো ব্যাপারটাই হয়ত মেলোড্রামা হয়ে যেতে পারে কিন্তু দর্শক যদি প্রথম থেকেই আলী চরিত্রের সাথে একাত্ম হতে পারেন তাহলে বোধহয় শেষ দৃশ্য হিসেবে ব্যাপারটা উৎরে যায়।

টেকনিক্যাল দিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক ছবির শেষাংশ বোধহয় সবচেয়ে বাজে হয়েছে। টেকনিক্যাল কিছু গলদের ফলে অপেশাদারিত্বের ছাপ পরেছে ছবিতে। কোনো সিম্ফনির একটা মুভমেন্ট অনেক্ষণ ধরে নানারকম modulation করে ধীরে ধীরে গড়ে তোলার পর কাউন্টার পয়েন্টে পৌঁছে যদি সুর ভেঙে যায় তাহলে পুরো মুভমেন্টের কাটামোটাই ভেঙে পড়ে। এখানেও শেষের অংশে যখন আলী পাইপে চোখ রাখে তখন ছবি কিংবা দৃশ্যগুলো দেখার সময় সাইলেন্ট ছবির আইরিশ শটের (শটের শুরুতে পর্দার কোথাও একটা ছোট্ট গোল অংশ থেকে বৃত্তটা পুরো পর্দায় ছড়িয়ে যায় আর ছড়ানোর সাথে সাথে ছবি দৃশ্যমান হয়, কিংবা শট শেষ হবার সময় বৃত্ত ছোট হতে হতে শট ফেড আউট হয়ে অন্ধকার হয়ে যায়) মত করে ছবিগুলো দেখানো হয়। আধুনিক ছবিতেও আইরিশ শট যথেষ্ট ব্যবহার হয়েছে এবং তার আলাদা নন্দনতত্ত্বও আছে, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিকে এই শটগুলো পয়েন্ট অব ভিউ ভাঙার বেশি কিছু করতে পারে না।
এ ছবির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এর সাউন্ডের ব্যবহার। এখানেও পুনরায় টেকনিক্যাল গলদ। অবশ্য এই জিনিসটা আজকের যুগের নব্বইভাগ ছবিতে চোখে পড়ে। সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে আমরা চোখে দেখায় যতটা গুরুত্ব দিই কানে শোনায় ততটা গুরুত্ব দিই না। সহজভাবে বলতে গেলে আমরা যা দেখি তা আমরা দেখি কিন্তু আমরা যা শুনি বা মনে করছি শুনি আদতে আমরা তা শুনি না। এটা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারবেন যদি একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ রেকর্ড করে বাড়িতে বসে সেই রেকর্ডটা চালিয়ে শোনেন। দেখবেন গাড়ির ইঞ্জিন, ব্রেক মারা, নানারকম হর্ন, মানুষের কথাবার্তা, বাতাসের শব্দ, কাকপক্ষীর চেঁচামেচি সব মিলেমিশে জগাখিচুরি হয়ে গেছে। অথচ আমরা যখন রাস্তায় হাঁটি তখন তো ঠিক এরকমটা শুনতে পাই না। ছবিতে সাউন্ডের ব্যবহারটা এমন হওয়া উচিত যাতে তা মানুষের শ্রবণ অনুভতির অনুরুপ হয়, যন্ত্রের নয়। আমার বিশ্বাস তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক ছবির সাউন্ড মিক্সার রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যা রেকর্ড করেছেন তা হুবহু বসিয়ে দিয়েছেন ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড অ্যাম্বিয়ান্স হিসেবে। বিশেষত রাস্তার দৃশ্যগুলোতে এই সাউন্ড কর্কশভাবে কানকে আঘাত করে। এ অবস্থা এড়ানোর একটা উপায় হচ্ছে কী কী শব্দ ব্যবহার করে সাউন্ড ডিজাইন করা হবে তা আগ থেকে ঠিক করে, কোনো একটা নিরিবিলি পরিবেশে প্রত্যেকটা সাউন্ড (নানারকম গাড়ি চলা, মানুষের কোলাহল ইত্যাদি) আলাদা আলাদাভাবে রেকর্ড করে, পরে এডিটিং রুমে সাউন্ড মিক্সিঙের সময় নিজের রুচি অনুযায়ী শব্দের আবহ তৈরি করা। এতে পূর্বোল্লিখিত জগাখিচুরি ইফেক্টটা যেমন এড়ানো যায় তেমনি ইমেজের মতো সাউন্ডকেও নান্দনিকভাবে ব্যবহার করা যায়।
ছবির সাউন্ডের একটা ব্যাপার কিন্তু প্রশংসার যোগ্য। ধ্বনিগত বৈচিত্র তৈরির দিকে পরিচালক যথেষ্ট খেয়াল রেখেছেন। কিছু কিছু জায়গায় সাউন্ড বেশ ভালো ডিটেল হিসেবে কাজ করেছে।
ছবি শেষ হয়েছে The End লেখার বদলে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি দিয়ে। “শেষ হয়েও হইল না শেষ।” এটা অনেকটা একই কথা দুবার বলার মত নয় কি? ইমেজ দিয়ে যে কথাটা বলা হল, সেটা পুনরায় শব্দে বলার কোনো কারণ খুঁজে পাই না।

পন্ডিতেরা বলেন কোনো কাজের সমালোচনা করার চেয়ে সহজ আর কিছু হয় না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না? “Those who can’t do, Teach.”, অনেকটা সেরকম। আমারও তাই মনে হয়। বিশেষত ফিল্মের মত একটা কাজে কথাটা খাটে সবচেয়ে বেশি। একজন পরিচালককে যে প্রতিদিন কি পরিমাণ চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটা যিনি খুব কাছ থেকে দেখেননি তাকে কখনো বলে বোঝানো যাবে না। ভারতীয় সমালোচকদের ওপর বিরক্ত হয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “এদেশি সমালোচকরা কখনো কাটিং রুমে পা মাড়ান নি, মিক্সিং কী জিনিস তাঁরা বোঝেনই না।” হয়ত আমিও বুঝতাম না। কিন্তু সম্প্রতি একটি ছোট ছবি করার সুবাদে আমারও সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। আপনি বাড়িতে বসে মনে মনে একটা সুন্দর সিকোয়েন্স করলেন, এরপর খাতায় লিখে/এঁকে জিনিসটা সাজালেন। তারপর সেটে গিয়ে দেখলেন একটা দেয়ালের জন্য বাসায় যেভাবে ভেবেছিলেন শটটা সেভাবে নেয়া যাচ্ছে না। কী করবেন? যত সময় যাচ্ছে পয়সা উঠছে। তাড়াহুড়ো করে স্ক্রিপ্টটা কিছুটা এদিক ওদিক করে শটটা নিয়ে নিলেন। এরপর গেলেন একটু ডিফিকাল্ট একটা শট নিতে। শটটা একবারে হলো না। এবার দুই/তিন/চার করে পঁয়ত্রিশবারে এসেও হয়ত শটটা হলো না! আর এদিকে আপনার মাথায় হাত, শিডিউল যে পিছিয়ে যাচ্ছে! তার চেয়েও বড় কথা যত পেছাচ্ছে তত পয়সা উঠছে। কিংবা ধরুন এক টেকেই শটটা হয়ে গেল, তাহলে আরো বিপদ। তখন হয়ত মনে সন্দেহ জাগতে শুরু করবে; শটটা ঠিকমত হয়েছে তো? কিছুক্ষণ পর আপনিই বলবেন, কী দরকার রিস্কে গিয়ে, আরেকটা নিয়ে নিই না বাবা। সেফ খেলার জন্য ঐ শটটারই তিনটে টেক নিলেন। ঐদিন নমোঃ নমোঃ করে কাজ শেষ, পরদিন হয়ত শুক্রবার, ছুটি। কিন্তু তাই বলে আপনার রক্ষে নেই। ইউনিটের অন্যরা যাবে বেড়াতে আর আপনি যাবেন কাটিং রুমে। পুরো সপ্তাহ কি শ্যুট করলেন মোটামুটি জোরাতালি দিয়ে লাগিয়ে দেখবেন, যাকে বলে রাফকাট। কিন্তু সেটা করতে গিয়েই মাথায় হাত। যে যে শটগুলো নিয়েছেন সেগুলো কোনমতে জোড়া লাগানো যাচ্ছে না! আবার জোড়া লাগলেও সিকোয়েন্সটা যেভাবে ভেবেছিলেন সেভাবে হচ্ছে না, আবার এদিকে পুনরায় শ্যুট করার প্রশ্নই ওঠে না। কিংবা ঐ যে কিছু কিছু শট এক টেকেই হয়ে গিয়েছিল বলে বাড়তি কয়েকটা টেক নিয়েছিলেন এবার সেখান থেকে বুঝতে পারছেন না কোনটা নেবেন। অনেকে বলবেন এটার প্রথম, দ্বিতীয়টার মধ্য অংশ, তৃতীয়টার শেষ অংশ এভাবে পছন্দমত নিয়ে কেটেকুটে ম্যানেজ করা যায়। আপনাদের জানিয়ে রাখি সব ক্ষেত্রে এসব চলে না। আর চললেও সেটা হবে film editors nightmare! এসব দেখে রাগে দুঃখে আপনার ইচ্ছে করবে সামনের মনিটরটা তুলে আছাড় মারতে। “ধ্যুর! যা হবার হবে, মরুক গে ছাই”, বলে হয়ত চলে যাবেন। বাড়ি ফিরে ছুটির দিনে হয়তবা এসবের রাগ ঝাড়বেন বাড়ির অন্যদের ওপর। পরের দিন আবার বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হবে। হয়ত পরের সপ্তাহে গিয়ে আগের সপ্তাহের কাটিংটা দেখে নিজেই চমকে উঠবেন! নিজেই বলবেন, “আরে! এ তো অতটা খারাপ হয়নি। ভালোই দেখাচ্ছে। চলবে, চলবে, কাজ হবে”, কিন্তু ততক্ষণে ঐ সপ্তাহের কাটিং মাথায় হাত তুলে দিয়েছে!
যুগে যুগে চলচ্চিত্রকারেরা এসব সয়ে এসেছেন। ত্রুফো কি আর সাধে বলেছিলেন, “When I begin a film, I want to make a great film. Halfway through, I just hope to finish the film.”
কাজেই কোনো ছবি বিচার করবার সময় এই কথাগুলোও একজন সচেতন দর্শকের মাথায় রাখা উচিত। নাহলে পরিচালকের ওপর  বড্ড অন্যায় করা হবে যে!

তৃতীয় বিশ্বের ম্যাজিক একজন সত্যিকার চলচ্চিত্রপ্রেমীর অক্লান্ত পরিশ্রমে রচিত। পরিচালক আনোয়ার হোসেন পিন্টু এরপর আর ছবি করবেন কি না জানি না, তবে আমরা আশা করব যাতে করেন। আজকের বাংলাদেশে ছবির যে অবস্থা তাতে  একটা ছবি করতে যে ঝক্কি, সে ঝক্কি পোহাতে রাজি বেশি লোক নেই। লেখা থেকে প্রচার পর্যন্ত দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনেকেই হারিয়ে যান। পিন্টু পুরো সিস্টেমটার ভেতর দিয়ে এসেছেন এবং বেশ ভালোভাবেই বেরিয়ে এসেছেন। হয়ত এর পরের ছবিটা দিয়েই যে তিনি আমাদের সকলকে চমকে দেবেন না তা কে বলতে পারে?

লিখন চন্দ্র দত্ত : দ্বাদশ শ্রেণী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *