সাস্টের আন্দোলন, পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির ভিসি ও আমরা
সাদিয়া মেহজাবিন ।। আমাদের প্রত্যেকের বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি পরিবারে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছায় আমরা ধীরে ধীরে পরিবার থেকে বেড়িয়ে চলে যাই বিদ্যালয় নামক বৃহত্তর পরিসরে। প্রত্যেকের প্রাথমিক ইচ্ছা জ্ঞান অর্জন ছিল বটে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা বিদ্যাপাঠের স্থানকে প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে গড়ে তুলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে মৌলিক অধিকারের মতই আমাদের চাওয়া পাওয়া ছিল উন্নত বিদ্যাপীঠ। যেখানে সমতা, ন্যায়, বৈজ্ঞানিক মুক্তমনের পরিবেশ থাকবে। নিজেদের জাতিকে উন্নত ধরে নিয়ে আমরা আরো উন্নত হবার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে যাই। কিন্তু বিদ্যালয়ে এ উন্নত শিক্ষাগুলো যারা দেন, তারা কি আদৌ উন্নত? তারা কারা?
খুব ছোট থাকতে শিক্ষক বলতেই আমাদের মনে এক শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্র সামনে আসে কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা নড়চড় হবার উপক্রম। একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তিক জায়গা থেকে চায় তার শিক্ষক হবে একজন মুক্তমনা, বৈজ্ঞানিকমনস্ক, ন্যায়বোধসম্পন্ন, সুন্দর মনের অধিকারী মানুষ। আমাদের এই চেনা পরিচিত শব্দগুলো হাওয়ায় ভেসে আসেনি। আমরা সময়ের প্রয়োজনে শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি। একবিংশ শতাব্দিতে এসে আমাদের নিশ্চিত লক্ষ্য থাকবে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে সর্বোচ্চ উন্নতি কিন্ত আফসোস আমাদের শিক্ষার্থীরা বুলেট হামলার শিকার হচ্ছে। শিকার হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যা আদি যুগ থেকেই ছিল। যার শেকল এখন অব্দি ভাঙ্গা হয়নি বরং দিনে দিনে তা মজবুত হচ্ছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ৬০ ঘন্টা পার হয়ে গেলো। শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন করছেন। তাদের মধ্যে অনেকে হাসপাতালে। অনেকের অবস্থা খুবই খারাপ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে রাস্তায়। কিন্তু কেন?
সাস্টের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক নিয়মে তাদের ৪ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল কিন্তু ভিসিকে তালাবদ্ধ করে রাখার সময় পুলিশের লাঠিচার্জ কেন? শিক্ষার্থীদেরকে বুলেট দিয়ে আঘাত কেন? ঘটনার রেশে দেখা যায় ভিসি ফরিদ সাহেব বলছেন, তিনি ছেলেদের হলের সময়ের চাইতে মেয়েদের হলে ঢোকার সময় কম দিয়েছেন কারণ মেয়েরা রাতে বাইরে ঘোরাফেরে। এমন মেয়েদেরকে কেউ বৌ করে আনতে চান না। মেয়েদের চরিত্রে দাগ লেগে যায়।
তাহলে ভিসি সাহেবের কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না। ভিসি সাহেব যে কথা বলছেন তা আমাদের পাশের বাসার আন্টি, আমাদের মা-বাবা, সমাজ রোজ বলে যাচ্ছে। শুধু সাস্টের ভিসি নন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাই প্রতিনিয়ত এসব আচরণ করছেন। কই আমরা তার জন্যে তো প্রতিবাদ করি না। পুলিশ বুলেট দিয়ে হামলা করেছে তাও নিতান্ত স্বাভাবিক কেননা সমাজের বিরুদ্ধে যে গিয়ে প্রতিবাদ করবে তাদের প্রায় এমন নাজেহাল অবস্থা আমরা দেখি। তাহলে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কতটা যৌক্তিক?
শিক্ষার্থীরা লড়ছে সিস্টেমের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, সিস্টেম। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় একটা সিস্টেম। ভিসি একজন সিস্টেমের প্রথাগত দাস।
আমরা তথাকথিত সমাজের বাইরে গিয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন এবং মুক্ত পরিবেশে সুষ্ঠ বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার উদ্দ্যেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের পরিবারের মত হবার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি ধারণা তাই বলে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সব জায়গায় হামলে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় এবং ছাত্র আমদানী করা শুরু করে তখনই লেগে যায় দ্বন্দ্ব। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব আমাদের শেখায় নারীকে ঢেকে রাখা, নারীকে বন্দি করা, নারীকে পবিত্রতার ধারণা দিয়ে পিছিয়ে রাখা।
আমাদের চাওয়া ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে বৈজ্ঞানিক, মুক্তমনা, সমতায় বিশ্বাসী। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির প্রধান কাজ শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের মৌলিক দাবি পূরণ। কিন্তু ভিসি সাহেব এসব বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীদের চরিত্র আর বিয়ে নিয়ে। প্রশ্ন এমন চাওয়া আমাদের কী কী কারণে ছিল? বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও ভিসি রাজনৈতিক উপায়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষাবিদ হিসেবে নয়। শিক্ষকরা যে রাজনৈতিক উপায়ে আসেন তা মূলত পুরুষতান্ত্রিক শোষণের রাজনীতি। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে লড়ে পড়াশোনা করে আপনি যত উচ্চ পর্যায়ে যান না কেন, সমাজ দিন শেষে প্রশ্ন করবে বিয়ে হয়েছে? বাচ্চা কবে নেবেন? সংসার সুখের নাকি? স্বামী অন্যত্র কেন যায়? চাকরি কেন করেন? বাচ্চা কে মানুষ করবে? ঘরের কাজ কাকে দিয়ে করান? পরকিয়া আছে নাকি? ইত্যাদি।
তাহলে ভিসি সাহেবের মেয়েদের চরিত্রে দাগ লেগে যাবার ভয় থাকা স্বাভাবিক। আমাদের দেশের প্রত্যেক ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের চর্চা হয়। শিক্ষকদের থেকে আমাদের সমাজে কি বার্তা পৌঁছাচ্ছে? মেয়েরা রাত বিরাতে বাহিরে থাকা উচিত নয়, শালীন পোশাক পরা উচিত, বিয়ে হওয়াই একজন নারীর প্রধান লক্ষ্য, চরিত্রে সদা সতী থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্ধে হামলা করতে হবে।
একজন শিক্ষক তখনই কুরুচিপূর্ণ ও পুরুষতান্ত্রিক কথা বলতে পারেন যখন তার শিক্ষক থেকে ভিসি হয়ে ওঠার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া একটি পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতি হয়।
এখন সমাজ শতভাগ নিশ্চয়তা দেবে ভিসি সদা সত্য কথা বলে কেননা সম্পূর্ণ সিস্টেমই পুরুষতান্ত্রিক। তাহলে থলের বিড়াল বের করে আন্দোলন সম্পূর্ণ সিস্টেমের বিরুদ্ধেই করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় যখন সিস্টেম তখন লড়াই সুনিশ্চিত হওয়া উচিত।
দেশ পুরুষতন্ত্রে ভরে যাচ্ছে দেখে যাদের খারাপ লাগছিলো তাদের সামান্য আশা দেওয়া যায় তরুণ প্রজন্ম পূর্বের গোঁড়া ধারণার শেকল ভেঙ্গে প্রতিবাদ করছে। অন্তত আমাদের পক্ষের লড়াই তারা করছে। তাদের সাথে সংহতি জানাই। তাদেরকে শ্রদ্ধা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]